ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পর্ব-৩

আগ্নেয়গিরির চূড়ায় আকাশের হাতছানি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮
আগ্নেয়গিরির চূড়ায় আকাশের হাতছানি মাউন্ট টেইডের চূড়া

রোমাঞ্চকর ক্যাবল কার যাত্রা শেষ হলো। কার থেকে নেমে ছোট একটা অন্ধকার ঘর পেরিয়ে বেরিয়ে এলাম উজ্জ্বল আলোয়। রয়েছি টেইডের চূড়া থেকে অল্প একটু নিচেই।

আহ্‌, চোখের সামনে সে কি দৃশ্য! সামনে লম্বা পাথর বাঁধানো রাস্তা। রাস্তার একপাশে রেলিং দেওয়া।

পর্বতের ঢাল নেমে গেছে রেলিংয়ের ওপারেই। পর্বতের ঢালে কালচে বাদামি শক্ত লাভার স্তর, যেন একটা পোড়ো জমি, যাকে সবাই ত্যাগ করেছে কোনো অজানা কারণে।

অন্যপাশে কিছুটা দূরে মাউন্ট টেইডের চূড়া। এখানেই রয়েছে আগ্নেয়গিরির মুখ। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে ২০০ মিটারের কিছু বেশি হবে উচ্চতা। সেখানে উঠতে হয় পায়ে হেঁটে, আর এজন্য কর্তৃপক্ষের বিশেষ অনুমতি লাগে। শর্মিষ্ঠা পণ্ডিতদেখলাম, যেটুকু সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ঘুরে দেখার জন্য তা প্রায় শেষ হতে চলেছে। তাই এবার টেইডের চূড়ায় ওঠা হলো না।

নীলকান্ত মণির মতো গাঢ় নীল আকাশ আর ঝকঝকে একটা সূর্য হীরের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। আছে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা। স্বপ্নের মতো লাগছিলো সবকিছু। দু’চোখ দিয়ে রীতিমতো গিলছিলাম এ স্বর্গীয় দৃশ্য। এ অপরূপ শোভা দেখার জন্য মাত্র দু’খানি চোখ যেন খুবই কম, সারা শরীরে চোখ থাকলে হয়তো একসঙ্গে চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে পেতাম, বারবার মাথা ঘোরানো দরকার হতো না।

প্রচুর টুরিস্ট কিন্তু কোনো চেঁচামেচি নেই। সবাই নিজের মতো করে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করছে। অপরূপ প্রকৃতির মাঝে যেন ডুবে গেছে আপন মনে।

পাথর বাঁধানো পথটা ধরে এগিয়ে গেলাম। এ যেন লাভার রাজ্য। লাভার স্তর জমে জমে অদ্ভুত আকার ধারণ করেছে জায়গায় জায়গায়। মরচেপড়া লোহার রং তাদের, ছোট বড় হাজার রকম পাথর। এখান থেকে কোনো প্রকার পাথর হোক সেটা ছোট বা বড়, নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।

এখান থেকে আকাশ এতটাই পরিষ্কার দেখা যায়। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংয়ের মতে, রাতে এখানে দাঁড়ালে আকাশের প্রায় সব নক্ষত্রই ভালোভাবে দেখা যাবে। আর আমার হাতের নাগালে নক্ষত্র দেখার নাইট ট্যুরের ব্যবস্থাও আছে।

দলে দলে মানুষ হেঁটে চলেছে, কেউ হয়তো বা হেঁটে টেইডের চূড়ায় উঠবে। সময় সীমিত, তাই আমরা আর বেশি দূর এগোলাম না।

খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা পর্বত চূড়ার দিকে চেয়ে কেমন জানি লাগছিলো। না জানি কত মিলিয়ন বছরের সাক্ষী ‘মাউন্ট টেইডে’! কত বিবর্তন ঘটে গেছে এই গ্রহে। কত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কত যুদ্ধ কত সংকট, কত রাজা এলো গেলো, আর সে এখনো অবিচল দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃঢ়তা অবিচলতা কোনো কিছুতেই টলানো যায়নি। মহাযোগীর মতো ধ্যানমগ্ন এ পর্বতের কাছে এলে জাগতিক বাসনাকে প্রচণ্ড তুচ্ছ মনে হয়। অর্থহীন মনে হয় মানবজীবন।

অনন্তকাল ধরে এই পাহাড়ি পথে হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো, উদ্ধত অবিচল পর্বত চূড়ার দিকে আর অন্যপাশে পাহাড়ের নিচের ওই মেঘের সমুদ্রের দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করছিলো। কিন্তু সময় কম, মানুষের জীবনকালের সময় খুবই অল্প, তাই বুঝি মানুষকে সবসময় ছোটাছুটি করতে হয়। এই পর্বতের মতো অফুরন্ত সময় তো মানুষের নেই।

তাই ফিরে চলতে হলো। অনেক উচ্চতা এবং প্রচণ্ড ঠাণ্ডার জন্য একটু অসুস্থ অনুভব করছিলাম। দম নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। ভয় পেলাম, অল্টিচ্যুড সিকনেস শুরু হয়নি তো! শেষবারের মতো একবার আগ্নেয়গিরির চূড়ার দিকে চাইলাম, মনে মনে বললাম আবার দেখা হবে তোমার সঙ্গে। শর্মিষ্ঠা পণ্ডিতঢুকে গেলাম ঘরের ভিতর, আরও খানিকক্ষণ অপেক্ষার পর উঠলাম ক্যাবল কারে। কার ছুটে চললো মাটির পানে। এবার আর ভয় করলো না বরং কেমন যেন আনন্দ হলো মনে, আবার আমার চেনা সমতলে ফিরতে পারবো বলে। ক্যাবল কারের কাচের ঘেরাটোপের বাইরে রোদে জ্বলা পাহাড় শ্রেণীর দিকে তাকিয়ে মনে হলো, পর্বত চূড়া যত আকর্ষণীয়ই হোক, সে তো মানুষের আশ্রয় নয়। আমরা জন্মেছি মাটিতে, একদিন এই মাটিতেই মিশে যাবো। শেষ পর্যন্ত মাটি হবে আমাদের আশ্রয়, যেখানে আমরা নিরাপদ বোধ করি।

তাই জীবনে যত উঁচুতেই আমরা উঠি না কেন, হোক সেটা পর্বত চূড়া, বা অর্থবিত্ত বা খ্যাতি বা অহংকারের চূড়ায়, এ সত্যটি বোধ হয় ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে (যদিও আমরা বেমালুম যাই), আঁচল পেতে মুখের পানে চেয়ে থাকা মাটির কাছে শেষ পর্যন্ত ফিরতেই হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৮, ২০১৮
এনএইচটি/এএ

ক্যাবল কারে আগ্নেয়গিরির চূড়ায় (পর্ব-২)

আগ্নেয়গিরি চূড়ার দ্বীপ টেনেরিফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।