ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

জলদস্যুর গুপ্ত গ্রাম মাসকা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫১৭ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৮
জলদস্যুর গুপ্ত গ্রাম মাসকা জলদস্যুর গুপ্ত গ্রাম মাসকা।

ষোল শতকের কথা, সমুদ্র দাপিয়ে বেড়ানো স্প্যানিশ জলদস্যুরা সবার চোখের আড়ালে ছোট্ট একটি বন্দরে তাদের জাহাজ ভেড়াতেন, তারপর লুট করে আনা রাশি রাশি ধনরত্ন নিয়ে কোথায় হারিয়ে যেতেন কে জানে!

সেই ছোট্ট বন্দরটি যেখানে, তার পাশ দিয়ে উঠে গেছে অনেক উঁচু পর্বত। দুর্গম সেই গিরিপথে চলা খুবই কষ্টকর, সাধারণ মানুষের প্রায় অসাধ্য।

কিন্তু সেই গিরিপথ পেরিয়ে পর্বত চূড়ায় আছে ছোট্ট একটি গ্রাম, মাত্র হাতেগোনা কয়েক ঘর লোক বাস করে। বাইরের পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলেও সেই গ্রাম চোখে পড়ে না। এ যেনো বাইরের পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অজানা কোনো কারণে জলদস্যুরা কোনোদিন সেই গ্রামটিতে হামলাও করেননি। জলদস্যুর গুপ্ত গ্রাম মাসকা।  ধারণা করা হয় জলদস্যুরা তাদের লুট করে আনা বিপুল ধনরাশি সেই গ্রামে লুকিয়ে রাখতেন, নিজেরাও গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন আর চুপি চুপি পাহাড় পেরিয়ে লুকানো বন্দরে ভেড়ানো জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন সমুদ্রে।

জলদস্যুরা হারিয়ে গেছেন কালের স্রোতে, পার হয়ে গেছে বহু দিন, কিন্তু সেই গুপ্ত গ্রামটি এখনও টিকে আছে, তার নাম মাসকা, স্পেনের টেনেরিফ আইল্যান্ডের একপাশে পাহাড় ঘেরা উপত্যকায় সে গ্রাম বিছিয়ে আছে অপরূপ সৌন্দর্য আর মন ভোলানো ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে।

বাসে চলতে চলতে যখন ট্যুর গাইডের মুখে মাসকা গ্রামের ইতিহাস শুনলাম, ভীষণ রোমাঞ্চ লাগল তখন। সবে গারাচিকো শহর দেখা শেষ করেছি, ভীষণ সুন্দর সেই সাগরের কোল ঘেঁষা শহরটি এখনও চোখে লেগে আছে। সেই সকাল থেকে যাত্রা শুরু হয়েছে আমাদের, টেইডে পর্বত তথা আগ্নেয়গিরি, গারাচিকো শহর আর পাহাড়ে চড়ার দুর্ধর্ষ অভিযান শেষ করে এখন যাচ্ছি মাসকা গ্রাম দেখতে। আজকের দিনের সর্বশেষ গন্তব্য এটাই। বেলা পড়ে এসেছে , তবে সন্ধ্যা নামতে এখনো দেরি আছে।

মাসকা গ্রামটি ‘টেনো’ নামের এক পর্বত শ্রেণির ওপর অবস্থিত। পর্বতের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে আছে সে গ্রাম।   শৈলশিরার খাঁজে বাড়িগুলো খুব  অদ্ভুতভাবে তৈরি করা হয়েছে। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে পর্বতের চূড়াটি ঠায় দাড়িয়ে আছে, নিচে গিরিখাত। এর ওপর থেকে দূরে আটলান্টিক মহাসাগর দেখা যায়।

খুব ছোট এই গ্রামের লোকসংখ্যা দেড়শ’ জনেরও কম। দশ বছর আগেও এখানে আসতে হলে পায়ে হাঁটা বা গাধার পিঠে চেপে আসা ছাড়া উপায় ছিল না। রাস্তা ছিল ভীষণ দুর্গম। বর্তমানে হাইওয়ে তৈরি করা হয়েছে, অন্যান্য দ্বীপগুলোর সঙ্গে এখন এ গ্রাম সংযুক্ত। তারপরও সেই রাস্তা যথেষ্ট ভয়ংকর, কেনো তা একটু পরে বলছি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এ গ্রাম ৬৫০ মিটার মানে প্রায় দুই হাজার ২০০ ফুট উপরে অবস্থিত।

