গুচ্ছবদ্ধ ফুলগুলো প্রধাণত গোলাপি, সাদা ও লাল রং এর হয়। পাপড়ি ও ফুলের গড়ন বিচিত্র।
এই নিয়ে বাংলাদেশেও মাতামাতি কম নয়। এন্ড্রু কিশোরের সেই বিখ্যাত গান তাই বলে, ‘ওগো বিদেশিনি তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও, এসো দুজনে প্রেমে হই ঋণী’—এটি শুনেছেন নিশ্চয়ই!
ছাত্রজীবনে যখন গানটি শুনি তখন চেরি ফুল চিনতাম না। যখন জানলাম এটি জাপানের ঐতিহ্যবাহী একটি ফুল, তখন থেকেই চেরি ফুল কাছে থেকে দেখার খুব ইচ্ছে করত। মহান সৃষ্টিকর্তা আমার সেই ইচ্ছা পূরণ করেছেন, চেরি ফুলের দেশে চলে এলাম। এটি শুধু ঐতিহ্যবাহী নয় জাপানের জাতীয় ফুলও। গত বছর আমি যখন জাপানে এলাম, তখন থেকেই গাছগুলো শ্রীহীন রিক্ত অর্থাৎ ন্যাড়া রূপ ধারণ করে ছিলো। মানে চেরি ফুলের সিজন শেষে এসেছিলাম। তারপর গাছে নতুন পাতা এসেছে। এর পর থেকে অপেক্ষায় আছি কখন চেরি ফুল দেখব। দিন যায়, মাস যায়, বাংলাদেশে শীত-বসন্ত শেষ হয়ে বৈশাখ আসি আসি করে, কিন্তু এখানে শীত যেন শেষ হতেই চায় না। তাই চেরির দেখাও মেলে না।
জাপানে এ বছর শীতের তীব্রতা মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত চলেছে। এরপর কয়েক দিন কিছুটা হালকা গরম পড়তেই রুক্ষ চেরি গাছগুলোর কাণ্ড ভেদ করে কুঁড়ি বের হতে দেখলাম। মজার ব্যাপার হলো- শীতের প্রকোপ না কমলে কুঁড়িগুলো গুটি অবস্থাতেই থাকে। জাপানের আবহাওয়া অফিস হিসাব করে বলে দেয়, কোন অঞ্চলে কবে চেরির দেখা পাওয়া যাবে। সেই হিসেব করেই লাখো দেশি-বিদেশি পর্যটক ঘুরতে বের হয়। প্রতি বছর মার্চ-এপ্রিলে সাধারণত চেরি ফুল ফোটে।
এ সময়টা গোটা জাপানটাকেই মনে হয় চেরি ফুলের স্বর্গ রাজ্য। বিশাল বিশাল পাতাবিহীন পুরোগাছটাকে মনে হয় চেরির রাজ্য! এ সময়টায় পার্ক থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে হানামি উৎসব করে থাকে জাপানিজরা। চেরি ফুলের এ উৎসব দেখতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে লাখো পর্যটক ভিড় জমায়। হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট সব খানেই বিদেশী পর্যটকে ঠাসা।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে গাছ থেকে অবিরাম খসে পড়েছে লাল, খয়েরি, বাদামি পাতা। এরপর অপেক্ষায় থাকে জাপানিজরা। কখন ফুটবে এ ফুল। প্রেম আর ভক্তির এক র্মূত প্রতীক যেন এই সাকুরা। চেরি ফুল ফোটাকে জাপানিজরা গভীর আবেগের চোখে দেখে। শীতের পর বসন্তের ঝলমলে দূত হচ্ছে এই চেরি ফুল। ফুলগুলো যেন বলছে- ভয় নেই, আমি আসব, আমি আবার আসব, ফুটব, হাসব, তোমাদের ভরিয়ে দেব আমার যৌবনের উচ্ছলতায়।
জাপানের হানামি বা চেরি ফুলের উৎসব
প্রস্ফুটিত চেরি ফুলকে ঘিরে গাছে গাছে রঙিন প্রজাপতির মেলা বসেছে। জাপানিজদের কাছে শোনা যায়, এই ফুলের নিজস্ব একটা জ্যোতিও আছে। রাতের অন্ধকারে গাছের ডালগুলো কেমন উজ্জ্বল হয়ে থাকে! চেরি ফুলের সুগন্ধ আর মার্ধুয জাপানিজদের মনে তুমুল প্রশান্তি এনে দেয়।
চেরি ফুলকে ঘিরে যে উৎসব হয় সেটা দেখার জন্য লাখো পর্যটক সমাগম ঘটে। এ উৎসবকে জাপানিরা বলে হানামি উৎসব বলে। এ উৎসব দেখতে আমি ও আমার বন্ধু জীবন খান টোকিও শহরের ইয়ুগি পার্ক, উয়েনো পার্ক ও শিনকইওয়া পার্কসহ বেশ কিছু স্থানে ঘুরাঘুরি করেছি। চেরি দেখতে সব বয়সী মানুষের ভিড়। সপরিবারে অথবা বন্ধুবান্ধব মিলে খাবার, ড্রিংকস নিয়ে চেরি গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে বসে গল্প করছে, কেউবা খেলছে, কেউ আবার ঘুমাচ্ছে। এ যেন অন্য রকম এক উন্মাদনা। যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কষ্টকর!
