এরপর দৃষ্টির শেষ সীমায় নদী আর সাগর একাকার হয়ে যায়।
নোয়াখালি শহর বা মাইজদী থেকে চেয়ারম্যান-ঘাট আসতে প্রায় ঘণ্টা খানেকের পথ।
চেয়ারম্যান-ঘাটে যাওয়ার পথে পথে রাস্তার দুই ধারে সারি সারি বৃক্ষরাজি। সবুজের হাতছানি। শহরের ধূসরতা ক্রমেই যেনো ক্ষীণ হতে থাকলো। সবুজ থেকে আরো সবুজ। অনেক গাছেরই নাম জানি না। শহর থেকে একটু দূরেই নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সেই পথ ধরেই শেষপ্রান্তে চেয়ারম্যান-ঘাট। শীতের এতো সকালে কোনো পাখির কিচির মিচির কানে এলো না। দুই পাশে সবুজ। আর মাঝে মাঝেই সব কিছু গ্রাস করে নিচ্ছে ভোরের কুয়াশা। সব কিছু অদৃশ্য; শুধুই কুয়াশা। কিছুটা পথ ধীরে চলে কুয়াশার গ্রাস থেকে বের হয়ে আবার দ্রুত গতিতে পথ চলা। সেপথ ধরে এগুলেই চর জব্বার।
এমনিতে শীত খুব বেশি না। কিন্তু অটোরিকশার ফাঁক-ফোকর দিয়ে বাতাসের ঝাপটা শরীরের যেখানে লাগছে মনে হচ্ছে যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই ঘণ্টাখানেকের পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে চেয়ারম্যান-ঘাটে যখন পৌঁছালাম তখন চারপাশে জাহাজে ওঠার তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
সাত-সকালেই চেয়াম্যান-ঘাটে মানুষের ব্যস্ততার শেষ নেই। আসলে এঘাটে সকালেই যতো ব্যস্ততা। কারণ, হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ বা অন্যান্য দ্বীপ ও চরে যাওয়ায় জন্য সকালেই এখান থেকে মানুষ জাহাজে বা ট্রলারে চেপে বসে। যদিও ট্রলার দিনের অন্যান্য সময়েও চলাফেরা করে। কিন্তু হাতিয়া যাওয়ার জাহাজ বা সী-ট্রাকটি সকাল সাড়ে আটটায় ছেড়ে যায়। হাতিয়া থেকে আবার একই জাহাজ ফিরে আসে ১২টার দিকে।
বিভিন্ন কাজে দ্বীপবাসীরা শহরে আসে। কেউ বা ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য কোথাও যায়। হাতিয়া নিঝুম দ্বীপবাসীদের চেয়ারম্যান-ঘাট হয়েই যাতায়াত করতে হয়। যদিও হাতিয়া বা মনপুরা থেকে লঞ্চে সরাসরি ঢাকা যাওয়া যায়।
ঘাটের রাস্তার দু্ই পাশেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন দোকান, খাবার হোটেল। শীতের দিন, তাই গরম কাপড়ের অস্থায়ী দোকান দিয়ে বসেছে কয়েকজন। খবু কম দামেই মিলছে সেসব গরম কাপড়। ১০০ থেকে শুরু করে ৫০০ টাকায় মেলে সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি, মাফলারসহ আরো অনেক কিছু।
মাইজদী মসজিদ-মোড় থেকে চেয়ারম্যান-ঘাটের দূরত্ব প্রায় ৫০ কি.মি। মাথাপিছু ভাড়া ১২০টাকা। ভাড়া এতো বেশি কেন? জিজ্ঞেস করতেই সিএনজিওয়ালা যেনো কিছুটা বিরক্ত হয়েই বললেন তার ক্ষোভের কথা। বললেন, ‘ভাড়া ভাই বেশি না। ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়, খরচ বাদ দিলে হাতে কিছু থাকে না’। বললাম, কই রাস্তায় তো কোনো চাঁদা বা টোল দেখলাম না। বললেন, ‘এখন সকাল, ফেরার সময় দেখবেন’। সত্যিই, হলোও তাই। হাতিয়া থেকে ফেরার পথে দেখলাম রাস্তায় তিন জায়গায় চাঁদা দিতে হলো। তাদের কোনো রিসিপ্ট নেই। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এরা কারা, কিসের চাদা দিলেন?’ বললেন, ‘সবাই ভাগ পায়। নিচ থেকে ওপরে সবাই পায়। কি আর কইতাম ভাই’। রাস্তায় চার জায়গায় ছাড়াও আরো কয়েক জায়গায় দিতে হয়। কোনো কোনো জায়গায় দৈনিক আবার কোনো জায়গায় মাসিক চাঁদা দেওন লাগে। হাতিয়া থেকে ফেরার পথে শুনলাম পথে পথে চাঁদা তোলার কাহিনি।
চেয়াম্যান-ঘাট আসলে হাতিয়ারই অংশ। মাঝখানে প্রমত্ত মেঘনা নদী। তারই মাঝে হাতিয়া দ্বীপ বা মূল হাতিয়া উপজেলা। ঘাটে জাহাজ ভেড়ানোই ছিল। তিন টাকার ঘাট টোল ও নব্বই টাকার জাহাজ ভাড়ার টিকেট কিনে জাহাজে চড়ে বসলাম। খুব সকালে যাত্রা শুরু করেছি, সামনে আরো দীর্ঘ পথ। জাহাজ ছাড়তে আরো কিছুটা সময় বাকি। তাই এ অবসরে সকালের নাস্তাটা সেরে নিলাম। সঙ্গে ছিলেন আমাদের অপরিচিত সেই তৃতীয় সহযাত্রী।
মোহনা থেকে মেঘনার একটি শাখানদী ভেতরে প্রবেশ করেছে। এখানেই জাহাজ-ঘাট। শুষ্ক মৌসুম তাই পানি বেশ কম। জাহাজটিকে সাবধানে একপাশ ধরে চলাচল করতে হয় যাতে ডুবো চরে আটকে না যায়। তবে মেঘনায় পড়লে আটকে যাওয়ার ভয় আর থাকে না। যদিও বড় নদীতেও ডুবো চর থাকে। তাই সী-ট্রাক নির্দিষ্ট চ্যানেল ধরেই যাতায়াত করে। সেই পথ ধরেই সী-ট্রাক এগিয়ে চললো হাতিয়ার দিকে।
বাংলাদেশ সময়: ০১২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০১৭
জেএম/