স্পেনের টেনেরিফ দ্বীপে অবস্থিত এ শহর রাজধানী সান্টা ক্রুজ দে টেনেরিফ থেকে বেশ কিছুটা দূরে। রোমাঞ্চকর আগ্নেয়গিরি দেখা শেষ করে যখন গারাচিকোর পথে রওয়ানা হলাম তখন সবে দুপুর।
কিছুক্ষণ পর বাস এসে থামলো পথের ধারের একটা রেস্তোরাঁতে। গাইড বললেন, এখানে আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে নেবো, তারপর পরের গন্তব্যে যাবো। যে বাসে করে এখানে এসেছি সে বাসটি কিছু যাত্রী নামিয়ে দিয়ে বাকিদের নিয়ে চলে গেলো টেনেরিফের দিকে। তারা আমাদের মতো সারা দিন ঘুরবে না। বাস থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ালাম সবাই।
আমাদের দলে আছে একটা স্প্যানিশ পরিবার, স্বামী স্ত্রী ও দু’টি ছোট ছেলেমেয়ে। ইতালি থেকে আসা একজোড়া তরুণ-তরুণী, বৃদ্ধ এক দম্পতি এবং আমি ও আমার বর। নির্জন রাস্তা, একটা-দুটো গাড়ি যাচ্ছে মাঝে মধ্যে। একপাশে ছিমছাম একটা রেস্তোরাঁ, নাম এল রাঞ্চো। রাস্তা থেকে কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে, একপাশে বাগান বিলাসের ফুলে ভরা ঝাড় দেয়াল তৈরি করেছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছোট্ট পোরচ পেরিয়ে সাদা বাড়ি। সেটিই রেস্তোরাঁ এল রাঞ্চো।
আমাদের দলের লোকেরা কেউ পাশের স্যুভেনির শপে ঢুকলো, কেউ বা গেলো খাবারের অর্ডার দিতে। আমি পোরচে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার সামনে কাঠের সিঁড়ির ধাপগুলো পেরিয়ে রাস্তা। তার ওপারে কিছু গাছপালা আর তারপর দেখা যাচ্ছে একটা ছোট্ট শহর, শহরের শেষ প্রান্তে আবছা নীল সমুদ্র; ভারি সুন্দর দৃশ্য। এই দ্বীপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট শহরগুলো ভারি মনোরম। সেখানকার জনসংখ্যা খুব কম এবং প্রতিটি শহরই ট্যুরিস্টদের জন্য আকর্ষণীয়ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
রেস্তোরাঁয় ঢুকে খাবারের অর্ডার দিলাম। স্প্যানিশদের খুব প্রচলিত খাদ্যগুলোর একটি হলো স্প্যানিশ ওমলেট। এটা আমাদের পরিচিত ডিমের ওমলেটের মতো নয়। ডিমের সঙ্গে সিদ্ধ আলু আর মশলা মিশিয়ে তৈরি হয়, যা খুব সুস্বাদু। স্প্যানিশ ওমলেট, রুটি, সালাদ আর স্প্যানিশ রেড ওয়াইন দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে তৈরি হলাম গারাচিকো যাওয়ার জন্য। এল রাঞ্চো রেস্তোরাঁটি এতো সুন্দর যে চলে যেতে মন চাইছিলো না। এর বারান্দায় কিংবা পোরচে দাঁড়িয়ে সাগর পারের ছোট্ট শহরের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। রেস্তোরাঁর ভেতরটিও স্পেনের ঐতিহ্যিক অনুষঙ্গে সাজানো।
এখান থেকে আমাদের সঙ্গী হলো আয়ারল্যান্ড থেকে আসা পাঁচ বান্ধবী, তাদের প্রত্যেকের বয়স ষাটের ওপরে। এ ব্যাপারটি আমার বেশ ভালো লাগে, ইউরোপের যে শহরেই গেছি সেখানেই দেখেছি বুড়োবুড়িরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়ান। দলের সবাই থাকেন একই বা কাছাকাছি বয়সী। কখনও শুধু স্বামী-স্ত্রী মিলে ঘুরে বেড়ায় আবার কখনও বন্ধু-বান্ধব মিলে বেরিয়ে পড়ে, তারা কারো ওপর নির্ভরশীল নয়, একা একাই সারা বিশ্ব ঘোরে। প্রাচ্যে পঞ্চাশ বা ষাটের পর মানুষ গুটিয়ে যায়, মৃত্যুভয়ে চিন্তিত হয়, কিন্তু পশ্চিমে ষাট বছর থেকে যেন নতুন যৌবন শুরু হয়। আমাদের দেশে রিটায়ার করার পর মানুষ ঘরে বন্দি হয়ে দিন কাটায় আর পশ্চিমে রিটায়ারের পর থেকে শুরু হয় অ্যাডভেঞ্চার। সারা জীবনের সঞ্চয় কিছু থাকলে তা দিয়ে তারা দেশ-বিদেশ পরিভ্রমণ করে।
নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে এমনি দুই নারীকে পেয়েছিলাম যাদের বয়স ৮০ ও ৮২, কিন্তু কী তাঁদের জীবনোদ্যম! পাহাড়ের ওপর দিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক আমাদের সঙ্গে হেঁটেছিলো সমুদ্রের পাড়ে যাওয়ার জন্য। সারা দিন ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতে অক্লান্তভাবে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন, আমায় বলেছিলেন দুই বান্ধবী মিলে বেড়াতে বেরিয়েছেন জীবনকে উপভোগ করার জন্য। জীবন কি করে উপভোগ করতে হয় তা এই শ্বেতাঙ্গ জাতি খুব ভালো জানে।
যাইহোক যাত্রা শুরু হলো গারাচিকোর পথে একটা মিনিবাসে করে। গারাচিকোর কাছাকাছি এসে একটা পাহাড়ের ঢালের ক্যাফেতে বাস দাঁড়ালো। ট্যুর গাইড সান্টিয়াগো একটি অল্প বয়সী স্প্যানিশ ছেলে, সে আমাদের সবাইকে নিয়ে গেলো ক্যাফের ছাদে। কাউকে অন্য কোথাও না তাকিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতে বললো, আমরা তাই করলাম। এরপর সে বললো এবার সামনে হেঁটে গিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াও আর সামনে তাকাও। তাই করা হলো।
সত্যি গারাচিকো শহরকে এর চেয়ে সুন্দর অ্যাঙ্গেলে অন্য কোথাও থেকে দেখা যাবে না। ক্যাফের দেয়াল যেখানে শেষ সেখানে পাহাড়ের ঢাল নিচে নেমে গেছে অনেকদূর, আর সেই পাহাড়ের পাদদেশে বিছিয়ে আছে ছোট্ট গারাচিকো শহর, যেন সমুদ্রের জলে সে পা ভিজিয়ে বসে আছে। পুরো শহরটি এখান থেকে দেখা যাচ্ছিলো, তার তিন দিকে সমুদ্রের পানি, একটু দূরে সমুদ্রে মাথা উঁচিয়ে আছে বেশ বড় একটা পাথর, অপূর্ব!
গারাচিকো খুব ছোট্ট শহর। টেনেরিফের উত্তর উপকূলে অবস্থিত, জনসংখ্যা মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার। ১৭০৬ সালে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে পুরো শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপর সে আবার দুর্যোগ কাটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়। অগ্ন্যুৎপাতে ধ্বংস হওয়ার আগে এই শহর ছিল খুবই ব্যস্ত বন্দরনগরী। যেখান থেকে পৃথিবীর বহু দেশে ওয়াইন রপ্তানি হতো। এখন এর মূল উপার্জন ট্যুরিজম আর সামুদ্রিক মাছ বিক্রি। সান্টিয়াগো আমাদের দূর থেকেই দেখালো সমুদ্রের ধার ঘেঁষে কিছু প্রবাল পাথরের ছোট দেয়াল প্রাকৃতিক সুইমিং পুল সৃষ্টি করেছে। যা মূল সমুদ্র থেকে সেই জলাশয়গুলোকে পুরোপুরি আলাদা করে রেখেছে।
একই সমুদ্রের কিছুটা অংশ প্রবাল প্রাচীরে বাধা পড়ায় তা আলাদা জলাশয়ের রূপ পেয়েছে। দেখে আশ মিটছিলো না। সান্টিয়াগো তাড়া দিলো। আমাদের আরও দুটো যায়গায় যেতে হবে। আর যাত্রাপথে গারাচিকো শহরের ভেতর দিয়েই আমরা যাবো। যদিও সময়ের স্বল্পতায় সেখানে নামার সুযোগ হবে না। সবাই কফি খেতে ঢুকলাম। সান্টিয়াগো বললো এক ধরনের স্প্যানিশ কফি খেতে যার নাম বারাকুইটো। কফির সঙ্গে লেবু মিশিয়ে এটি তৈরি হয়। তাই নিলাম। এই কফি আবার খেতে হয় সাগর কলার সঙ্গে, এটিই নাকি প্রথা!
কফি আর কলা নিয়ে ক্যাফের কাচে ঢাকা দেয়ালের কাছে বসলাম। ওপারে সাগর তীরের গারাচিকো শহর দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট ব্যস্ত একটা শহর, বাড়িগুলো গায়ে গায়ে লেগে আছে। তিনদিক ঘিরে আছে নীল সমুদ্র, তার ওপর ঝুঁকে আছে আকাশ। প্রকৃতির সঙ্গে কি অদ্ভুত একাত্মতা! কেন জানি রবীন্দ্রনাথের এক গাঁয়ে কবিতাটা মনে গুনগুন করে উঠলো। যদিও গারাচিকোকে দেওয়া হয়েছে শহরের স্বীকৃতি আর এ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল আটলান্টিক মহাসাগর, তবুও কফির কাপে চুমুক দিয়ে অস্ফুটে আওড়ালাম -
‘আমাদের এই গাঁয়ের নামটি খঞ্জনা
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা
আমার নামতো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা। ’
বাংলাদেশ সময়: ০০৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৮
এএ/