ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

মেঘের দেশ মেঘালয় পর্ব-১

শিলং-চেরাপুঞ্জির পথে...

প্রশান্ত মিত্র, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৯
শিলং-চেরাপুঞ্জির পথে... মেঘালয় ভ্রমণের পথে প্রথম ঝরনা ‘ওমক্রেম ফলস’ বিস্মিত করবেই। ছবি: প্রশান্ত মিত্র

মেঘালয় থেকে ফিরে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ পরিচিত করায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের সঙ্গে। উপন্যাসের চরিত্র অমিত-লাবণ্যর রঙিন সম্পর্ক ছাপিয়ে শিলংয়ের অপরূপ প্রকৃতির প্রেমে পড়েছিলাম সেই কলেজ জীবনেই। বারবার পরিকল্পনা নিলেও সুযোগের অভাবে শিলং ভ্রমণ হয়ে উঠছিল না।

সবশেষে ‘ব্যাটে-বলে টাইমিংয়ে’ মেঘালয় ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যা হলো, মনে হলো কল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক অনেক। এ ভ্রমণে বুঝেছি প্রকৃতির রূপসুধা যতখানি দেখা যায় বা উপভোগ করা যায়, তার সবটা কখনোই ছবিতে কিংবা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়।

এতবছর মেঘালয়ের বণনা যতই পড়েছি বা শুনেছি, বাস্তবে যা দেখেছে তার তুলনায় সেটা নিতান্তই ঠুনকো। মেঘ-পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে এত বিস্ময় লুকানো থাকতে পারে, তা আসলেই কখনো বলে বোঝানো যাবে না। ভ্রমণের পুরোটা সময়ই যেন ছিল স্বপ্নের মতো কিংবা স্বপ্নের চেয়ে খানিকটা বেশিই বটে!
 
ভ্রমণের আগেই বেশ কয়েকবার সিদ্ধান্ত বদল। সবশেষে বর্ষায় পাহাড়-ঝর্ণার ‘পূর্ণ যৌবনকাল’ বিবেচনায় শিলং ভ্রমণের সময়ক্ষণ চূড়ান্ত হলো। সে অনুযায়ী ভিসা প্রস্তুতিও সম্পন্ন, তবে সঙ্গীদের ভাগ্যের ফেরে তারিখটা ঠিক করতে পারছিলাম না কোনোমতেই। যতজনই হোক আর যতদিনের জন্যই হোক, সবশেষে যাওয়ার বিষয়টি একরকম চূড়ান্ত করলাম আমরা তিনজন। বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ফেসবুক গ্রুপ ঘেঁটে চারদিনের বাজেটসহ পরিকল্পনা দাঁড় করালাম। ২৫ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে সিলেটের উদ্দেশ্যে বাসে চড়ে মনে হলো, হ্যাঁ, অবশেষে যাচ্ছি অমিত-লাবণ্যর শহরে...
মেঘালয়ের এই ব্রিজটিই সিলেটের জাফলং থেকে দেখা যায়।  ছবি: প্রশান্ত মিত্র
২৬ আগস্ট ভোরে সিলেট শহরে নেমে নাস্তা সেরে আবার বাসে চড়ে বসলাম, গন্তব্য তামাবিল। ঝড়ের গতিতে সিলেট পৌঁছে মনে হলো, সিলেট থেকে তামাবিলের পথ আর শেষ হয় না। লক্কড়-ঝক্কড় লোকাল বাসে প্রায় ২ ঘণ্টার বিরক্তিকর যাত্রা শেষ করে সকাল ৯টার দিকেই আমরা তামাবিল ইমিগ্রেশনে। অনেকেই সিলেট-তামাবিল গাড়ি কিংবা সিএনজি রিজার্ভ করে যান, তবে আমরা তা করিনি। কারণ আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আমরা ঘুরতে যাচ্ছি, বেড়াতে নয়। আমাদের টার্গেট স্বল্প সময় এবং বাজেটের মধ্যে যতটুকু চষে বেড়ানো যায়।
 
