ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

উড়োজাহাজে প্রথম ভ্রমণ ও একটি রোমাঞ্চকথা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
উড়োজাহাজে প্রথম ভ্রমণ ও একটি রোমাঞ্চকথা

ছেলেবেলায় আদর্শলিপিতে ‘উ-তে উড়োজাহাজ’ পড়তাম আর ভাবতাম, মানুষ কীভাবে আকাশে ওই ছোট যন্ত্রটার পেটের ভেতরে বসে উড়ে বেড়ায়! ছোটকালে আমার মতো অনেকেরই হয়তো শঙ্খচিলের মতো উড়ে যাওয়া বিমান নিয়ে কৌতূহলের অন্ত ছিল না। খুব শখ হতো, আমিও একদিন বিমানে উঠবো। অবশেষে স্বপ্ন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ধরা দিল।

ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি ইউনিভার্সিটিতে এক মাসের কোর্স করার জন্য আবেদন করে রেখেছিলাম অনেক আগেই। ভারতীয় হাই কমিশন, ঢাকার সৌজন্যে শিক্ষাবৃত্তিটা পেয়েই গেলাম।

এদিকে অফিস থেকেও পেলাম সহৃদয় সহযোগিতা। সুবর্ণ সুযোগ এলো ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে বেঙ্গালুরু উড়ে যাওয়ার।

এটা ছিল উড়োজাহাজে আমার জীবনের প্রথম ভ্রমণ। সঙ্গত কারণেই নিজের মধ্যে কাজ করছিল প্রচণ্ড চাপা উচ্ছ্বাস। উত্তেজনায় ভালো ঘুমও হয়নি ভ্রমণের আগের রাতে। কল্পনায় এটাই শুধু অনুভব করতে চেষ্টা করছিলাম যে, কেমন হবে উড়োজাহাজে আগামীকালের ভ্রমণ?

ভ্রমণের দিন যথাসময়ে উপস্থিত হলাম ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। এর আগে এখানে একবার মাত্র আসা হয়েছিল। সেটাও এক আমেরিকান বন্ধুকে অভ্যর্থনা জানাতে। তাছাড়া কখনো বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার প্রয়োজন হয়নি আমার।

ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করে ভেতরে ঢোকার পর দেখলাম রাজধানী ঢাকার নতুন রূপ। এতটা অভিজাত রূপে বিমানবন্দরকে সাজানো দেখে বেশ ভালো লাগলো। হঠাৎ খেয়াল হলো দুয়েকটি প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে নেওয়া দরকার। বিদেশে গিয়ে ওষুধ খোঁজ করে কেনা বেশ ঝামেলার হবে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম, বিমানবন্দরে কোনো ওষুধের দোকান নেই। দেখতে দেখতে উড়োজাহাজে ওঠার সময় হয়ে এলো।

বিমানবন্দরে লেখক ও তার সঙ্গীরা।  ছবি: বাংলানিউজ

এয়ার ইন্ডিয়ায় প্রবেশের সময় অভ্যর্থনাতেই মনে হলো যেন ভারতে প্রবেশ করছি। নিজের আসনটি খুঁজে বসলাম। দারুণ রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। সামনের ভিআইপি অংশে একজন সুন্দরী বিমানবালা সতর্কীকরণ নির্দেশনা দিচ্ছিলেন। আর আমাদের বিজনেস ক্লাসের বড় কামরায় একজন সুদর্শন যুবক একই নির্দেশনা প্রদর্শন করলেন। ভাবলাম, নারীকর্মীদের তো বিমানবালা বলা হয় জানি, পুরুষদের কি তাহলে বিমানবালক বলা হয়? কিন্তু ইনি তো পুরাদস্তুর যুবক। যুবককে বালক বলা মোটেও সমীচীন হবে না নিশ্চয়।

সিট বেল্ট বেঁধে বসলাম। একটু পরই রানওয়ে ছেড়ে হাওয়ায় ভাসলো উড়োজাহাজ। সান্ধ্যকালীন বিমানযাত্রায় জানালা থেকে বাইরে তেমন কিছু দেখার সুযোগ নেই। সবই অন্ধকার। তাছাড়া আমার আসন ঠিক জানালার পাশেও পড়েনি। তাই মেঘমালা, আকাশ থেকে ভূমি কোনোকিছুই আর দেখা সম্ভব হলো না। তাই দু’চোখ বন্ধ করে উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ, বাতাসের সঙ্গে সংঘর্ষের শব্দ, আর অভ্যন্তরীণ বায়ুচাপের তারতম্য এসবই অনুভব করতে থাকলাম। সেইসঙ্গে নিজের অজান্তেই হারিয়ে গেলাম শৈশব স্মৃতির ভিড়ে।

মনে পড়লো, পাঁচ-সাত বছর আগে একবার শরৎকালে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ঢাকা ও যশোরের সংযোগরেখায় আমাদের গ্রাম অবস্থিত। তাই ছোটবেলা থেকেই আকাশে উড়োজাহাজ দেখতে দেখতে বড় হয়েছি আমি।

