দেশটি রাজাকে এতটাই ভালোবাসে যে ঘর, দোকান, গাড়ি কিংবা রাস্তার পাশে রাজা ও তার পরিবারের ছবি টাঙানো। ভুটানের ৭০ শতাংশ এলাকা সবুজে ঢাকা।
মজার ব্যাপার হলো যে কদিন ভুটানে ছিলাম পুলিশ কিংবা সেনাবাহিনী কারও হাতে কোনো অস্ত্র দেখিনি। এত এত গাড়ি থাকলেও কেউ হর্ন বাজায় না। একটা গাড়িকে টপকে আরেকটা গাড়ি এগিয়ে যাওয়ার চিন্তাও তাদের নেই। আরো মজার ব্যাপার হলো সেখানে রাস্তা পারাপারের জন্য জেব্রা ক্রসিংয়ের গুরুত্ব অনন্য। একবার শুধু চালকদের অবস্থান দেখার জন্য জেব্রা ক্রসিং দাঁড়ানো ছিলাম।
রাস্তা যে পার হবো এমন কোনো সিগন্যাল দেইনি। কিন্তু দেখা গেছে চালক ক্রসিংয়ের পাশে অটোমেটিক দাঁড়িয়ে আমাকে রাস্তা পার হওয়ার ইশারা দিল। বিষয়টা নিশ্চিত হওয়ার জন্য রাস্তা পারাপারের এ কাজটি আমি চারবার করেছি। এবং চারবারই শুধু দাঁড়ানো ছিলাম। গাড়ি অটোমেটিক দাঁড়িয়ে চালক আমাকে যাওয়ার ইশারা দিলো। দেশটিতে এতটাই আইন মানে। বিস্তারিত সেই গল্প না হয় আরেকদিন হবে।
পরেরদিন সকাল সকাল রওয়ানা হই পুনাখার উদ্দেশ্যে। তবে পুনাখা যেতে হলে পারমিশন নিতে হয়। থিম্পুর ইমিগ্রেশন অফিস থেকে আগের দিন আমরা পাসপোর্টের ফটোকপি, ছবি দিয়ে পারমিট করিয়ে রাখি। থিম্পু থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পুনাখা যাওয়ার পথে পড়বে দোচালা পাস বা দোচু লা পাস। গাড়ি থেকে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘে ঢেকে যায়। এটি প্রায় সাদা মেঘে ঢাকা থাকে বলে জেনেছি। কারণ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এই চূড়ায় রয়েছে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, মন্দির। শুনেছি ২০০৩ সালে এখানে ভারতীয় বিদ্রোহীদের সঙ্গে ভুটানি সৈন্যদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশ কিছু ভুটানিজ সৈন্য মারা যায়। ভুটানের রানিমাতা আসি দরজি ওয়াংমুওয়াংচুক এই সেই সব সৈনিকদের স্মরণে বিশেষ স্থাপনাগুলো তৈরি করেন।
এখানে তিনটি স্তরে ১২৮টি স্তূপ রয়েছে। প্রথম স্তরে আছে ৪৫টি, দ্বিতীয় স্তরে ৩৬টি, শেষ স্তরে ২৭টি স্তূপ। আর মাঝখানে রয়েছে বড় একটি স্তূপ। এখানে একটি ক্যাফেটেরিয়া আছে। চাইলে কিছু খেয়ে নিতে পারেন।
দোচালা পাস থেকে আমাদের গন্তব্য সাসপেনশন ব্রিজ। এটি ফো চু নদীর উপর নির্মিত ভুটানের দীর্ঘতম ঝুলন্ত ব্রিজ। যেটি লম্বায় ৩৫০ মিটার। ব্রিজটি লোহা দিয়ে মজবুত করে তৈরি করা। এতে হাঁটার সময় খুব দোলে না। ব্রিজের উপর থেকে আশপাশের দৃশ্য এক কথায় অসাধারণ। এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত থেকে সময় লাগবে ১০ থেকে ১৫ মিনিট। সাসপেনশন ব্রিজ থেকে ১৫ মিনিটের মতো হাঁটলে পৌঁছে যাবেন পুনাখা জংয়ে।