টেনেরিফ দ্বীপ পুরোটাই আগ্নেয়গিরির লাভায় সৃষ্টি, ছোট বড় অনেক পাহাড় পর্বত ছড়িয়ে আছে এখানে। আজ সারাটা দিন পাহাড়ে পাহাড়েই ঘুরেছি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে বাসযাত্রার যে লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা হয়েছে তা ভুলবার নয়, কিন্তু সে অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হতে কিছু বাকি ছিল, মাসকা যাত্রা করার কিছু পরেই তা বোঝা গেল। শর্মিষ্ঠা পণ্ডিতখাড়া পাহাড়ি পথ এঁকেবেঁকে চলেছে, একপাশে গভীর গিরিখাত। রাস্তার বাঁকগুলো এত সূক্ষ্ম যে ওপাশ থেকে গাড়ি আসছে কি না, তা আগে থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই, পর্বতের শরীরকে পেঁচিয়ে রাস্তা বানানো হয়েছে। তাই খুব বেশি প্রশস্ত বানানো যায়নি। ওপাশ থেকে যতবার গাড়ি আসছিল, আমাদের বাসকে থেমে যায়গা দিতে হচ্ছিল। দু’টো গাড়ি একসঙ্গে পার হওয়ার মতো প্রশস্তও নয়। কখনও রাস্তা একেবারে খাড়া, সেখানে বাস ওঠার সময় প্রায় চিত হয়ে যাচ্ছিলাম আমরা। রাস্তার বাঁক পেরোনোর সময় কি যে ভয় লাগছিল, তা বলার নয়। আমাদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ট্যুর গাইড সান্টিয়াগো বললো ‘তোমরা ভয় পেয়োনা, আমাদের ড্রাইভার যথেষ্ট অভিজ্ঞ, প্রায় প্রতিদিনই সে এই রাস্তায় ট্যুরিস্টদের নিয়ে আসে’। তারপরও এমন রাস্তায় যাদের চলার অভ্যাস নেই, তাদের এখানে ঘাম ছুটে যেতে বাধ্য।

কিন্ত সেই পথের দু’পাশের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যাচ্ছিল। সবুজ চারদিক, সাইপ্রেস গাছ আর ফণীমনসা ঝোপ প্রচুর। বাড়িঘর কিছু চোখে পড়লনা। উঁচু রাস্তা থেকে নিচে বিছিয়ে থাকা সবুজ প্রকৃতি আর দূরের নীল সাগর দেখে মন কেমন করে উঠে। কখনও বাস রাস্তার সূক্ষ্ম বাঁকে কাত হয়ে চলছিল, জানালার ওপরে কাত হয়ে যাচ্ছিলাম আর চোখে পড়ছিল নিচের গিরিখাত। কোনো কারণে বাস নিয়ন্ত্রণ হারালে সোজা কয়েকশ ফুট নিচে পড়তে হবে আর সেখানে পড়লে বাঁচার সম্ভাবনা নেহাতই কম। তবে এই ভয়ংকর যাত্রার পরে যেখানে এলাম, সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হল এ যাত্রা সার্থক। রাস্তার এপাশ থেকে এতক্ষণে চোখে পড়ল মাসকা গ্রাম। পর্বতের গায়ে গায়ে ঘরবাড়িগুলো লেগে আছে। বাস থামল, সবাই নেমে এলাম। তিনদিকে ঘিরে আছে পাহাড়, মাঝখানে একটা উপত্যকা, সেখানে একটা দু’টো  ঘরবাড়ি, সবকিছু সবুজে ছেয়ে আছে। একটু এগোতেই একটি রেস্তোরাঁ আর স্যুভেনিরের দোকান। তার পেছনে রোদ ঝলমলে পর্বত চূড়া।