তামাবিল ইমিগ্রেশনে ইতোপূর্বে সবার কাছেই ঘুষ লেনদেনের কথা শুনেছি। তবে আমরা ইমিগ্রেশনে গিয়ে উল্টো গল্প জুড়ে দিলাম। পরিচয়ে কারণে ‘কিছু’ চাইলো না নাকি, গল্প করতে করতে ‘কিছু’ নিতে ভুলে গেলো বুঝতে পারিনি। তবে এপারে রক্ষা পেলেও ওপারে মানে ডাউকি অংশের ইমিগ্রেশনে ঠিকই ধরা। ইমিগ্রেশন অফিসার অন অ্যারাইভাল সিল দিলেও বেঁকে বসেছেন কাস্টমস কর্মকর্তা। ডলার না নিয়ে টাকা নেওয়ার অভিযোগে যখন অনুরোধেও মন গলেনি সেই কর্মকর্তার, তখন পাসপোর্টের ভাঁজে ৫০০ টাকার নোট দেখালে মোমের মতো গলে যান তিনি।
 
যাই হোক বর্ডারের ঝামেলা শেষ করে তিনজন হাঁটা ধরলাম ডাউকি বাজারের দিকে। সেখান থেকে ১২টা নাগাদ আমাদের গাড়িতে ওঠার কথা। ডাউকি বাজারে টাকা থেকে রূপি বদল করে হালকা নাস্তা শেষে গাড়ির অপেক্ষা করছি। বাজার থেকে ভাড়া করার জন্য বিভিন্ন সিটের গাড়ি পাওয়া যায়। তবে আমাদের গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। কিন্তু ১২টা বাজার পরও যখন গাড়ি আসছিল না, তখন মনে হলো ভারত আবার আমাদের চেয়ে আধঘণ্টা পিছিয়ে। এই ভেবে আবার মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে যার মত। নেটওয়ার্ক থাকতে থাকতে প্রয়োজনীয় ফোন কল সেরে নিচ্ছি। এর মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির ড্রাইভার কাম গাইড ফজলু রহমান। তার বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি বংশগতভাবেই বাঙালি। গারো হিলসে বাঙালিদের বড় একটি কমিউনিটি রয়েছে, তিনি ওখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। বলে রাখা ভালো, জৈন্তা হিলস, খাসিয়া হিলস এবং গারো হিলস মিলেই মেঘালয়। আর শিলং-চেরাপুঞ্জির পুরোটাই খাসিয়া হিলস এলাকায়। যাই হোক, ভিনদেশে আমাদের বাঙালি সঙ্গীকে কয়েকটা স্পটের কথা বুঝিয়ে দিয়ে ভাবলাম, এবার আমাদের হারিয়ে যাবার পালা। ‘বরহিল ফলস’ দেখে মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে পাহাড় বেয়ে পানি নিচে নামছে।  ছবি: প্রশান্ত মিত্র
গাড়ি খানিকটা সামনে যেতেই একটা ব্রিজ চোখে পড়লো। ড্রাইভারের কাছ থেকে শুনে নিশ্চিত হলাম, এই ব্রিজটিই আমাদের জাফলং থেকে দেখা যায়। আসলেই বাম পাশে আমাদের জাফলংয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এই ব্রিজটার দিকে তাকিয়ে কতবার এপারে আসার সাধ জেগেছিলো। গাড়ি ক্রমেই পাহাড়ের গা বেয়ে ছুটে চলেছে, আর ভাবছি জাফলং থেকে এ পাহাড়গুলোর দিকে কতই না তাকিয়ে থেকেছি।
 
খানিকটা যাবার পর মনে হলো, পাহাড় আমাদের স্বাগত জানাতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। মেঘালয় ভ্রমণের পথে প্রথম ঝরনা ‘ওমক্রেম ফলস’র সাক্ষাৎ পেলাম। গাড়ি থামতেই একনজর অবাক হয়ে দেখেছি, কিন্তু সময় নষ্ট করার সময় কই? ব্যাগ থেকে জামা-কাপড় বের করে এক দৌড়ে ঝরনার নিচে। কিন্তু পানির যে গতি, এতে প্রথমে খানিকটা ভয়ই পেয়েছিলাম। তবে ভয় কাটতে সময় লাগেনি, ঝরনায় নামবো আবার ভয়ও পাবো, সেটা হয় নাকি। কোনোমতে ঝরনার একেবারে কাছে গিয়ে এক চিৎকারে সারারাতের সব ক্লান্তি যেন উধাও। এরপরের প্রায় ঘণ্টাখানেক হিমশীতল পানিতে গোসল চললো। মন না চাইলেও এবার উঠতে হলো, কারণ ঝরনাতো সবে শুরু!
 
