যা একটি সমাজের মানুষের সমন্বিত উদ্যোগে বদলে দেওয়ার অনন্য নজির। গ্রামীণ সৌন্দর্যকে নিংড়ে গড়ে তোলা জিন্দা পার্ক তাই শুধুই পার্ক নয়, এটি একটি সামাজিক কাঠামো।
অবাক করা ব্যাপার হলো- মাত্র ৬৫ টাকা বিনিয়োগ থেকে স্কুল পড়ুয়া কয়েকজন কিশোরের প্রচেষ্টায় শুরু হয় এ উদ্যোগ। যা এখন স্বীকৃতি পেয়েছে সারাদেশে মডেল গ্রামের। গল্পের শুরুটা ১৯৮০ সালের।
রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের জিন্দা গ্রামের স্কুল পড়ুয়া কিশোর তোবারক হোসেন কুসুম একটি আলোকিত গ্রামের স্বপ্ন দেখলেন, সেই স্বপ্নের সঙ্গে যোগ দেন তার চার বন্ধু কাজী নাসিরউদ্দিন, শাহাদৎ হোসেন খোকন, কাজী মাহবুবুল আলম বাবুল ও তাবারক হোসেন আকন্দ।
পাঁচ বন্ধু স্বপ্ন দেখেন অন্ধকারাচ্ছন্ন থেকে আলোকিত করবেন নিজেদের গ্রামকে। লাঘব করবেন সমাজের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা। ওই সময় তারা পাঁচজন সপ্তাহে ১৩ টাকা করে চাঁদা নিয়ে অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর আর তাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাদের ডাকে সাড়া দিতে থাকেন এলাকার আরও অনেকে। এক পর্যায়ে অগ্নিবীণা স্টুডেন্টস ফোরাম নাম বদলে হয় অগ্রপথিক পল্লী সমিতি। সেই পাঁচ কিশোরের দেখা স্বপ্ন অগ্রপথিক পল্লী সমিতির বদৌলতে এখন স্থানীয় ১০ গ্রামের প্রায় ৯ হাজার মানুষ হয়েছে স্বাবলম্বী।
সোমবার (১৬ জুলাই) পার্কটিতে ছিল দেশের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের ঈদ পুর্নমিলনী অনুষ্ঠান। পুনর্মিলনীর আয়োজন হলেও দিনভর বাংলানিউজ পরিবারের সবাই যেন ডুবেছিল পার্কটির সবুজ মোহনীয় সৌন্দর্যে।
ফেরার বেলায় কথা হয় সমিতির সেক্রেটারি আবদুল্লাহ আল শাহীনের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই শোনা যায় বদলে যাওয়া আশা জাগানিয়া এ গল্প।
তিনি জানান, এই এলাকায় আশির দশকে তেমন কোনো রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান ছিলো না। এখন অগ্রপথিক সমিতির সহযোগিতায় জিন্দাসহ আশ-পাশের ১০ গ্রামের মানুষ স্বাবলম্বী। গ্রামগুলোর সমাজ ব্যবস্থা বদলে যাওয়ার পাশাপাশি বদলে গেছে মানুষের ভাগ্যেরও।
নৈসর্গিক ‘জিন্দা পার্ক’
যান্ত্রিক নগরের মানুষগুলো যখন একগুঁয়ে জীবনচক্রে অতিষ্ঠ হয়ে তৃষ্ণার্ত হয়ে যায়; তখন তাদের মন নিমিষেই শীতল হয়ে যাবে জিন্দা পার্কের সবুজ বেষ্টনীর শীতলতায় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সোমবার সকালে বাংলানিউজের সব কর্মী বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মিডিয়া হাউজের সামনে থেকে বাসে প্রায় আধ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যখন পার্কের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিলেন, তখনই এক অন্যরকম শীতলতা আর প্রশান্তি মোহিত করছিল সবাইকে।
পুরো পার্কজুড়ে চেনা-অচেনা শতশত প্রজাতির গাছ, সুবিশাল লেক আর পাখির কলতানে মোহনীয় করে তুলেছে সবাইকে। পার্কের দায়িত্বে থাকা অগ্রপথিক পল্লী সমিতির সেক্রেটারি আবদুল্লাহ আল শাহীন জানালেন, এখানে ২৫০ জাতের প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি গাছ রয়েছে।
বাংলানিউজ কর্মীদের খাবার এবং বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হয়েছিল বকুল তলা সংলগ্ন একটি টিনশেড ছাউনির নিচে। কাঁধের ব্যাগটি রেখে হাঁটতে হাঁটতেই চোখে পড়লো আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, সফেদা, লিচুসহ নানা রকম ফলের গাছ।
