মুর্শিদাবাদে ১৭শ ও ১৮শ শতকের বিভিন্ন স্থাপনা এখনো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। নবাব আলীবর্দী খাঁ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবর-সমাধি এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থাপনাও রয়েছে সেখানে।
হাজার দুয়ারী প্যালেস
মুর্শিদাবাদে ভ্রমণে গেলে প্রথমেই নজর কাড়ে হাজার দুয়ারী প্যালেস। ১৮২৯ সালে ইতালীয় স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন হাজার দুয়ারী প্যালেস নির্মাণ করেছিলেন মীর জাফরের পঞ্চম বংশধর নবাব হুমায়ুন ঝাঁ। বহু দরজাবিশিষ্ট হওয়ায় এর নামকরণ করা হয় ‘হাজার দুয়ারী প্যালেস’। শ্রুতি আছে, এই প্যালেসে এক হাজার একটি দরজা আছে। পরবর্তীতে হাজার দুয়ারী প্যালেস হাইকোর্ট হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে এটি একটি মিউজিয়াম। এই প্যালেসের প্রতিটি কক্ষের কারুকার্য অত্যন্ত মনোরম। এক তলায় অস্ত্রাগার, অফিস, কাছারী, রেকর্ড রুম ইত্যাদি আছে। অস্ত্রাগারে ২৬০০ অস্ত্র সজ্জিত আছে। এছাড়াও ইতিহাসের সাক্ষী অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। হাজার দুয়ারী প্যালেস শুক্রবার বন্ধ থাকে। সিরাজ মদীনা
বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার একমাত্র স্মৃতি বিজড়িত স্থাপনা ‘সিরাজ মদীনা’। ছোট্ট ‘সিরাজ মদীনা’র অবস্থান হাজার দুয়ারী প্যালেসের বিশাল চত্বরের ঠিক মাঝখানে।
কথিত আছে, সিরাজউদ্দৌলার মা আমিনা বেগম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সিরাজ মসনদে বসলে মসজিদ বানাবেন। মায়ের প্রতিজ্ঞা পূরণে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মদীনার কারবালা থেকে মাটি এনে তৈরি করেন সিরাজ মদীনা। ছোট্ট সিরাজ মদীনা সবসময় বন্ধ থাকলেও খুলে দেওয়া হয় মহররমের দিন।
৫ গম্বুজ বিশিষ্ট সিরাজ মদীনার চারপাশ হাজার দুয়ারী থেকে আলাদা করতে মাটিতে ইটের বেষ্টনী দেওয়া আছে। স্থানীয় গাইডরা সিরাজ মদীনার ইটের বেষ্টনীতে প্রবেশ করে বেশ নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলেন, এই আমি, স্বাধীন বাংলায় নবাব সিরাজের জায়গায় প্রবেশ করলাম। বেরুলেই পায়ে পরবো শিকল, হবো পরাধীন, ইংরেজদের দাস। এই সিরাজ মদীনা ছাড়া মুর্শিদাবাদে নবাব সিরাজের আর কোনো স্মৃতি নেই। বাচ্চাওয়ালী কামান
বাচ্চাওয়ালী কামানের বিশেষ বিশেষত্ব হলো এটি নির্মিত হয় বাংলার তৎকালীন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে। এর নামকরণের পেছনেও রয়েছে বিশাল ইতিহাস।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার হাজারদুয়ারী প্যালেস চত্বরে দর্শনার্থীদের জন্য সংরক্ষিত এই কামানটির দৈর্ঘ্য ১৮ ফুট, ওজন ১৬ হাজার ৮৮০ পাউন্ড। ১৬৪৭ সালে তৎকালীন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগরে তৈরি কামানটির নির্মাতা জনাধন কর্মকার নামে এক ব্যক্তি।
