মাত্র কয়েকটা দিন আগের ঘটনাই তো। পাইলটের ঘোষণা অনুযায়ী আমাদের প্লেন তখন উড়ছে ৩৬ হাজার ফুট উপর দিয়ে।
হঠাৎ করেই মেঘের দঙ্গল ফুঁড়ে আমরা উপস্থিত হলাম এক চিলতে নীল উঠোনে। একেবারে পরিষ্কার আকাশ। আরও অবাক করে দিয়ে ছোট্ট জানালা গলে একটু নীচেই রংধনু দেখা যাচ্ছে। নতুন বলে আমাকে ডান দিকে জানালার পাশে বসানো হয়েছে, যাতে এভারেস্টসহ শুভ্র শৈলশ্রেণী চোখে পড়ে। কি দুর্ভাগ্য! আবার দুষ্টু মেঘেরা কোত্থেকে এসে হাজির হলো। তাদের হানাদারি চললো সেই ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামা অবধি।
এ যাত্রায় আর রাজ দর্শন হলো না। অবশ্য মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই, নূর ভাই, বিথী, শাকিলদের কোনো ভাবান্তর নেই। তাদের এ অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই হয়েছে।
অনেক পুরনো স্বপ্ন ধীরে ধীরে বাস্তব হতে দেখলাম নিজের চোখে। বিএমটিসি আমার ক্লাব, দেশের সবচেয়ে পুরনো ও নামি পর্বতারোহণ সংগঠন। সেই ক্লাবের ২৯তম হিমালয়ান অভিযানের অংশ আমিও। নেতৃত্বে দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও সফল, সেই সঙ্গে দু’বারের এভারেস্ট আরোহী প্রথম বাংলাদেশি এম এ মুহিত। আরও আছেন পাঁচটি করে ছয় হাজার মিটারি পর্বত আরোহণকারী দুই অভিজ্ঞ পর্বতারোহী কাজী বিপ্লব এবং নূর মোহাম্মদ। আছে সম্ভাবনাময় দুই পর্বতারোহী শায়লা পারভীন বিথী এবং ইকরামুল হাসান শাকিল।
এবারের লক্ষ্য ৬ হাজার ২৪৯ মিটারের লারকে পর্বত শিখর। হিমালয়ের মানাসলু হিমালয় অঞ্চলে এটি অবস্থিত। আমার লক্ষ্য মানাসলু পরিক্রমা সম্পন্ন করা, সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার মিটারের উপরের উচ্চতায় শরীর কতটা কাজ করে তা দেখে নেওয়া। মুহিত ভাইয়ের প্রচেষ্টায় স্পন্সর জোগাড়, অনেক কষ্টে অফিস থেকে ছুটিও জোগাড় হলো। প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্সের দিন এবং এর পরে সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত কাভারেজ উদ্যম বাড়িয়ে দিলো কয়েক গুণ।
এই অভিযান কেন্দ্র করে অনেক দিন ধরেই শরীর ঝালিয়ে নিতে রমনায় প্রতিদিন সকালে আমরা নিয়ম করে ব্যায়াম করেছি। পর্বতারোহণে শারীরিকভাবে ফিট থাকা সবচেয়ে বেশি জরুরি। যদিও আজকাল অনেকের মধ্যেই এ ব্যাপারে অনীহা দেখা যায়। শুধু এ অভিযান না, বিএমটিসি সদস্যরা নিয়মিতভাবে সবাই একসঙ্গে দৌড়ানো থেকে শুরু করে নানা ধরনের শারীরিক কসরত করেন নিয়মিত। যাওয়ার দু’দিন আগ পর্যন্ত চলেছে এ প্রক্রিয়া। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ১০ অক্টোবর। আগের দিনই ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ফেলেছিলাম। যদিও মূল কেনাকাটা হবে কাঠমান্ডু থেকেই। সাড়ে সাতটার মধ্যেই আমরা চলে এলাম বিএমটিসির প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের বাসায়। বিএমটিসির প্রতিটি অভিযানের যাত্রা শুরু হয় তার বাসা থেকেই। এখানে দেখা করতে এলেন শামীম ভাই, রূপক ভাই, খাদিজা আপু, তৃষারা। ফটোসেশন, নাস্তার পর রওয়ানা হলাম বিমানবন্দরের পথে।
সেখানে পৌঁছে ইমিগ্রেশনও সম্পন্ন হলো সহজেই। কিন্তু সাড়ে ১১টার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ছাড়ার আগ মুহূর্তে বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটলো। সার্ভিস কারের ধাক্কায় ডান ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হলো। অগত্যা আবার লাউঞ্জে গিয়ে অপেক্ষা। অনিশ্চয়তার দোলাচলে যখন সব দুলছে তখন জানা গেলো আরেকটি ফ্লাইটে আমাদের কাঠমান্ডু পাঠাবার ব্যবস্থা হচ্ছে দুপুর ২টায়। লেট শব্দটির যথার্থতার চূড়ান্ত করে শেষ পর্যন্ত প্লেন আকাশে উড়লো বিকেল ৩টায়।
এয়ার ট্রাফিকের কারণে কাঠমান্ডুতে নামতেও দেরি। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বাইরে এলাম তখন বিকেল পাঁচটা। আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন আমাদের এজেন্সি ক্লাইম্বালায়ার ফিনজো। নেপালি রীতিতে উত্তরীয় দিয়ে বরণ করে নিলেন তিনি। বড় মাইক্রোবাসে আমরা চলেছি থামেলের পথে। সেখানেই আমাদের হোটেল ঠিক হয়েছে। প্রথম দেখার উত্তেজনা নিয়ে কাঠমান্ডু দেখছি। আমাদের ঢাকার মতোই তো। সেই ট্রাফিক জ্যাম, ধুলোবালি। কিন্তু কোথায় যেন একটা বিশেষত্ব আছে। হিমালয় কন্যার রাজধানীতে প্রথম পদার্পণের শিহরণ ঠিকই খেলে যাচ্ছে চোখ মুখে। হোটেলে এসে জিনিসপত্র রেখেই দিলাম ছুট।
ক্লাইম্বিংয়ের অনেক জিনিসপত্র কিনতে হবে। শেষ পর্যন্ত আগামীকালের জন্য বিশাল এক লিস্ট বাকি রেখে তেমন কিছুই করা হলো না। মুহিত ভাইয়ের পরিচিত অনেকের সঙ্গে দেখা হলো। খাওয়া হলো মম। আজ ঘুমিয়ে পড়তে হবে তাড়াতাড়ি। কাল যে থামেল চষে ফেলা বাকি।
চলবে....
বাংলাদেশ সময়: ১৪২৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০১৭
এএ