যেই ভাবা সেই কাজ, ‘ঘুরতে থাকা চিল’-এর ১২ সদস্য ঢাকা থেকে মেইল ট্রেনে করে প্রথমে চলে গেলাম সীতাকুণ্ড। সেখান থেকে ট্রেইল ধরে হাঁটতে শুরু করলাম বারবকুণ্ড তীর্থধামের দিকে।
এ মন্দিরের একটা কুয়োতে সারা বছরই আগুন জ্বলতে থাকে। মন্দির ঘুরে একটু সামনে এগিয়ে একটা পাহাড়ে উঠলাম। সেখান থেকে মন্দিরের পুরোটাই দেখা যায়। স্থাপনাটি অনেক পুরনো হওয়ায় কিছু কিছু স্থানে ভাঙা। মন্দিরভর্তি তীর্থে আসা লোকজন। দূর থেকে লোকজন এসেছে তীর্থ করতে। কেউ পূজা করছিলেন আবার কেউ বিশ্রাম নিচ্ছিলেন।
কিছুক্ষণ পর আমরা আবার ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে শুরু করলাম পরবর্তী গন্তব্য ঝরঝরি ঝরনার উদ্দেশ্যে। গ্রামের রাস্তা শেষে ঝিরিপথ আর পাহাড়। সেগুলো পেরিয়ে যেতে হবে আমাদের ঝরঝরি ট্রেইলে। স্থানীয় একজনকে গাইড হিসেবে নিলাম। পাহাড়ে উঠছি আবার নামছি। একটানা অনেক উঁচু পাহাড়ে উঠতে গিয়ে সবাই হাঁপিয়ে উঠছিলাম। ঝিরিপথ আর পাহাড় ডিঙিয়ে একসময় চলে এলাম ঝরঝরি ঝরনার কাছে। তখন পানি খুবই কম। ঠাণ্ডা পানিতে সবাই গা ভিজিয়ে নিলাম। পাশের আপস্ট্রিমে গিয়ে সবাই একটু বিশ্রাম নিয়ে ফেরার জন্য তৈরি হলাম।
হাদি ফকিরের হাটের কাছে এক ঝিরির পাশে আমাদের ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত হল। সবাই মিলে তাবু সেট করলাম। এইখানে তাবু করার মূল কারণ পরবর্তী গন্তব্য সোনাইছড়ি এ পথ ধরেই যেতে হবে। আমাদের ভ্রাম্যমাণ আবাসস্থল দেখতে এসেছিলেন কিছু স্থানীয়। খোলা জায়গায় এভাবে আমরা থাকবো দেখে অবাক তারা। মেহেদী নামের স্থানীয় এক ছেলের শুরু থেকেই আগ্রহী আমাদের ব্যাপারে। সোনাইছড়ি চেনার কারণে ওকেই গাইড হিসেবে নিয়ে নিলাম আমরা।
কাজ শেষে রাতে বারবিকিউ করার জিনিসপত্র কিনতে আমরা ৬ জন গেলাম বাজারের উদ্দেশ্যে। বাকিরা তাবুতে বিশ্রাম নিচ্ছিলো। বাজার করে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা বেজে গেল।
বাজার আনার পর বাঁধল আরেক সমস্যা। বারবিকিউর মসলা মাখানোর জন্য কোনো পাত্র ছিল না আমাদের সঙ্গে। মেহেদী ওর বাসা থেকে একটা গামলা এনে দিলো আমাদের। পাশের ঝিরি থেকে পানি নিয়ে মুরগি ধোয়া হল, মশলা মাখানো হলো।
আগুন জ্বালানোর জন্য তৈরি করা হল মাটির চুলা। বাজার থেকে আনা হয়েছে কেরোসিন ও লাকড়ি। কিন্তু এরপর বাঁধল আরেক বিপত্তি। ওই চুলাতে কিছুইতে আগুন জ্বালানো সম্ভব হচ্ছিল না আমাদের পক্ষে। সবাই মিলে অনেকক্ষণ চেষ্টা চালালাম। কিন্তু প্রচণ্ড বাতাসে বারবারই আগুন নিভে যাচ্ছে।
আমাদের ক্যাম্প থেকে একটু দূরে বাড়িতে দেখালাম আলো জ্বলছে। তাদের কাছে গিয়ে অনুরোধ করলাম তাদের রান্নাঘর ব্যবহার করার জন্য। তারা অন্তরিকতার সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। পুড়তে শুরু আমাদের বারবিকিউ।
বারবিকিউ যখন শেষ হ্ল তখন প্রায় মধ্যরাত। বাজার থেকেই আমরা পরোটা নিয়ে এসেছিলাম। চাঁদনী রাতে সবাই মিলে নিজেদের করা বারবিকিউর অসাধারণ স্বাদ নিলাম। সারাদিনের ট্র্যাকিংয়ের ক্লান্তিতে শরীর আর নিতে পারছিলো না। পায়ের জয়েন্টে প্রচণ্ড ব্যথা করছিলো। দাঁড়াতে পারছিলাম না। তাবুর মধ্যে ঘুমিয়ে পরলাম। শেষ রাতে দিকে আবহাওয়া অনেক ঠাণ্ডা হয়ে এসেছিল।
খুব ভোরে সূর্যের আলোয় ঘুম ভেঙে গেল। বিশ্রামের কারণে শরীরের ব্যাথা কিছুটা কমেছে। ঝিরির পানিতে ফ্রেশ হয়ে তাবু গুছিয়ে নিলাম। স্থানীয় এক হোটেলে সকালের নাস্তা করে আমাদের গাইড মেহেদীকে নিয়ে পা বাড়ালাম সোনাইছড়ির দিকে।
ট্রেইল ধরে কিছুক্ষণ আগানোর পরেই চোখে পরলো বড় বড় পাথর। পাথর গুলো এতো বড় আর পিচ্ছিল যে পাথরের উপরে একজন উঠে অন্যদের সাহায্য করতে হলো। এভাবেই বড় বড় পাথর পার হয়ে এগিয়ে চলতে থাকি আমরা। পথে পড়ল বাইজ্জাখুম। দু’টো পাহাড়ের মধ্যে ১৫০ ফুটের গিরিখাদ, ভেতরে অসংখ্য বাদুর। খাড়া পাহাড়, বড় বড় পাথর আর ঝিরিপথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম সোনাইছড়িতে।
ঝরনার ঠাণ্ডা জলে কিছুক্ষণ গা ভিজিয়ে ফেরার পথ ধরি। ঢালের ঢালা নামে পরিচিত এক রুক্ষ খাড়া পাহাড় বেয়ে আমাদের নামতে হলো। জোঁক আর চুলকানো পাতা আমাদের যাত্রা আরও কঠিন করে তোলে। পথের একটি স্থান থেকে দূরের সমুদ্র দেখা যাচ্ছিলো।
হাদি ফকিরহাট থেকে লেগুনা নিয়ে চলে গেলাম বাঁশবারিয়া বিচে। তাবু সেট করা হল। বিচের ঠাণ্ডা বাতাসে সবাই বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো চারপাশ। সবুজ গালিচার মাঝে মাঝে পানিভর্তি প্রাকৃতিক বাথটাবের মধ্যে খেলা করছে ছোট ছোট মাছ। চারপাশ অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যা নেমে এলে রোমাঞ্চকর ট্যুরের ইতি টেনে ফিরে চলতে শুরু করি ঢাকার উদ্দেশ্যে।
বাংলাদেশ সময়: ১০১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৩, ২০১৮
এনএইচটি/এসএইচ