অন্যদিকে পার্কের মাঠে মেলার মতো স্টল নানা রকমের খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে আছে এবং যার যেটা পছন্দ কিনে খাচ্ছে। চেরিকে নিয়ে সারা বিশ্বেই চলে ব্যাপক উন্মাদনা। জাতীয় ফুল বলে জাপান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে জাপানিরা এই ফুলটিকে নিয়ে উৎসব পালন করে আসছে, যাকে ‘হানামি’ উৎসব বলা হয়।
হানামি জাপানি শব্দ, এর অর্থ ফুল দেখা বা ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা। অনিন্দ্য সুন্দর এ ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে জাপানিরা এ উৎসবের আয়োজন করে। উৎসবের দিনটি জাপানিদের কাছে এক মিলনমেলায় পরিণত হয়। হানামি মানে সাধারণ ভাষায় যা চেরি গাছের নিচে বসে পিকনিক করা আর চেরির সৌন্দর্য উপভোগ করা।
চেরির সৌন্দর্য অল্প কয়েক দিনের, এক সপ্তাহের মাথায় পাপড়িগুলো ঝরে পড়া শুরু হয়। মানব জীবন ক্ষণস্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনে সব সময় সুন্দর থাকার চেষ্টা করা, এই দর্শন জাপানিরা নাকি চেরির কাছ থেকেই পেয়েছেন। জাপানের সাহিত্য কর্মে প্রাণবন্ত জীবনের প্রতীক রূপে চেরিকে তুলে ধরা হয়। জাপানের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা হয়েছে চেরি উদ্যান। অতি যত্ন করে লাগানো গাছগুলো প্রতি বসন্তে শোভা ছড়িয়ে চলেছে। নদীর কিনার ঘেঁষে রোপিত চেরি গাছগুলোর পুষ্পশোভিত শাখা প্রশাখা প্রবাহমান জলের মধ্যে তৈরি করছে অসাধারণ প্রতিবিম্ব। বাড়িয়ে দিয়েছে সৌন্দর্য।
দেশে দেশে চেরি উৎসব
চেরি উৎসব এখন জাপান ছাড়াও বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে পালিত হয়। চীন, তাইওয়ান, কোরিয়া, ফিলিপাইন, ম্যাকাও, জর্জিয়া, ফিনল্যান্ড ও আমেরিকা। শত বছর আগে ১৯১২ সালে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে জাপানিরা আমেরিকাকে তিন হাজার সাকুরা গাছের চারা উপহার দেয়। ১৯৬৫ সালে আরও প্রায় চার হাজার চারা উপহার হিসেবে পাঠানো হয় জাপানের পক্ষ থেকে। ফলে এটি এখন আমেরিকানদের কাছেও বেশ মোহনীয় একটি ফুল। নিউইয়র্কের ব্রুকলিতে প্রতি বছর মে মাসের মাঝামাঝি সাকুরা ফেস্টিভ্যাল হয়।
চেরি ফুল ও ফল
ফুল-ফল মিলিয়ে সারা পৃথিবীতে ৪৫০ জাতের চেরি পাওয়া যায়। এ গাছ সর্বোচ্চ ৩০ মিটারের মতো উঁচু হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুলের অসংখ্য রকমফেরও চোখধাঁধানো। মূলত ফুল, ফল ও আলংকারিক শোভাই এই গাছের জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। এরা পিচ ও এপ্রিকট ফলের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। ফুল ঝরে পড়ার পর নতুন পাতায় সবুজ রূপ ধারণ করে। চেরী ফুলের এই দেশটিতে চেরী ছাড়াও রয়েছে আরো হাজার রকমের ফুল। সাঝানো গোছানো দেশটিকে একবার ঘুরে না দেখলে পৃথিবীর অপরূপ সুন্দর্য দেখা থেকে বঞ্চিত হবেন।
মাহবুব মাসুম: প্রবাসী সাংবাদিক, [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ৪, ২০১৭
জেডএম/