শিল্পনগরী খুলনা জেলার ৭৪টি প্রত্নস্থলের মধ্যে একটি হলো এ জোড়া শিবমন্দির। এই মন্দির শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত।
খুলনা রেলস্টেশন এলাকার বিআইডব্লিউএ ভবনের উত্তর দিকের অনতিদূরে রিকশায় কিংবা পায়ে হেঁটে গেলে সহজেই চোখে পড়ে ৫ নম্বর ঘাট। রাস্তার পশ্চিম পাশেই অবস্থিত ঐতিহাসিক জোড়া শিবমন্দির। এখানে পাশাপাশি দু’টি পূর্বমুখী মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। দু’টি মন্দিরই একই আকৃতির। মন্দির লাগোয়া পশ্চিম পাশে রয়েছে বিশাল আকৃতির প্রায় ৫শ’ বছরের পুরনো জোড়া বটগাছ।
সরেজমিনে দেখা গেছে, অবকাঠামোগত সৌন্দর্য ও সনাতন ধর্মের ঐতিহ্যের কারণে অনেকটা ছায়াঘেরা এ মন্দিরের বটবৃক্ষের নিচে মানুষ বিশ্রাম নিচ্ছে। কেউ কেউ জোড়া বটবৃক্ষের নিচে পূজা করছেন। পেছনের গেট থেকে এসে অনেকে মন্দির এরিয়ার টিউবওয়েল থেকে পানি নিচ্ছেন। মন্দিরের পাশে পুরোহিতের থাকার ঘর রয়েছে। জোড়া শিবমন্দিরের তিনটি গেট ও চারপাশে প্রাচীর রয়েছে। বর্তমানে মন্দির দু’টির মধ্যে কালো পাথরে নির্মিত দু’টি শিবলিঙ্গ আছে। মন্দিরের দেয়ালে লেখা রয়েছে প্রতিষ্ঠাতার নাম কৃষ্ণ রামবসু, ১১০৪ বঙ্গাব্দ। একইসঙ্গে দেওয়ালে জোড়া শিবমন্দিরের দাতাদের তালিকা রয়েছে।
জোড়া শিবমন্দিরের প্রতিটির বৈশিষ্ট্য অপরিসরের বর্গাকার মূর্তিকোঠা, কৌণিক খিলান-দরজা, বাঁকা কার্নিস, আট চালাকার শিখর এবং পলেস্তারা ও চুনকাম করা দেয়াল। ভেতরের পরিমাপ ২.৮৫ মি./৯’-৪” ও ২.৮৫ মি./ ৯’-৪” এবং বাইরের পরিমাপ ৪.৬০ মি./১৫’-১” ও ৪.৬০ মি./১৫’-১” । প্রতিটি খিলান-দরজার ওপর ফলক স্থাপনের উপযোগী শিল্পভূমি রয়েছে। মন্দিরের কার্নিসের নিচের দু’সারি খোপে নকশা শোভা পাচ্ছে। মন্দিরের চূড়ায় বাকসাকার হর্মিকা থেকে একটি শীর্ষদণ্ড বেরিয়ে আছে। গাঁথুনির ইটের আকার বেশ ছোট এবং মসলা হিসেবে চুনমিশ্রিত ইটের গুঁড়া ব্যবহৃত হয়েছে।
মন্দিরের পুরোহিত বিশ্বজিৎ কাঞ্জিলাল ভোলা বাংলানিউজকে বলেন, আমার বাবাও এখানে পুরোহিত ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর আমি দায়িত্ব পালন করছি। মন্দিরের বয়স ৩২১ বছর হয়েছে। মন্দিরের ভেতর দুই বিঘার মতো জায়গা আছে।
মন্দিরের এরিয়ার মধ্যে একটি ঘের ছিলো। আওয়ামী লীগের এক নেতা ঘেরটি দখল করে নিয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
তিনি জানান, এই জোড়া শিবমন্দির খুলনার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দির। মন্দিরের পাশের জোড়া বটগাছটির বয়স প্রায় ৫শ’ বছর। কথিত আছে বটগাছ দু’টির একটি স্বামী ও অপরটি স্ত্রী।
মন্দিরের পুরোহিতের স্ত্রী রুনা কাঞ্জিলাল বাংলানিউজকে বলেন, এখানে কালীপূজা, মনসা পূজা, স্বরসতী পূজা ও চৈত্র মাসের শেষ সোমবার পূজা হয়। শিব চতুর্দশীতে শিবের মাথায় জল ঢালা হয়। দেশি-বিদেশি প্রচুর পর্যটক ও পূণ্যার্থী পূজার সময় আসেন।
তিনি জানান, যেখানেই জোড়া শিবমন্দির আছে প্রায় জায়গায়ই জোড়া বটগাছ আছে। তাদের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে দেওয়া হয়।
