ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

ঘুরে এলাম ঊনাইনপূরা সুখলাল সুবেদার মঠ মন্দির

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১২ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১৭
ঘুরে এলাম ঊনাইনপূরা সুখলাল সুবেদার মঠ মন্দির ঊনাইনপূরা সুখলাল সুবেদার মঠ মন্দির

চট্টগ্রাম: ভোরের আলো ছড়িয়েছে সবেমাত্র। গ্রাম জাগতে শুরু করেছে। পূব আকাশে সোনালী আভা এসে পড়েছে মন্দিরের চূড়ায়। চিক চিক করছে মন্দির, অন্যরকম এক দ্যুতি ছড়ানো মাদকতা। সবুজের মাঝে এক খণ্ড স্বর্ণের আবরণ মেলে ধরেছে প্রকৃতিতে।

পুণ্যার্থীরা তখনো মন্দিরমুখো হয়নি। ধ্বনিত হয়নি ‘বুদ্ধ শরণং গচ্ছামি, ধর্ম শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘ শরণং গচ্ছামি’।

পা রাখলাম মন্দির প্রাঙ্গণে। গ্রামীণ মেঠোপথ আর নেই, নয়নাভিরাম সবুজ আর সবুজ। ইট পাথরের গ্রামীণ পথ মাড়িয়ে পৌঁছে গেলাম ঊনাইনপূরা সুখলাল সুবেদার মঠ (মন্দির) প্রাঙ্গণে।

চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের ঊনাইনপূরা গ্রামে মন্দিরটির অবস্থান। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়ার ইউনিয়ন কৃষি স্কুল এলাকা অথবা আমজুরহাট কিংবা শাহগদি মার্কেট এলাকায় নামলে সহজে পৌঁছানো যাবে এই মন্দিরে। হাঁটাপথে ১০ থেকে ১২ মিনিট সময় লাগবে।

মন্দির ঘুরে এসে শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী ঊনাইনপূরা লঙ্কারামে কথা হয় বাংলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু সংঘরাজ ড. ধর্মসেন মহাস্থবিরের সাথে। জানালেন মন্দির নিয়ে নানা তথ্য উপাত্ত পৌরাণিক গল্প কথা। তিনি জানান, ঊনাইনপূরা সুখলাল সুবেদার মঠটি (মন্দির) প্রায় তিনশ বছর আগে মোগল আমলে নির্মিত হয়। এখানে মোগল আমলে জনবসতি ছিল, যার সাক্ষী চারপাশের মঠ, সড়ক, গ্রাম ও পুকুরের নাম এবং মঠে ব্যবহৃত ইট। ধর্মগুরু ধর্মসেন মহাস্থবিরের মতে, এ মঠের ইট প্রমাণ করে ঊনাইনপূরা পুরোনো জনপদ।  

১৭০০ খ্রিস্টাব্দে নবাব আলীবর্দী খানের শাসনামলে এ গ্রামের পূর্বপ্রান্তে সচ্ছল ক্রেংলাহ মহাস্থবির (রাউলি) অবস্থান করতেন। সুখলাল ছিলেন সেকালের উচ্চশিক্ষিত, সৎ ও চরিত্রবান ব্যক্তি। থাকতেন মহাপুরুষের সংস্পর্শে। ক্রেংলাহ মহাস্থবির ছিলেন তাঁর গুরু এবং পরমবন্ধু ছিলেন অগ্নি খোনকার (হযরত শাহ গদী রাহ.)।

অসাধারণ গুণাবলী ও ব্যক্তিত্বের কারণে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার তৎকালীন অধিপতি নবাব আলীবর্দী খান আনুমানিক সপ্তদশ শতাব্দীতে সুখলালকে এলাকার সুবেদার (শাসনকর্তা) পদে নিয়োগ করেন। তখন থেকে তিনি সুখলাল সুবেদার নামে পরিচিত হন। জ্ঞান, দূরদর্শিতা এবং সুবিচারের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন দেবতাতূল্য।

ড. ধর্মসেন মহাস্থবির মন্তব্য করেন, ‘রাজকার্যের জন্য সুখলাল সুবেদারকে নিজ জন্মভূমি থেকে অনেক দূরে থাকতে হতো। কিন্তু তিনি তাঁর ইচ্ছেমতো স্ত্রীর সান্নিধ্যে থাকতেন। তিনি যে স্ত্রীর সংস্পর্শে থাকতেন তা ছিল সবার অজানা। এমনি সময়ে তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হলে সমাজের লোকেরা ব্যঙ্গ করে কুৎসা রটাতে থাকে। এ অবস্থায় সুখলাল সুবেদারের মা পুত্রকে বললেন, তুই যে ঢাকা (মোগল আমলের রাজধানী) থেকে আকাশ মার্গে উড়ে এসে তোর স্ত্রীর কাছে থাকিস তা কেউ জানে না। এখন তোর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, এ নিয়ে সমাজের লোকেরা তোর স্ত্রীর নামে কুৎসা রটাতে শুরু করেছে। তুই যদি এর কোনো বিহিত না করিস তাহলে সমাজে বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। সুখলাল সুবেদার বললেন ‘মা, তাহলে একদিন সমাজের সকল লোকের জন্য শীতের পিঠা তৈরি কর এবং তাদের নিমন্ত্রণ কর। ’