এটি পুনাখা শহরের একটি প্রাচীন প্রাসাদ। যতটুকু জেনেছি ১৬৩৭-১৬৩৮ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। এটি জং স্থাপত্যশিল্পের দ্বিতীয় পুরাণত এবং দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাসাদ। ইউনেস্কো এটাকে ভুটানের ঐতিহ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর উপরের ও নিচের প্রাকৃতিক দৃশ্য খুবই চমৎকার। আমরা মো চু নদী পার হয়ে গাড়ি থেকে নেমে ১২/১৫ মিনিট হাঁটার পরেই ব্রিজটিতে পৌঁছে গেলাম। এমন সুন্দর আর বড় সাসপেনশন ব্রিজ আগে আর দেখিনি।
এখানে ১৯০৭ সালে ভুটানের প্রথম রাজা হিসেবে উগয়েন ওয়াংচুকয়ের অভিষেক হয়েছিল। মো নদীর কোলঘেঁষে গড়ে তোলা এটি ভুটানের দ্বিতীয় প্রাচীন, দ্বিতীয় বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর প্রাসাদ। ১৯৫৫ সালে রাজধানী থিম্পুতে স্হানান্তরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই ছিল ভুটানের রাজধানী তথা প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। এতে যাতায়াতের জন্য মো নদী উপরে রয়েছে একটি কাঠের সেতু। বর্তমানে এটি সবার জন্য উন্মুক্ত। তিনশ রুপিতে টিকিট কেটে যে কেউ ঢুকতে পারবে ভেতরে।
সফরের সবশেষ স্পটের জন্য সবাই অধীর অপেক্ষায় আছে। আর তা হলো রাফটিং! খরস্রোতা নদীর পাঁচ কিলোমিটার বুকে দুই ভাগে রাফটিং করি। শীতল পানি যখন আমাদের উপর আঁছড়ে পড়ে সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। যারা সাতার জানে না তারাও এখানে রাফটিং করতে পারেন। কারণ নিরাপত্তার জন্য তাদের বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। তবে দরদাম করে নিতে ভুলবেন না।
এবার ফেরার পালা পুনাখা থেকে ফুয়েন্টসলিং। সকালে হোটেল ছেড়ে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছি। তাই পুনাখা থেকে সরাসরি ফুয়েন্টসলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা। সাড়ে ৩টার দিকে আমরা রওয়ানা হলেও পৌঁছাতে রাত সাড়ে ১১টা বেজে যায়। কারণ অনেক বৃষ্টি ছিল। বেশ কয়েকটি জায়গায় পাহাড় ধসের ঘটনাও ঘটেছে। তাছাড়া পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথটাও দেখা যাচ্ছিল না। শুরুতে জয়গাঁর যে হোটেলে ছিলাম সেখানে আমরা ফোনে রুম রাখতে বলি। তাই রাত হলেও রুমে উঠতে কষ্ট হয়নি।
সকালে নাস্তা সেরে যে যার মতো কিছু কেনাকাটা করে ভুটান গেটে ইমিগ্রেশন অফিস ও ভারতের ইমিগ্রেশন অফিসের কাজ সেরে রওয়ানা হই। তখন দেশে ঈদের বন্ধ থাকার কারণে বুড়িমারি সীমান্তে মানুষের ভিড়। দু’দিকের ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে নিজ ঘরে ফেরা।
কটাদিন স্বপ্নের মতো কেটেছে। টিমের প্রত্যেকটা সদস্যের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, পার্থ দা, কুমু আপু, টিটু ভাই, শুভ দা, শিমুল আপু, শুভ বাহার, রফিক ভাই, সানজিদা আপু, সজিব দা। দারুণ একটা টিম আমার।
নতুন দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শনীয় স্থানের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে নিজেকে আরও সমৃদ্ধ মনে হচ্ছে। সফরটি স্মৃতিতে নতুন পালক গুঁজে দিল।
[শেষ]
বাংলাদেশ সময়: ১২০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১৯
এডি/এএ