আয়োজনে ছিল বনশ্রী কোয়ান্টাম সেন্টার। ৩৮ জনের দলে সহযাত্রী হিসেবে ছিলেন ৭-৮ জন নারী এবং কয়েকজন শিশু-কিশোর ।
বেশ কিছু পথ হেঁটে যাবার পর আমাদের থাকার জন্য লম্বা ঘর। গণবিছানার ব্যবস্থা দেখে চমকে উঠলাম। রুমে মশারী টাঙ্গানোর কোন ব্যবস্থা নেই, ফ্যানও নেই। ভাবছি মশার কামড়ে থাকব কিভাবে? কিছুক্ষণ পরই টের পেলাম এখানে মশার নাম-গন্ধটিও নেই। মহিলা ও শিশুদের আবাসনের ব্যবস্থা ছিল অন্যত্র।
কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে পাশেই দরবারান হলে সকালের নাস্তা খেতে গেলাম। এখানে প্রায় তিন শতাধিক লোকের একসাথে খাওয়ার ব্যবস্থা। নাস্তার তালিকায় ছিল রান্না ডিম, পাতলা খিচুরি ও রং চা। দরবারানে ঢুকেই দেখলাম শত শত শিশু ডাইনিং টেবিলে বসে সুশৃঙ্খলভাবে খাচ্ছে। কোয়ান্টামের কর্মচারীরা তাদের সামনে খাবার পৌঁছে দিচ্ছে।
নাস্তা শেষে বের হতে না হতেই দেখলাম এক দল শিশু লাইন ধরে হেঁটে যাচ্ছে। আর যেতে যেতে একই ছন্দে আওয়াজ করে কি যেন এক শ্লোগান দিয়ে যাচ্ছে। বুঝার জন্য ভাল করে কান পাততেই শুনলামঃ
“সুস্থ.....দেহ, প্রশান্ত..... মন
কর্ম......ব্যস্ত, সুখী...... জীবন”
লামায় অবস্থানকালীন সময়ে শিশুদের আত্নপ্রত্যয়ী হয়ে বেড়ে ওঠার এ শ্লোগানটি শুনেছি নিদেনপক্ষে আরও পঁচিশ থেকে ত্রিশ বার। সারা দিনমান শিশুরা দল বেঁধে ভিন্ন ভিন্ন পাহাড়ে অবস্থিত স্কুল, আবাসন, খেলার মাঠ, ডাইনিং হলে পথ চলতে এই শ্লোগান আওড়ে চলছে। ওরা কোয়ান্টা!
অতঃপর স্নানের পালা। কিন্তু সে স্নান শহরের সাজানো-গোছানো বাথরুমের শাওয়ার বা বাথটাবে নয়, একদম বুনো প্রকৃতির মাঝখানে ঝিরির পাথুরে জলস্রোতে। স্নানের জন্য আমাদের পুরুষ সদস্যদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ঝিরি ঝর্ণায়। আর মহিলাদেরকে নেওয়া হলো চিঁ চিং ফাঁক ঝর্ণায়। সবার হাতে একটি করে লাঠি তুলে দেওয়া হলো।
ঝর্ণায় যাওয়ার পথে পানির গভীরতা ও পাহাড়ে উঠতে শরীরের ভর রাখার জন্য এই লাঠির ব্যবস্থা। ঝর্ণার অপূর্ব নয়নাভিরাম দৃশ্যে আমরা অভিভূত। স্রষ্টার এক অপূর্ব সৃষ্টি- চোখে না দেখলে, অনুভব করার সুযোগ না পেলে যা কল্পনা করাও অসম্ভব। সেখান থেকে ফিরে কোয়ান্টাম পল্লীতে অবস্থিত মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করলাম।
নামাজ থেকে ফিরে খেয়ে দেয়ে ভাত ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো সেবকের ঘন্টা ধ্বনিতে। আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হলো ধ্যান ঘরে। ধ্যান ঘরে জানানো হলো মাটির ব্যাংকের কাহিনী, যা দিয়ে চলে ‘কোয়ান্টামম’ এর দুঃস্থ শিশুদের পড়াশুনাসহ লালন পালনের কাজ।
বিকেলে কোয়ান্টাম পল্লী ভ্রমণ। একে একে ঘুরে দেখানো হলো হংসলেক, ঐকতানসহ পল্লীর বিভিন্ন স্থাপনা।
বেশ কয়েক প্রজাতির হাঁস রয়েছে এখানে। কিছু হাঁস দুধসাদা বর্ণের, আবার কারো আছে ধূসর ছোপ, দৃষ্টি এড়াবে না লাল টুকটুকে ঝুঁটিসমেত হাঁসটিকেও। হংসলেকে চোখে পড়বে ছোট্ট বাঁশের তৈরী ঘর। ঘরে ওঠার জন্য আবার সিঁড়িও রাখা হয়েছে। দিনশেষে হাঁসগুলো এখানেই আশ্রয় নেয়।