জানা গেছে, তৎকালীন সম্রাটের নির্দেশে কামানটি দিল্লি নিয়ে যাওয়ার পথে ভাগীরথী নদীতে নৌকাডুবি ঘটে। এতে তলিয়ে যায় কামানটি। এর প্রায় দুইশ বছর পর ভাগীরথী নদী থেকে বালি তুলে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার হাজার দুয়ারী প্যালেস নির্মাণের সময় কামানটি পাওয়া যায়। তখন বাংলা বিহার উড়িষ্যার মনসদে ছিলেন মীর জাফরের পঞ্চম বংশধর হুমায়ুন ঝাঁ। কামানটি তিনি পরবর্তীতে হাজার দুয়ারীতে সংরক্ষণ করেন। হাজার দুয়ারী প্যালেস ও ইমামবাড়ার ঠিক মাঝখানে রাখা হয়েছে কামানটি। এটি দেখতে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী ভীড় করেন। কথিত আছে, কামানটি পাওয়ার পর নবাব হুমায়ুনের নির্দেশে ১৮ কেজি বারুদ ভরে ফায়ার করার পর এক ভয়ংকর ঘটনা ঘটে। কামানের শব্দে চারপাশের ১০ মাইলের মধ্যে যে সব মায়েরা গর্ভবর্তী ছিলেন, তাদের পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। সেই থেকেই এর নাম হয়ে যায় ‘বাচ্চাওয়ালী কামান’।
স্থানীয়রা মনে করেন, এটার জন্য মায়েদের পেটে থাকা অসংখ্য বাচ্চাকে বলি দিতে হয়। তাই এটাকে বলা হয় ‘বাচ্চাওয়ালী কামান’। জনাধন কর্মকারের তৈরি চারটি কামানের মধ্যে একটি এখনও ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সংরক্ষিত আছে।
ইমামবাড়া
এশিয়ার সবচেয়ে বড় ইমামবাড়াটি অবস্থিত হাজার দুয়ারী প্যালেস চত্বরে, ঠিক বিপরীতে। ১৮৪৭ সালে নির্মিত শিয়া সম্প্রদায়ের এই প্রার্থনা কেন্দ্রটি সপ্তাহে এক দিন ও মহররম মাসে খোলা থাকে। খোশবাগ
নবাব আলীবর্দী খাঁ নিজ সমাধির জন্য জীবদ্দশায় ভাগীরথীর ওপারে খোশবাগ প্রস্তুত করেছিলেন। পলাশীর প্রান্তরে মীর জাফরের বেঈমানিতে পরাজয় বরণের পর নানা ঘটনার পরিক্রমায় হত্যা করা হয় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে। পরে তাকেও সমাহিত করা হয় খোশবাগে, নানা আলী বর্দি খাঁর কবরের পাশে।
খোশ শব্দের অর্থ আনন্দ ও বাগ শব্দের অর্থ বাগান। অর্থাৎ আনন্দ-বাগান। এর সুরক্ষার জন্য চতুর্দিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে বেষ্টনী গড়ে নানা প্রকারের মনোরম পুষ্পবৃক্ষাদি রোপণ করা হয়। খোশবাগে উঁচু পাথর বাধানো কবরে শুয়ে আছেন নবাব আলীবর্দী খাঁ। তার বাম পাশে শুয়ে আছেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। অনেকগুলো কবরের মধ্যে কেবল নবাব আলীবর্দী খাঁর কবর সবচেয়ে বড় ও উঁচু। নবাব সিরাজউদ্দৌলার কবরের পাশে পাথরে খোদাই করে নাম লিখে আলাদা করা আছে।
সিরাজউদ্দৌলার পাশেই তার ভাই মির্জা মেহেদী, সিরাজউদ্দৌলার পায়ের দিকে তার স্ত্রী বেগম লুৎফা ও সঙ্গী আলেয়ার কবর রয়েছে।
একইসঙ্গে খোশবাগে শুয়ে রয়েছেন নবাব নবাব আলীবর্দী খাঁর কন্যারা, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের সদস্যরা, নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যাকারী মোহাম্মাদী বেগ, ইতিহাসে ধিকৃত গোলাম হোসেন, সিরাজউদ্দৌলাকে ধরিয়ে দেওয়া মাঝি ও তার পরিবারবর্গসহ পরবর্তীতে ঢাকা, পাটনা ও অন্যান্য জায়গায় অবস্থানরত সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয়-স্বজন, যাদের ধাওয়া দিয়ে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল, তাদের কবর রয়েছে।
