হঠাৎ করেই আবহাওয়া ভালো হয়ে গেছে। পরিষ্কার আকাশে হাজারো তারার মেলা! বাতাসের লেশ মাত্র নেই।
ভাগ্য টিম লারকের সাথে রীতিমতো ছিনিমিনি খেললো। অবশ্য টিমটি বিএমটিসির বলেই সামলাতে সময় লাগেনি। এটি ক্লাবের ২৯তম অভিযান। সেই ২০০৪ থেকে প্রতি বছর হিমালয়ে অভিযান হচ্ছে ক্লাব থেকে। কখনও সফলতা এসেছে, কখনও ব্যর্থতার মুখ দেখেছে সেই সব অভিযান।
দলনেতা হিসেবে আছেন দেশের অভিজ্ঞতম পর্বতারোহী এম এ মুহিত। পর্বতে এটি যে স্বাভাবিক মেনে নিলাম সবাই। এই যেমন মুহিত ভাই হাই ক্যাম্প থেকে নেমে আসার খবর ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হককে দিতেই, তিনি চলে আসতে বললেন। সব কিছু স্বাভাবিকভাবে নেওয়াও পর্বতারোহণের একটি শিক্ষা।
এক সময় ভোর হলো। পোর্টাররা আগের দিন সন্ধ্যায়ই ভিমতাং থেকে ফিরে এসেছিল। সকালে কোনো রকমে নাস্তা সেরে গুটিয়ে ফেলা হলো বেস ক্যাম্প। এর মাঝে স্প্যানিশ একটি টিম তাঁবু ফেলেছে। তাদেরও লক্ষ্য লারক পর্বতের শিখরে যাওয়া। তাদের শুভ কামনা জানিয়ে আমরা লারকে পাশের দিকে অগ্রসর হলাম। এখান থেকে ২০/২৫ মিনিট হাটলেই পৌঁছে যাওয়া যায় ৫,১০৬ মিটারের লারকে পাস। যারা মানসলু সার্কিট ট্রেক করতে আসবেন তাদের জন্য প্রধান বাধা এ পাস। এ পরিক্রমার সবচেয়ে উঁচু জায়গাও এ গিরিপথ। অসংখ্য প্রেয়ার ফ্ল্যাগে রঙিন লারকে পাস। সবাই নাম ফলকের কাছে এসে ছবি তুলছেন। মুহিত ভাই জাতীয় পতাকা হাতে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন। এটিই এখন পর্যন্ত আমার সর্বোচ্চ উচ্চতা ডিঙোনো। লাল সবুজের পতাকা হাতে নিয়ে শরীরজুড়ে শিহরণ খেলে গেলো।
তুষ্টিতে নয় বরং ভবিষ্যতের আরও বড় রোমাঞ্চের আশা। যাত্রা হলো শুরু; যেতে হবে বহুদূর। লারকে পাসের পরে আর কোনো চড়াই নেই। কিন্তু ভয়ানক উৎরাই পথে সামান্য পা হরকালে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা। আমরা যেন স্বর্গ থেকে একেবারে পাতালে নামছি। এক চিলতে পথে আলগা পাথর আর বরফের সমারোহ। দূরে দেখা যাচ্ছে হিমলুং রেঞ্জ। আমরা নামছি তো নামছিই। এ নামার আর কোনো শেষ নেই। এক সময় বরফাবৃত পথের শেষ হলো। কিন্তু নামার কোনো বিরাম নেই। হাঁটুর আজ বারোটা বাজবে সেটি টের পেলাম। তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার মধ্যেই ভীমতাং নেমে আসলাম। এর উচ্চতা ৩,৭৫০ মিটার। মজার ব্যাপার হলো যে উচ্চতা আমরা দুই দিনে অতিক্রম করেছি বেস ক্যাম্পে আসার সময়, সেই একই দূরত্ব মাত্র কয়েক ঘণ্টায় নেমে এলাম।
পায়ের অবস্থা ততক্ষণে বারোটা বেজে গেছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে গেলো ভীমতাংয়ের দুনিয়া ভোলানো রূপ। দূরে অচেনা পর্বত রেঞ্জের পটভূমিতে ছবির চেয়ে সুন্দর গ্রাম ভীমতাং। গ্রামের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গিয়েছে ছোট্ট এক চিলতে খাল। দেখলেই মনে হবে একটু পা ভিজিয়ে নেই। ভীমতাংয়ে আমরা বেশ কয়েকদিন পর পেট ভরে ভাত খেলাম। ডাইনিংয়ে থাকা ইউরোপীয় ট্রেকাররা রাক্ষস ভেবে ভয় পায়নি এই বেশি!