পুরো দৃশ্যকে আরো চমৎকার করে তোলে হংসলেকের পাড় ঘেঁষে বাশঝাঁড়টা। ঘন সবুজ বাঁশপাতার নকশা আর সরসর শব্দ সবই যেন হাঁসদের ডুবসাঁতারকে করে তোলে আরো ছন্দময়।
তারপর ঐকতানে এসে থামলাম। প্রাচীন ব্যাবলনীয় স্থাপত্যের আদলে নির্মিত আমাদের দেশের বিশালাকার মুক্তমঞ্চগুলোর একটি। বাঁশঝাড়ের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে মঞ্চের ডানাকৃতির দুই প্রান্ত, সামনের অংশ - সবকিছুই পার্বত্য প্রকৃতির সাথে এত বেশি সাযুজ্যপূর্ণ যে হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে এটা যেন নিবিড় প্রকৃতিরই একটা অংশ। চারদিকের গ্যালারি এবং মাঝেসহ একসাথে হাজারেরও বেশি দর্শক বসার ব্যবস্থা রয়েছে।
সন্ধ্যায় মুক্তমঞ্চের একেবারে সামনে বসে কোয়ান্টামম এর উপর নির্মিত ডকুমেন্টারি দেখলাম। শিশুকাননের ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও এ্যাক্রোবেটিক শো হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এই শিশুদের স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল অবাক করার মতো। হঠাৎ করে পেছন ফিরে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম। কারণ ডকুমেন্টারী দেখার শুরুতে আমাদের পাশের দর্শক গ্যালারী ছিল শূন্য। অথচ ৫-৬ মিনিটের ব্যবধানে পিন পতন শব্দ না করে এত বিশাল গ্যালারী কোয়ান্টা শিশু দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। এই বয়সেই কমান্ডোর মতো এদের গতিবিধি!
পরদিন খুব ভোরে কোয়ান্টা শিশুদের স্কুল পরিদর্শনের জন্য যাত্রা। দূর পাহাড়ের পেছনে সূর্যটা যখন উঠছে তখন আমরা সারি বেঁধে উঠছি পাহাড়ের চূড়ায়। পথেই দেখা হয়ে গেলো ধ্যানমগ্ন এক দল কোয়ান্টার সাথে।
বান্দরবানের লামার দুর্গম পাহাড়ি এলাকা সরই এখন বিখ্যাত কোয়ান্টাম শিশুকানন নামে পরিচিত। এছাড়াও আছে কসমো স্কুল এন্ড কলেজ। এখানে বাঙালী, মারমা, মুরুং, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, সাঁওতাল, রাখাইনসহ বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর শিশু রয়েছে। তাদের খাওয়া, পড়া ও থাকা সম্পূর্ণ ফ্রি। ভোর পাঁচটায় বিছানা ছেড়েই শারীরিক কসরতে অংশ নেয় তারা।
এখানকার প্রতিটি শিশু বেড়ে উঠছে নিবিড় তত্ত্বাবধান ও প্রশিক্ষণে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, শারীরিক প্রশিক্ষণ, ব্যায়াম, মেডিটেশন, নৈতিক মানবিক ও আত্মিক শিক্ষা সবকিছুতেই দীক্ষিত করা হচ্ছে এদের। শিক্ষা ও সুযোগ পেলে যেকোনো মানুষই যে তার মেধাকে বিকশিত করতে, পারে তার প্রতিভার স্বীকৃতিকে আদায় করে নিতে তারই এক উজ্জ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানকার শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকেরা জানান, খুব ছোটবেলা থেকেই তাদের সবকিছু হাতেখড়ি হচ্ছে। যার যেদিকে মনোযোগ তাকে সেভাবেই গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী হতে শুরু করে সর্বত্রই এদের জয়জয়াকার