খোশবাগে একটি মসজিদ রয়েছে। খোশবাগে অবস্থাকালে এই মসজিদে আলীবর্দী খাঁ নামাজ আদায় করতেন। চমৎকার নির্মাণশৈলীতে গড়ে তোলা খোশবাগে মূল দরজাসহ সাতটি ফটক রয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে, নবাব আলীবর্দী খাঁ খোশবাগে অবস্থানকালে এখানে বসেই ভাগীরথীর ওপারে মতিঝিলে বড় মেয়ে ঘষেটি বেগমের বাড়ি দেখতেন। এজন্য ফটকগুলো মতিঝিলের সোজাসুজি করে নির্মাণ করা হয়েছিল। নিমকহারাম দেউড়ী
মুর্শিদাবাদের জাফরাগঞ্জে নিমকহারাম দেউড়ী অবস্থিত। নিমকহারাম দেউড়ী মূলত মীর জাফরের বাড়ি। এই বাড়িতেই মোহাম্মাদী বেগের হাতে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা নিহত হন। বর্তমানে বাড়িটির ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। এখানে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বাড়ির ফটকে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সাইনবোর্ড টানানো আছে। এই বাড়ির সঙ্গেই রয়েছে আরও একটি ইমামবাড়া।
উল্লিখিত স্থাপনা ছাড়াও মুর্শিদাবাদের অলি-গলিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পর্যটনকেন্দ্রিক আরও অনেক স্থাপনা। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হলো- কাটরা মসজিদ, ত্রিপোলীয় গেট, চক মসজিদ, ওয়াসেফ মঞ্জিল, আজিমুন্নেছার সমাধি, মীর জাফর ও তার বংশধরদের ১১০০ সমাধি, নশীপুর রাজবাড়ি, নশীপুর আখড়া, কাঠগোলা বাগান, জগৎ শেঠের বাড়ি, আস্তাবল প্রভৃতি।
তবে, সাম্প্রতিক সময়ে মুর্শিদাবাদে ইতিহাসখ্যাত মতিঝিলকে আধুনিক বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। মতিঝিল পার্ক নামে এই বিনোদনকেন্দ্রে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ‘লাইট অ্যান্ড শো’ নামে একটি এপিক থিয়েটার দেখানো হয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার ইতিহাস, নবাব সিরাজউদ্দৌলার মসনদ, জাতির সঙ্গে মীর জাফরের বেঈমানি সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মকে জানাতে এটি একটি মহৎ উদ্যোগ।
ভ্রমণেচ্ছুদের জন্য কিছু পরামর্শ
কলকাতা অথবা শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে ৫-৬ ঘণ্টায় খুব সহজেই মুর্শিদাবাদ যাওয়া যায়। মুর্শিদাবাদ শহরে থাকা-খাওয়া খরচও খুব বেশি নয়। তবে, যাওয়ার আগে অবশ্যই যাওয়া-আসার জন্য ট্রেনে রিজার্ভেশন কনফার্ম করে নেওয়া ভাল। কারণ কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের সব ট্রেনই লোকাল। পথ ২০০ কিলোমিটার। সময় লাগে ৫-৬ ঘণ্টা। কিন্তু লোকাল ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় থাকে। দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না, বসা তো দূরের কথা। মানুষজন গাদাগাদি করে দাঁড়ায়। এতে অভ্যস্ত না হওয়ায় ভ্রমণকারীরা বিপাকে পড়েন। অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েন। এজন্য ট্রেনে চড়ার আগে রিজার্ভেশন কনফার্ম করা শ্রেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৫, ২০১৯
এমএমইউ/এইচএ/