চোখ জুড়ায় দেশি-বিদেশি প্রজাতির বাহারি রঙের ফুল গাছও। অন্যরকম অনুভূতি এনে দেয় পার্কের ভেতরের লেকের মাঝখানের টিনের ছাউনির ঘরে বয়ে যাওয়া বাতাস।
লেকের পাড় ধরে হাঁটতেই চোখে পড়লো এক পাল ভেড়া মনের আনন্দে ঘাস খাচ্ছে। কিছুটা দূর হেঁটে যাওয়ার পর কানে ভেসে এলো পাখির কিচির- মিচির। তাকিয়ে দেখা যায় হলুদিয়া পাখি। অনেক চেষ্টায় তাকে ক্যামরাবন্দি করা গেলেও কোকিলটাকে আর আটকানো যায়নি। পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে প্রায় কয়েকশ’ প্রজাতির পাখি আছে। শীত মৌসুমে অতিথি পাখিও আসে এখানকার লেকে।
লেকের পাশের গাছের উপর টং ঘরে উঠলে তো আর নামতেই মন চায় না। দখিনা বাতাসে নিমিষেই চোখে নেমে আসতে পারে শীতলতার ঘুম।
পুরো পার্কে রয়েছে পাঁচটি লেক, এ কৃত্রিম লেকগুলো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে পার্কটির শোভা। রয়েছে লেকের মাঝখানে সুসজ্জিত বাংলো। ইচ্ছে যদি হয় লেকের স্বচ্ছ জলে কিছুটা সময় ভেসে বেড়াবেন, তারও ব্যবস্থা আছে এখানে।
লেকের পাড়েই বাঁধা আছে রঙিন নৌকো। পার্কের পুরো ৫০ একরকেই মনে হবে সবুজে মোড়ানো সাজানো ক্যানভাস।
পার্কের সবুজের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ বনের আড়ালে চোখে পড়বে পাঁচতলা ভবনের কারুকার্য খচিত দারুণ স্থাপত্যের লাইব্রেরি। কিছুটা সময় সেখানে বসে বইয়ের মাঝেও ডুবে থাকতে পারেন দর্শনার্থীরা।
বিকেলে পাঁয়চারি করতে করতেই চোখে পড়লো মানবিক ঐশ্বর্য বিদ্যাপীঠ। দারুণভাবে সাজানো হয়েছে স্কুলটিকে।
সুবিশাল মাঠ দেখে সহকর্মীরা যেন ফুটবল নিয়েই মাঠে নেমে যেতে চাইছিলেন। পার্কের ভেতরেই রয়েছে একটি সুদৃশ্য মসজিদ। দারুণ কারুকার্য ও আধুনিক স্থাপত্য দেখে দর্শণার্থীরা প্রত্যেকেই মুগ্ধ।
রিসোর্টে রয়েছে খাবার রেস্তোরাঁ। সবুজ বনানীতে ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি পার্কের মহুয়া স্ন্যাকস অ্যান্ড মহুয়া ফুডস রেস্টুরেন্ট থেকে কিছু খেয়েও নিতে পারেন দর্শনার্থীরা।
পুরো পার্কটি এক কথায় দুর্দান্ত। পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ঘোরার জন্য ঢাকার কাছে অন্যতম ছায়া-সুনিবিড় স্পট বলা যেতে পারে জিন্দাপার্ককে।
পার্কের ভেতরে প্রবেশের জন্য জনপ্রতি ১০০ টাকা খরচ করতে হবে। নিজস্ব গাড়ি পার্কিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সপ্তাহের সাতদিনই পার্কটি খোলা থাকে। মাগরিবের আজানের পর পার্কে থাকা নিষেধ।
পরিচালনার দায়িত্বে থাকা আবদুল্লাহ আল শাহীন বলেন, দেশ ও জাতির প্রয়োজনে একটি আদর্শ সমাজের রূপরেখা যেন সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে তার জন্য সরকারের উচিৎ উদ্যোক্তাদের পাশে থাকা। পার্কের স্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা করা।
যেভাবে যাবেন
পার্কের অবস্থান নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ। পূর্বাচল ৩০০ ফিট রাস্তায় কুড়িল বিশ্বরোড থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা দিয়ে যাওয়া যাবে। সময় লাগতে পারে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। এখান থেকে নারায়ণগঞ্জের বিআরটিসির বাসও চলাচল করে।
অন্যভাবে যেতে চাইলে ঢাকার উত্তরা হয়ে টঙ্গী ফ্লাইওভার পার হওয়ার পর কাঞ্চন ব্রিজের দিকে যে রাস্তা গেছে সেটি দিয়েও যাওয়া যাবে জিন্দাপার্কে।
বাংলাদেশ সময়: ১৯২৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৮
এসএইচডি/এমএ