অবস্থা। জাতীয় বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কুচকাওয়াজে অংশ গ্রহন করে প্রথম স্থান অর্জন করেছে। জাতীয় স্কুল খো খো প্রতিযোগিতায় প্রথমবার অংশ নিয়েই চ্যাম্পিয়ন। অনুর্ধ ১৬ বিশ্ব যুব অলিম্পিক গেমস এর আরচ্যারি’ ইভেন্টে সাফল্য, ৮ম বাংলাদেশ গেমসে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জপদক অর্জন, জাতীয় বয়সভিত্তিক জিমন্যাস্টিকসে স্বর্ণপদক জয়, হ্যান্ডবলে প্রথম বিভাগে উন্নীত। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘কোয়ান্টা’ মানেই প্রথম।
একটা সময় পার্বত্য এই শিশুরা কৈশোরোত্তীর্ণ হতে না হতেই বলি হতো তথাকথিত শান্তি বাহিনীর হাতে। সেই শিশুরা আজ মেধা-মননসহ সব দিকে ছাপিয়ে উঠেছে। যেন একখন্ড স্বপ্নের বাংলাদেশ! একটি অবহেলিত জনপদে কী বিস্ময়কর বাঁকবদলের সূচনা হয়েছে! যে অনাথ অসহায় শিশুরা একসময় শিক্ষার আলো বঞ্চিত ছিল, ছিল সকল ধরনের সুযোগ সুবিধার বাইরে, তারাই আজ প্যারেড ও ডিসপ্লের লাগাতার চ্যাম্পিয়ন। ‘হবেই হবে, হবে নিশ্চয়, শাশ্বত সত্যের হবেই জয়’।
পথে যেতে যেতে বিভিন্ন পাহাড়ে চলমান কোয়ান্টামের বনায়ন দেখার সুযোগ হলো।
ব্যাম্বোরিয়ামে এসে মুগ্ধতা ভাষা কেড়ে নিল। প্রকৃতির সাথে একাত্নতার এ এক অপার্থিব অনুভূতি। সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর হলো বাঁশের পাতার সৌন্দর্য। সবুজের সতেজতা আর পাতায় পাতায় রৌদ্র-ছায়ার খেলা।
আবারো স্নানের পালা। তবে এবার আর ঝিরিতে নয়। অধিকতর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। প্রায় অন্ধকার গিরিখাদ চিঁ চিং ফাঁকের হাঁটুপানি, কোমরপানি ভেঙ্গে এগুচ্ছি যেন অজানা রহস্য ভেদ করতে।
মাঝে মাঝে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে নানা লতা-গুল্ম, শামুক কিংবা বাঁশের খন্ড। কিন্তু তারপরও এগিয়ে যাওয়া। কারণ এ পথের শেষ যে আমাদের দেখতেই হবে।
অবশেষে আসে সেই চিঁ চিং ফাঁক, দুই পাহাড়ের আলিঙ্গন যেখানে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।
দুপুরে আবাসনে ফিরে খাওয়া সেরে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরিয়ে পরা। তবে এবার অন্য পথ। এই পথ আরও কঠিন। গন্তব্য স্থল গ্রাউন্ড অলিম্পিয়ান মাঠ। কত পথ যে ঘুরলাম। ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছিল যে এই পথ দিয়ে আবার ফিরতে হবে। বিকালে ধ্যান ঘরে মিলিত হয়ে সহযাত্রীদের মজার মজার অভিজ্ঞতার বর্ণনায় ভেসে গেলাম।
দুই দিনের সফরের নিখুঁত বর্ণনা এত ছোট্ট পরিসরে দেয়া কোনভাবেই সম্ভব না। ফলশ্রুতিতে বাদ পরেছে বেশকিছু স্থাপত্য, কারু শিল্প, অরণ্য, অভয়ারন্য ও সহযাত্রীদের আবেগ-অনুভূতির কথা। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কোয়ান্টামে কাটালেও এই সৌন্দর্য ফুরাবার মতো নয়। যেতে নাহি মন চায়, তবু যেতে হয়। আবার আসতে হবে, বার বার আসতে হবে। এ তৃষ্ণা নিয়ে রাত্রির আঁধার কেটে ফেরত যাত্রার পথ যখন ধরছি, নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে ওঠে অশ্রুতে।