সিনেমায় এমন দৃশ্য অনেক দেখা যায়। বাস্তবে এমন অভিজ্ঞতা পেতে হলে আপনাকে নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড যেতে হবে, রাজধানী বেলফাস্ট থেকে বেশ দূরে, পাহাড়ঘেরা এক সমুদ্রতটে।
মেঘলা এক সকালে বেরিয়ে পড়লাম অজানা এক জায়গার উদ্দেশে। আগের দিন বেলফাস্ট এসেছি এস্টার এর ছুটিতে, তিনদিনের জন্য। হোটেল থেকেই একটা বাসের ব্যবস্থা ছিল যাতে করে আমরা রওয়ানা হলাম। বাসের ড্রাইভার একইসঙ্গে ট্যুর গাইডও। তিনি আমাদের শুরুতেই জানিয়ে দিলেন সারাদিন আমরা কোন কোন জায়গায় যাব আর কী কী করবো।
সমুদ্রের ওপর দড়ির সেতু ধরে হাঁটার কথা শুনে আমার মতো আরও অনেকেই বলে উঠলো ‘ওয়াও’। আমার যেন আর তর সইছিলো না সে জায়গাটিতে যাওয়ার। ড্রাইভার প্যাট্রিক সব বলে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা এক্সাইটেড কিনা, আমরা সমস্বরে চিৎকার করলাম বাসের সব যাত্রী মিলে ‘আই’ মানে, হ্যাঁ।
তো বাস চললো বিশাল একটা হ্রদকে পাশে নিয়ে। নর্দার্ন আয়ারল্যাণ্ডের ম্যাপ থেকে দেখা যায় তার ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল জলাভূমি। আইরিশ ভাষায় তাকে বলে লগ নেহ। সেই হ্রদের পাশে রয়েছে এক ডাচ রাজপুত্রের দুর্গ। সেখানে বাস থামলো কিছুক্ষণ। যাত্রীরা সবাই ছবি টবি তুলে আবার বাসে ফিরে এলেন। আবার শুরু হলো যাত্রা।
প্যাট্রিক বেশ রসিক লোক, তিনি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সম্পর্কে অনেক তথ্য আমদের বললেন। সেই সঙ্গে মজার মজার অনেক কাহিনী। বাস চললো পাহাড়ের মধ্য দিয়ে। একপাশে গ্রাম, অন্যপাশে সমুদ্র। সে গ্রামগুলো ছোট্ট কিন্তু ভীষণ সুন্দর, সবুজ আর সবুজ। কোনো গ্রামে হয়তো মোটে তিনশ লোকের বাস, কোনটাতে সাতশ- এরকম। এসব গ্রামের লোকেরা নাকি এখনও দৈত্য দানোর অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। তারা বিশ্বাস করে আকাশে পাখির মতো করে অদৃশ্য পরিরাও ওড়ে।
কোন মানুষ যদি ভুল করে সেই পরিদের কোনো ক্ষতি করে তাহলে তার জীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে আসে। কোথাও তিন দিকে ঘেরা পাহাড় আর মাঝখানে অল্প কয়েক ঘর লোকের বাস, কোথাও দিগন্ত পর্যন্ত শুধু সবুজ পাহাড়, সেখানে ভেড়া চরছে, কোনো মানুষের বাস নেই, আবার কোথাও শুধু পাইনের বন, কোনো প্রাণী নেই, বনের মধ্যে দিয়ে সরু নদী বয়ে চলেছে পাথর পেরিয়ে। প্রকৃতি যেন খেয়ালী হাতে সব সাজিয়েছে।
এই সমুদ্রটা এক পাশ দিয়ে চলেছে, তার পরেই আবার সে হারিয়ে গেলো পাহাড়ের আড়ালে। বাস যতবার পাহাড়ের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো, নিচে দূরে দেখা যাচ্ছিলো লোকালয়। খেয়ালী প্রকৃতির মাঝে মানুষের ঘরবাড়ি। প্যাট্রিক বললেন, বুড়ো বয়সে অবসরের পর তিনি এমনি একটা ছোট্ট গ্রামে চলে আসবেন আর সমুদ্রে মাছ ধরে সময় কাটাবেন। এই যাত্রাপথের সৌন্দর্য নিয়েই একটা উপন্যাস লেখা যায়।