মন্দির এলাকার শিখা দত্ত বলেন, ৩২১ বছরেরও বেশি পুরনো এ মন্দির যেন আজও তার স্বাক্ষর বয়ে বেড়াচ্ছে। প্রতিদিনই ভক্ত-দর্শনার্থী দূরদূরান্ত থেকে এখানে আসেন। শিব চতুর্দশীতে এ মন্দিরে ধুমধাম করে পূজার্চনা করা হয়।
স্থানীয়রা জানান, খুলনার শীর্ষ সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের সময়কালে জোড়া শিবমন্দির তিনি দখল করে আস্তানা করেন। ভয়ে তখন মন্দিরে কেউ আসতেন না। এক পর্যায়ে মন্দির দু’টি পরিত্যক্ত হয়। সেখানে পূজার্চনা, নামযজ্ঞ, কীর্তন, ধর্মীয় শোভাযাত্রাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৫/১৬ বছর ধরে এ অবস্থা চলতে থাকে। এরশাদ শিকদারের ফাঁসির পর ২০০২ সালে খুলনা শহরের তৎকালীন মেয়র শেখ তৈয়বুর রহমান মন্দিরের পাশেই একটি নলকূপ স্থাপনসহ ২০০৩ সালে মন্দির সংস্কার করে নামফলক স্থাপন করেন।
প্রত্নস্থলের বিভিন্ন তথ্যাদির আলোকে জানা গেছে, ১১০৪ বঙ্গাব্দে শ্রী কৃষ্ণরাম বসু জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর স্বর্গীয় মূলচাঁদ মুন্ধড়া ও মাতৃদেবী স্বর্গীয়া আনচা দেবীর স্মরণে শ্রী শিবকৃষ্ণ মুন্ধড়া দু’টি শিব বিগ্রহ প্রদান করেন। পরে কে বা কারা মূর্তি দু’টি অন্যত্র নিয়ে গেলে একজন রেলওয়ে কর্মকর্তার স্ত্রী কাশী থেকে পাঁচটি মূর্তি এনে সেখানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেগুলো না থাকলেও দু’টি পাথরের মূর্তি এখনও আছে।
মন্দিরটি প্রসঙ্গে খুলনার আঞ্চলিক ইতিহাস লেখক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী বলেন, জোড়া শিবমন্দির বাংলা ১৩৪৩ সালে স্থাপন করেন বলদেব আগরওয়ালা নামের এক মাড়ওয়ারি। আবার কেউ কেউ দাবি করেন দেওয়ান শ্রীকৃষ্ণ রামবসু নামে এক ব্যক্তি বাংলা ১১০৪ সালে এ দু’টি নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে মন্দির দু’টির মধ্যে কালো পাথরে নির্মিত দু’টি শিবলিঙ্গ আছে।
কবি ও লেখক এ কে আজাদ বলেন, মন্দির দু’টির উত্তর দিকে একটি বিশাল দীঘি ছিল। দীঘিতে এক সময় শান বাঁধানো ঘাট ছিল। জনশ্রুতি আছে, বাংলা ১৩৪৩ সনে জনৈক বলদেব আগরওয়ালা নামে একজন মাড়োয়ারি এ স্থানটিতে একটি বাগান নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে বাগানটির কোনো চিহ্ন নেই। তাছাড়া ১৮৮০ সালে খুলনা রেলওয়ে স্টেশন তৈরির সময় সংলগ্ন দীঘিটির একাংশ ভরাট করে ফেলা হয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে মন্দির লাগোয়া জমিতে একটি পাঠশালা ছিল বলেও জানা গেছে। কিন্তু এখন সেই পাঠশালার কোনো অস্তিত্ব নেই।
আরও জানা গেছে, জোড়া শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার পর থেকে শিবরাত্রি উপলক্ষে আট দিনব্যাপী বিশাল মেলা বসতো এই মন্দির প্রাঙ্গণে। কিন্তু ১৯৬৪ সালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার পর থেকে মেলার আয়োজন বন্ধ হয়ে যায় এবং দু’টি মন্দিরই দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকে।
বাংলাদেশ সময়: ১১৩২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০১৮
এমআরএম/আরআর