ভাঙা রাস্তায় মিনিট বিশেক যাওয়ার পর আরও বিশাল এক ঝরনা, নাম তার ‘বরহিল ফলস’। কয়েকটা ধাপে অনেক উঁচু থেকে নেমে আসছিল পানির ধারা, মনে হচ্ছিল আকাশ থেকে পাহাড় বেয়ে পানি নিচে নামছে। এখানে নামার কোনো উপায় নেই। তাই সামনে থেকে কিছু ছবি তুলে এবার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনংয়ের দিকে পা বাড়ালাম।
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনংয়ে ‘হোম স্টে’র ব্যবস্থা আছে।  ছবি: প্রশান্ত মিত্র
এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিনং। গ্রামটি বেশ ছোট হলেও একটি গ্রাম কতটা গোছানো-পরিপাটি হতে পারে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হওয়ার নয়। গ্রামের ভেতর দিয়ে পিচঢালা রাস্তা, দুই পাশে শত-সহস্র রকমের ফুল গাছ ও বিভিন্ন গাছপালা। খানিকটা হাঁটলেই যে কেউ মুগ্ধতায় হারিয়ে যেতে বাধ্য। ছোট-মাঝারি আকারের বাড়িগুলোর কোনো বিশেষত্ব নেই, কিন্তু সবকিছু অসম্ভব পরিপাটি। গ্রামটিকে পরিষ্কার রাখতে কেউ বলে দেয়নি। শুধু বাসিন্দাদের সদিচ্ছাতেই একটি এলাকা কত চমৎকারভাবে সাজানো সম্ভব! গ্রামটিতে ‘হোম স্টে’র ব্যবস্থা রয়েছে, কেউ চাইলে অর্থের বিনিময়ে গ্রামটিতে নিশিযাপন করতে পারবেন।
 
গ্রামের সামনেই একটা হোটেলে লাঞ্চ সেরে কাছেই ‘লিভিং রুট ব্রিজ’র দিকে রওয়ানা হলাম। গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা হেঁটে নিচে নেমে রুট ব্রিজের দেখা মিললো। আসলেই প্রকৃতিকে শুধু তার মতো থাকতে দিন, প্রকৃতি আপনাকে দু-হাত ভরে দেবে। পাহাড়ের বুকে প্রবাহমান জলাধারার দুইপাড়ে গাছের শিকড়ে কী অদ্ভুতভাবে সেতু তৈরি করে প্রকৃতি। ব্রিজের অপর পাশের গ্রামে খানিকটা ঘোরাঘুরি করে সূর্যাস্ত দেখে গাড়িতে চড়ে বসলাম।
 
মেঘালয় ভ্রমণে সাধারণত সবাই শিলং হয়ে চেরাপুঞ্জি যায়, তবে আমাদের প্রথমে চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং হয়ে দেশে ফেরার পরিকল্পনা। সে অনুযায়ী রাতে বরাবর চেরাপুঞ্জি গিয়ে রাত্রিযাপন হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের এলাকা চেরাপুঞ্জির দিকে গাড়ি এগিয়ে চলছে। মনে হচ্ছে গাড়ি পাহাড়ের কোল বেয়ে শুধু ওপরের দিকেই উঠছে। চেরাপুঞ্জি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৮৬৯ ফুট উচ্চতায়। কিছুদূর যাওয়ার পর আবহাওয়া ঠাণ্ডা হতে শুরু করলো। রাতের বেলা দুইপাশে বেশ ভালো দেখা না গেলেও গাড়ির সামনে মাঝেমধ্যে মেঘের ভেলা ভেসে আসছে বোঝা যাচ্ছিল। প্রায় তিন ঘণ্টার আঁকা-বাঁকা, উঁচু-নিচু পথ পাড়ি দিয়ে আমরা চেরাপুঞ্জিতে পৌঁছালাম। দুইটা বাড়ি খুঁজে চেরাপুঞ্জির ওপরের দিকটাতে এক খাসিয়া বাড়ির চিলেকোঠায় থাকার বন্দোবস্ত হলো। চেরাপুঞ্জিতে বেশিরভাগ বাড়িতেই ‘হোম স্টে’র ব্যবস্থা রয়েছে। সেই সুযোগটা আমরা হোটেলে থেকে মিস করতে চাইনি। এই রাতে পাহাড়ের কোলে বাড়ির ছাদে মেঘের খেলা, মেঘের ফাঁকে তারাদের হাতছানি… আর কী দরকার? চেরাপুঞ্জির পথে খুব সকালেই বের হওয়ার পরিকল্পনা করে আজকের মতো শুভরাত্রি চেরাপুঞ্জি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯১৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৬, ২০১৯
পিএম/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।