খাওয়ার পর্ব সেরে আমরা বেশি দেরি করলাম না। আজকে আমাদের গন্তব্য সুরকী খোলা। পরদিন চলে এলাম দারাপানিতে। মজার ব্যাপার হলো দারাপানি কিন্তু অন্নপূর্ণা এলাকায়। কেউ ইচ্ছা করলে মানাসলু সার্কিট ট্রেক শেষ করে অন্নপূর্ণা পরিক্রমাও শুরু করতে পারেন। দারাপানি থেকে গাড়িতে কয়েক ঘণ্টার পথ মানাং। সেখান থেকে থরংলা পাস। আমরা দারাপানি থেকে জিপে চলে এলাম বেসিশহর। মূলত বেসিশহর থেকেই শুরু হয়েছে হিমালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্কিট ট্রেক অন্নপূর্ণার। কিন্তু আমার হৃদয়-মন জুড়ে আছে মানাসলু সার্কিট।
অনেক নিচ থেকে ট্রেক শুরু হওয়ায় একেবারে গ্রীষ্ম আবহাওয়া থেকে একেবারে উচ্চ হিমালয়ের স্বাদ পাওয়া যাবে এ ট্রেকে। এই সব ভাবতে ভাবতে বেসিশহর থেকে বাস চলতে শুরু করলো কাঠমাণ্ডুর দিকে। হিমালয়ের ছোঁয়া পাওয়া মনে নানা ভাবনা তখন, সাফল্য ব্যর্থতার খতিয়ান। সব ছাপিয়ে গেলো আবার ফিরে আসার বার্তা। ইচ্ছা হলো জানালার ফাঁক গলে চিৎকার করে বলি থাকো হিমালয় আবার ফিরে আসবো। সবকিছু স্মৃতি হয়ে যাবে সত্য, কিন্তু হিমালয়ের এ আহ্বান সবসময় বর্তমান। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরছি খুব শিগগিরই।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৭
আইএ
** সামিটের প্রস্তুতির রাতে শুরু হলো বরফ পড়া
** ১৫৪১৯ ফুট উচ্চতায় নীলাভ পানির ছোট্ট বিস্ময় লেক!
** আঁধার ঠেলে উঁকি দিলো আগুনরঙা মানাসলু
** হাতের নাগালে বরফ পাহাড়, বীরেন্দ্র লেকে মুগ্ধতা
** সুন্দরতম গ্রাম লোহ, সামনে চোখ ধাঁধানো মানাসলু
** ১১ ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই বেয়ে ৮৬৫০ ফুট উচ্চতার নামরুংয়ে
** বুড়িগন্ধাকীর সাসপেনশন ব্রিজ পেরিয়ে ফিলিম
** পাহাড়ের গায়ে ঝোলা নেপালের একমাত্র ক্লিপ ব্রিজ
** কখনও সরু ফিতা কখনও এবড়ো-থেবড়ো পথে যাত্রা
** চারিদিকে বান্দরবান বান্দরবান গন্ধ, সামনে আরক্ষেত
** ধুলোবালি গিলতে গিলতে ট্রেকিং শুরুর আরুঘাট (পর্ব-৩)
** হিমালয়ের মানাসলু ট্রেকিংয়ের অদম্য নেশায় যাত্রা (পর্ব-১)