এক রাতে বাড়ির পাশে কলেজের মাঠে সবুজ ঘাসের বিছানায় শুয়ে অসীম আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। একদম ঝকঝকে পরিষ্কার ছিল আকাশ। ঢাকা শহরে এমন পরিষ্কার আকাশ তো দেখাই যায় না। পশ্চিম আকাশে ছিল অষ্টমীর আধাখানা চাঁদ। আর শত-সহস্র নক্ষত্রের মেলা বসেছিল সেদিন। ইশান কোণ থেকে নৈঋত কোণে চলে গেছে সুবিস্তৃত ছায়াপথ ও নীহারিকা। এই গ্যালাক্সিরই একটি ক্ষুদ্র অংশে অবস্থিত সৌরজগতে আমরা বাস করি। পৃথিবীর পৃষ্ঠে চিৎ হয়ে শুয়ে যেন সমগ্র বিশ্বজগতের মধ্যে নিজেকে আমি আবিষ্কার করেছিলাম। অনুভব করেছিলাম, আমি এই দিব্যলোকের বাসিন্দা। আমি কোনো তুচ্ছ সৃষ্টি নই। আমি এক বিশ্বজনীন সত্ত্বা। এমন তন্ময় সময়ে আমার অনুভূতিকে আরও বিহ্বল করে ঢাকা থেকে যশোরগামী একটি উড়োজাহাজ উড়ে গেল। সেই নক্ষত্রের মেলার ভিড়ে যেন এক মহাকাশযান নিজের পথ করে এগিয়ে যাচ্ছিল সামনের অজানা দিগন্তে। মহাবিশ্বে যেন আমিই একমাত্র সত্ত্বা যে এই চমৎকার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করছিলাম। আমার জীবনে দেখা অন্যতম সেরা নৈসর্গিক দৃশ্য ছিল এটি। এসব কথা ভাবতে ভাবতে যেন আবারও মানসপটে আমি সেই রাতকে অনুভব করছিলাম। এবার আমি স্বয়ং যেন সেই উড়োজাহাজের যাত্রী।

একে একে অনেক কথাই মনে পড়ছিল। সপ্তম শ্রেণিতে থাকতে গ্রীষ্মের এক মাস ছুটিতে প্রাচীণ মহাকাব্য রামায়ণ গ্রন্থটি পড়ে শেষ করার সংকল্প করেছিলাম। প্রতিবেশী ঠাকুরমার কাছ থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ জোগাড়ও হয়েছিল। তারপর ঠিকই এক মাসে পুরো সপ্তখণ্ড রামায়ণ পড়ে শেষ করি। সেই রামায়ণে উড়োজাহাজের উল্লেখ ছিল। স্বর্গের দেবতারা বিমান ব্যবহার করেন। এমনকি লঙ্কারাজ রাবণেরও উড়োজাহাজ ছিল যা আকাশপথে যাতায়াত করতো। তিনি সীতাকে হরণ করে তার উড়োজাহাজে তুলে লঙ্কায় নিয়ে গিয়েছিলেন। দারুণ চিত্তাকর্ষক রামায়ণের কাহিনী পড়তে পড়তে মুগ্ধ হতাম। তখনও মাঝে মধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে উড়োজাহাজের বিবর্তনের কথা ভাবতাম।

আরও একটু বড় হয়ে উড়োজাহাজে চড়ার শখ হয়। সেই শখ মিটলো। কিন্তু জানালার কাছে আসন পড়েনি, তাছাড়া নৈশ ভ্রমণের কারণে বাইরের দৃশ্যগুলো উপভোগ করতে পারিনি। মাত্র ২৫ মিনিটেই ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছে গেলো এয়ার ইন্ডিয়া। তবে এদিনের আফসোস পরেরদিন সুদে-আসলে আদায় করে নিয়েছি।

কলকাতার নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করলো আমাদের বহন করা উড়োজাহাজটি। এই বন্দরকে ঢাকার বন্দরের চেয়েও অনেক বড় মনে হলো। ইমিগ্রেশন এবং তল্পিতল্পা চেকিং শেষে ডেলিভারিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিও বেশ চমকপ্রদ লাগলো।

সে রাতে কলকাতার একটি হোটেলে থাকলাম। পরদিন দুপুরে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু ফ্লাইট। এটা বেশ দীর্ঘ পথের যাত্রা হবে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা। আর দিনের আলোয় আকাশ থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার হাতছানি তো আছেই। তার আগে সকালে কিছু কেনাকাটাও সেরে নেওয়ার ইচ্ছা ছিল। সুতরাং দারুণ উত্তেজনা নিয়েই সেদিন রাতে ঘুমাতে গেলাম।

পরের কিস্তি: ক্ষণিক দেখা এক টুকরো কলকাতা

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২২, ২০১৯
এমকেআর/এইচএডি/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।