এক রাতে তাঁর মা ও স্ত্রী তাড়াহুড়া করে পিঠার তৈরি করে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ সকলকে নিমন্ত্রণ করলেন। অতিথিরা সবাই উপস্থিত হলেও সুখলাল সুবেদার তখনও বাড়ি এসে পৌঁছায়নি। এজন্য সবাই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রীতিভোজ অর্থাৎ পিঠা খাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেই সুখলাল সুবেদার তাঁর ঋদ্ধিবলে ঢাকা থেকে আকাশ মার্গে উড়ে এসে উপস্থিত হন। তাঁর এ অলৌকিক কর্মকাণ্ড দেখে সকলে নির্বাক ও নিরুত্তর হয়ে পড়েন। সেই থেকে তাঁর স্ত্রীর প্রতি ব্যঙ্গ বিদ্রুপেরও অবসান ঘটে।

কিংবদন্তি: ক্রেংলাহ মহাস্থবির গভীর রাতে পুকুরের মধ্যে গিয়ে ঋদ্ধিবলে শরীরের নাড়িভুড়ি বের করে ধুতেন। একদিন তাঁর এই অলৌকিক কর্মকাণ্ড এক মহিলা দেখে ফেললে তিনি বিহার ছেড়ে অরণ্যে চলে যেতে চান। কিন্তু সুখলাল সুবেদার তাঁকে ছাড়তে রাজি নন। এদিকে ক্রেংলাহ মহাস্থবিরও তাঁর সিদ্ধান্তে অটল তিনি বনে যাবেন। অবশেষে তাঁর জন্য গ্রামের পূর্বপ্রান্তের জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে অন্ধকারময় গুহার মতো করে প্রায় চার ফুট প্রস্থ দেয়ালের এক মঠ নির্মাণ করেন সুখলাল। এখানেই ক্রেংলাহ মহাস্থবির ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। এই মঠই সুখলাল সুবেদার মঠ নামে পরিচিত যা কালক্রমে ধর্মীয় তীর্থস্থানে পরিণত হয়। কর্মযোগী কৃপাশরণ মহাস্থবির ও আর্যশ্রাবক জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবিরসহ অপরাপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ধ্যান সাধনার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে এ মঠ।

সংস্কার: একসময় মঠটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়লে আর্যশ্রাবক জ্ঞানীশ্বর মহাস্থবিরসহ অপরাপর বৌদ্ধ মনীষাদের অনুপ্রেরণায় মঠটি প্রথম সংস্কারের উদ্যোগ নেন বিশিষ্ট সমাজসেবী প্রয়াত উমেশ চন্দ্র তালুকদার। আর্থিক সহায়তায় এগিয়ে আসেন তাঁরই বড় ভাই প্রয়াত রমেশ (বাড়িওয়ালা) তালুকদার। ১৯৯০ সালে সংঘরাজ ধর্মসেন মহাস্থবির ও সমাজসেবী প্রয়াত নীরদ বরণ বড়ুয়াসহ বিশিষ্টজনদের অনুপ্রেরণায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত মুকুল কান্তি বড়ুয়া মঠটি দ্বিতীয়বার সংস্কার করেন। পরে সুরঞ্জন বড়ুয়ার উদ্যোগে দানশীল ব্যক্তিদের সহায়তায় তৃতীয় দফা সংস্কার করা হয়।

সংস্কার নয় এবার নান্দনিকতার ছোঁয়া: ২০০৪ সাল থেকে তরুণদের উদ্যোগে নতুন করে শুরু হয় মঠের সংস্কারকাজ। তৈরি হয় মঠের রাস্তা, তোরণ, ঘাট ও মঠ প্রাঙ্গণ। ২০১৪ সালে নতুন রূপে সংস্কারকাজ উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ সামশুল হক চৌধুরী। একে নান্দনিকতার ছোঁয়া দিতে চলে তরুণদের প্রাণান্তকর চেষ্টা। রূপকথার গল্পের মত প্রতিদিন বদলেছে এ মঠ। কয়জন তরুণের লেগে থাকায় এ মঠ পায় পূর্ণতা। এভাবে তরুণদের উদ্যোগ ও পুণ্যার্থীদের দানে বর্তমান রূপ পেয়েছে প্রাচীন এই মঠ।

লেখক: সাংবাদিক।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।