যাই হোক আসল কথায় আসি। এতোক্ষণ যে জায়গায় যাওয়ার কথা বলছিলাম তার নাম ক্যারিক অ্যা রিড রোপ ব্রিজ। ক্যারিক অ্যা রিড আইরিশ শব্দ, যার মানে পথের মাঝখানের পাথর। জায়গাটিতে পৌঁছে মনে হলো এর নামটি সার্থক। কারণ এখানে সমুদ্রের পাশে উঠে গেছে পাথরের পাহাড় আর তার ওপর পায়ে চলা পথ। আমাদের বাস পার্ক করা হলো পাহাড়ের ওপরে, সেখানে সব গাড়ি থামার জায়গা। পাহাড়ের ওপর দিয়ে পথ, সেই পথের ধারে আবার আরেক গুচ্ছ পাহাড়। সেই পাহাড়গুলোর পাথরের রং ঠিক জং ধরা লোহার মতো। সমুদ্রের মাঝখানে আবার দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড় যার চূড়া একদম সমতল।
ক্যারিক আ রিড রোপ ব্রিজের ইতিহাস হলো, এ অঞ্চলে একসময় প্রচুর স্যামন মাছ পাওয়া যেতো। সেই মাছ শিকার করতে আসা জেলেরা এখানকার সমুদ্রের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দুটি পাহাড়ের মধ্যে এই দড়ির সেতু বানিয়েছিল সাড়ে তিনশো বছর আগে। সেতুটা সমুদ্র থেকে একশো ফুট ওপরে। এক পাশ থেকে অন্য পাশের দৈর্ঘ্য বাইশ ফুট। সেই সময় মাছ ধরা ছিল এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম পেশা। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই সেতুটি বেঁধেছিল।
তখন কেবল একটি দড়ির হাতল ধরে সেতুটি পার হতে হতো। পায়ের নিচের দড়িগুলোতে ছিল বড় বড় ফাঁক, যার ওপর দিয়ে অতি সাবধানে চলতে হতো। একটু উনিশ বিশ হলেই সোজা সমুদ্রে পড়া ছাড়া আর উপায় ছিলো না। সেতু পার হয়ে পাহড়ের ঢাল বেয়ে জেলেরা যে জায়গায় নামতো সেখানে স্যামন মাছের অবাধ বিচরণ ছিলো। সেখান থেকে মাছ ধরে তারা জীবিকা নির্বাহ করতো।
সেই সাড়ে তিনশো বছর আগের সেতু এখনও টিকে আছে। কালে কালে তাতে পরিবর্তন এসেছে অবশ্যই। পাহাড়ের ওপর পায়ে চলা উঁচুনিচু পথ ধরে হেঁটে চললাম। নীল সমুদ্র একপাশে, আরেক পাশে পাহাড়। পথের দু’ধারে ঝোপঝাড় আর ঘাসের জঙ্গল। পাহাড়ের কিনার ধরে রাস্তা, একপাশে শক্ত কাঠের রেলিং। চড়াই উতরাই ভাঙতে ভাঙতে হাঁপ ধরে গেলো। প্রায় আধ ঘণ্টা চলার পর দেখা গেলো দড়ির সেতু।
এই পর্যটন ক্ষেত্রটির তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল ট্রাস্ট নামে একটি সংগঠন। সেতুতে উঠতে হলে আগে টিকিট কাটতে হয়, তা আমরা বাসে থাকতেই কেটে নিয়েছিলাম। সেতু যেখানে শুরু তার অনেকটা সামনে গেট বসানো। গেট দিয়ে ঢুকে দেখলাম নিচে সিঁড়ি নেমে গেছে, পাহাড়ের একটা ধাপ থেকে আরেক ধাপে নামার জন্য। রুক্ষ পাথরের পাহাড় তার মধ্যে সিঁড়ি বেয়ে নামতে একটু ভয় লাগছিলো। দড়ির সেতুর সামনে দাঁড়িয়েও একটু ভয় ভয় লাগছিলো, মনে হচ্ছিলো যদি পড়ে যাই তাহলে আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!
