রুহুল ভাইয়ের ফার্ম হাউজে গিয়ে আমাদের অভিভূত হওয়ার পালা যেন শেষই হচ্ছিলো না। এক ভোরে বাকি সবাইকে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলেই বেরিয়ে পড়ি গ্রাম ঘুরতে।
বিদেশে পাড়ি জমানো এই গ্রামের অনেক মানুষেরই স্বপ্ন। লন্ডন নামের শহরটিকে যেন তাদের কল্পনায় স্বর্গের সমপর্যায়ে। গ্রামে ওই লন্ডন প্রবাসীর জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। আর প্রবাসীর যে আত্মীয় এসব জমির দেখভাল করেন, তার দাপটও অন্যরকম। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে 'লন্ডনি জামাই' পাওয়া যেন সাত রাজার ধন। যেচে কথা বলতে আসা এক বৃদ্ধ জানালেন, তার তিন মেয়েরই বিয়ে হয়েছে লন্ডন প্রবাসীর সঙ্গে। তার বংশধরদের কেউই এখন আর এই দেশে থাকেন না। বৃদ্ধ স্ত্রীকে নিয়ে তিনি এই গ্রামে একাকী থেকে গিয়েছেন ছেলে-মেয়েদের পাঠানো রেমিটেন্সের টাকায় পারিবারিক সম্পত্তির পরিমাণ কেবলই বাড়ানোর দায়িত্বে। তবে এখানে নিম্ন আয়ের লোকেদের চিত্র ভিন্ন। কেউ বহু কষ্টে ধারদেনা করে বড়জোর একটা দোকান তুলতে অথবা ইজিবাইক কিনে চালাচ্ছেন। এ ধরনের পেশার লোকগুলোর কথাবার্তা কেমন যেন নিরাশাবাদীদের মতো শোনায়। এই ‘মরার গ্রামে’ এসব পেশায় আয়-রোজগার তেমন একটা হয় না বলেই তাদের দাবি। আবার দেখা যায় আয় যা হচ্ছে প্রায় সবটাই চলে যাচ্ছে পুরনো ঋণ শোধ করতে গিয়ে। তাদের চোখে বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্ন। লন্ডন প্রবাসীদের মতো তারাও একটা পাকা ঘর অথবা 'কংকাল' নির্মাণ করতে চায় এই গ্রামে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে লন্ডন পৌঁছানো সম্ভব হয় না। একজন আবার জানালেন, এক লন্ডন প্রবাসীর কাছে নিজের শেষ সম্বল বলতে কিছু জমি বিক্রি করে কুয়েত পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু কয়েক মাস পর কোনো এক কারণে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় ওই দেশের সরকার। এতো কষ্টের পর বিদেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেও আবার তাকে দেশে ফেরত পাঠানোর কারণটা বলতে তিনি বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছিলেন, তাই তাকে নিয়ে আর ঘাঁটালাম না।
গ্রামে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা অনেক। হয়তো কোনো লন্ডন প্রবাসীর জমি অথবা প্রবাসীদের আত্মীয়ের ক্ষেতে চুক্তি বা বেতন ভিত্তিতে কাজ করেন তারা। আর এদিকটায় বিভিন্ন জাতের ধানের চাষই হয় বেশি। দিগন্তের যতদূর চোখ যায় কেবল ধানের রাজ্য। সকালের চা-নাস্তা খেয়ে কয়েকটি পাতার বিড়ি পকেটে ভরে নেমে যাই ওই সোনালি সমুদ্রে। চলছিল ধান কাটার মৌসুম। মাঠের একটু ভেতরের দিকে সারিবদ্ধ হয়ে দক্ষতার সঙ্গে দ্রুত হাতে ধান কাটছে একদল কৃষক। কোনো কোনো জাতের ধান আগেই কেটে নেওয়া হয়েছে। মাঠের বেশিরভাগ জায়গা দখল করে সবুজে-হলুদে মেশানো ধানের সারি। এ জাতের ধানগুলো কাটা হবে পুরো ডিসেম্বর জুড়ে। ধানের ঢেউয়ের মাঝ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একসময় দেখা হয় ধান চাষি সিদ্দিকুরের সঙ্গে। নিজের জমি না থাকলেও বহু বছর ধরে এই ধান ক্ষেতটিই তার কর্মক্ষেত্র, জীবন-জীবিকা। কাজের ফাঁকে আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে এগিয়ে এলেন তিনি। খুবই আন্তরিক ব্যবহার পেলাম তার কাছ থেকে। নিজ থেকেই দেখালেন কতোটুকু জমিতে এবার তার হাতে ধান ফলেছে।
জানালেন, এবছর ধানের ফলন অনেক ভালো। ২৮, ২৯ ও চিনিগুঁড়া এই তিন জাতের ধান ফলেছে এবার তার হাতে।
ধানক্ষেতে কাজ করতে আসা প্রত্যেককেই খুব হাসিখুশি-আন্তরিক বলে মনে হলো। বিদেশে পাড়ি জমানোর স্বপ্নে 'জাগ্রত' যে মানুষগুলোর সঙ্গে একটু দেখা হয়েছিল, তাদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি সুখী বলে মনে হলো এই কৃষকদের। হতে পারে, তাদের পক্ষে বিদেশ যাওয়া কখনও সম্ভব না বলেই হয়তো ধরে নিয়েছেন এই কৃষকরা অথবা নিজেদের 'চাষা' পরিচয়টি অপমানজনক বলে মনে হয় না তাদের কাছে।
ধান কাটার মৌসুমে সবারই মনমেজাজ খুব ভালো। খুবই আন্তরিক ব্যবহার করলেন সবাই। এক হাতে লাঠি অন্য হাতে ছাতা নিয়ে ধানক্ষেত পাহারা দিচ্ছিলেন শফিকুর নামের এক যুবক। রোদ-বৃষ্টি-ঝড়ে ধানক্ষেত পাহারা দিয়েই তার আয় রোজগার। নিজের কাজ নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে দেখা গেলো না তাকে। সম্প্রতি বিয়ে করে সুখেই কাটছে তার দিনকাল।
শহুরে জীবন অসংখ্য বৈচিত্র্যময়, সেটা প্রায় সবাই স্বীকার করবে। এদিক থেকে পিরের গাঁও যেন একদমই গতিহীন, একঘেঁয়ে এবং জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে। কিন্তু এই গ্রামের ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনগুলো বৈচিত্র্যময়তার যেন এক ভিন্ন সত্তা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৮
এএ