...রেস্তোরাঁর সামনে অনেকটা ছড়ানো চত্বর, একপাশে রেলিং দেওয়া। সেখানে দাঁড়ালে পুরো উপত্যকা চোখে পড়ে আর সোজা তাকালে দেখা যায় সুনীল সমুদ্র। সেই চত্বর থেকে একটি রাস্তা সোজা নেমে গেছে, আরেকটা রাস্তা বাঁ দিকে গেছে। ট্যুরিস্টরা যে যার মতো ঘুরছে, ছবি তুলছে। আমি বাঁ দিকের রাস্তা ধরে কিছুটা এগোলাম, অসমতল পাথুরে রাস্তা। কিছুটা গিয়ে দেখলাম একটি ছোট্ট চার্চ, তার সামনে একটা ইট বাঁধানো চত্বর। আর দু’তিনটা বাড়ি। বোঝা যায় বাড়িগুলো ইদানিং তৈরি হয়েছে। কয়েক ধাপ সিঁড়ি ভেঙে চত্বরে নামলাম। চারপাশে পাহাড়, ছায়া নেমেছে পুরো উপত্যকা জুড়ে। সাইপ্রেস গাছের সারি আর ঢেউ খেলানো পাহাড়, পাহড়ের খাঁজের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ে একটি দু’টো বাড়ি।

এতক্ষণে বুঝলাম একে গুপ্ত গ্রাম কেনো বলে! পর্বতের ভাঁজে ভাঁজে বাড়িগুলোকে যেনো বসিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই দূর থেকে চোখে পড়েনা।

মাসকা গ্রাম টেনেরিফ দ্বীপের সবচেয়ে পুরোনো জায়গাগুলোর একটি। এই সবুজ প্রকৃতি, গিরিখাত, শৈলশিরাময় অদ্ভুত ভৌগলিক বৈচিত্র্য মিলিয়ন বছর আগেকার আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফল। ২০০৭ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল টেনেরিফে, পুড়ে গিয়েছিল মাইলের পর মাইল পাইন গাছের বন, মাসকা গ্রামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আস্তে আস্তে গ্রামবাসী সেই ক্ষতি সামলে উঠে।

ট্যুরিজম এই গ্রামের অধিবাসীদের প্রধান উপার্জনের পথ। সারা বছর পৃথিবীর নানা দেশের ট্যুরিস্ট এখানে বেড়াতে আসে। এই গ্রামকে ইউরোপের মাচু পিচু বলা হয়। ট্যুর গাইড বলল এ গ্রামের মানুষ এখনও জাদুবিদ্যা আর নানা রকম কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। আধুনিকতার ছোঁয়া এখানে খুব বেশি লাগেনি। এখান থেকে ঘণ্টা তিনেক পাহাড় বেয়ে নেমে গেলে সাগর তীরে যাওয়া যায়, যেখানে অতীতে জলদস্যুরা জাহাজ নিয়ে আসতেন।

আমাদের হাতে সময় কম ,তাই খুব বেশি কিছু দেখা গেলনা এবার, দূর পর্বতের পেছনে সূর্য ডুবছে, আকাশের একপাশে কমলা রঙ, অন্যপাশের পর্বত চূড়ায় সূর্য তার শেষ আলো ছুঁইয়ে যাচ্ছে। অস্তরাগের রঙে চারপাশ মোহময়। আমাদের ফেরার সময় হল। বাসে উঠে গেলাম সবাই।

জানালার পাশে বসে চেয়ে রইলাম মাসকা গ্রামের দিকে। আমাদের তথাকথিত আধুনিক জীবন থেকে এই গ্রাম অনেকটা দূরে, প্রকৃতি এখানে অকৃত্রিম, তাই বুঝি আধুনিক সভ্যতার চাপে হাঁপিয়ে পড়া মানুষগুলো ছুটে আসে এখানে এই প্রকৃতির কোলে শান্তি খুঁজতে। বাস পাহাড়ের বাঁক ঘুরতেই মাসকা গ্রামকে আর দেখা গেলনা, কিন্তু ‘ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়’ ছোট্ট গ্রামটির ছবি আমার চোখে লেগে রইল।

বাংলাদেশ সময়: ১১১২ ঘণ্টা, জুন ২০, ২০১৮
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।