যদিও সেখানে একাধিক লাইফ গার্ড সর্বক্ষণ দায়িত্বে থাকে। সেতুর দু’দিকে মোটা দড়ির রেলিং আর পায়ের নিচের দড়ির ওপর জাল বিছানো, তার ওপর সরু একটা কাঠের তক্তা, তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। প্রাচীন সেতুর নিরাপদ আধুনিক সংস্করণ। একবারে আটজনের বেশি সেতুতে ওঠা বারণ।
উঠলাম দড়ির সেতুতে। দু’হাত দু’দিকের রেলিংয়ের ওপর। নিচে তাকানোর সাহস হলো না। হাঁটা শুরু করতেই সেতুটা একটু কেঁপে উঠলো। তবু সাহস করে হাঁটতে লাগলাম। কয়েক পা যেতেই মন থেকে ভয় চলে গেলো। প্রকৃতির রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চারদিকে নীল চাদরের মতো বিছিয়ে আছে সমুদ্র। একপাশে সবুজ পাহাড়। আমার সামনের পাহাড়ের গায়ে ঘাসফুল ফুটে আছে। আকাশ যেন অনেক নিচে নেমে এসেছে, আদুরে রোদ ছড়িয়ে আছে, পায়ের নিচে শুনতে পাচ্ছি সমুদ্রের গর্জন … আহ্ এর চেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর কী হতে পারে।
খুব বেশিক্ষণ সময় নেওয়া গেলো না, কারণ আমার পেছনেও লোক আছে। হেঁটে পেরিয়ে এলাম সেতু। চলে এলাম অন্য দিককার পাহাড়ে। পর্যটকরা সব সেখানে ছবি তুলছে, চারপাশ দেখছে। এই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে জেলেরা নেমে যেত সমুদ্রের কাছাকাছি মাছ ধরার জন্য। কিন্তু এখন বেশিদূর যাওয়া যায় না। কিছুদূর গেলেই শক্ত বেড়া, সেখানে যাওয়ার উপায় নেই, নিরাপত্তার জন্য।
আবার সেতু ধরে ফিরতে হবে। এবার আর ভয় করলো না, হাঁটার তালে তালে সেতুর কেঁপে ওঠাকে বেশ রোমাঞ্চকর লাগলো এবার। চারপাশ দেখতে দেখতে পার হয়ে গেলাম সেতু।
পাহাড় বেয়ে ফিরে চলা। পাহড়ের কিছু জায়গায় বেড়া নেই। খাঁড়া পাহাড় সোজা নেমে গেছে সুনীল সাগরে। সেই জায়গাগুলো খুব সাবধানে পার হতে হয়। উঁচুনিচু পথ ধরে বাসের কাছে ফিরতে ফিরতে মনে হচ্ছিলো কী দরকার ছিল এতো আধুনিক সময়ে জন্মানোর। বেশ হতো যদি তিনশো বছর আগে এমন এক জেলে হয়ে জন্মাতে পারতাম। প্রকৃতির কোলে দিন কাটাতাম। দড়ি বেয়ে পাহাড় পেরিয়ে নির্ভয়ে চলে যেতাম সমুদ্রের জলে মাছ ধরে আনতে। আধুনিক সভ্যতার সঙ্কট বইতে হতো না। কী পেলাম কী না পেলাম তা নিয়ে কোন আফসোস ও থাকতো না।
গায়ে রোদ মেখে, সমুদ্রের নোনা জলে পা ভিজিয়ে, পায়ের নিচে পাথুরে পাহাড় মাড়িয়ে, সবুজ পাইন বনে হারিয়ে গিয়ে প্রবল আনন্দে বাঁচতে পারতাম আমার জীবনটাকে, যাকে হয়তো সত্যিকারের বেঁচে থাকা বলা যেত!
বাংলাদেশ সময়: ১২২২ ঘণ্টা, মে ১৯, ২০১৮
এএ