দমদমের গোরাবাজার এলাকাটি বিমানবন্দরের কাছে হলেও হোটেল থেকে সেখানে যাওয়ার রাস্তা চেনা ছিল না। তাই একটু বেগ পেতে হলো।
কলকাতার মানুষ তো বাঙালি-ই। আর বাঙালিমাত্রই আমরা গল্প করতে ও কথা বলতে ভালোবাসি। কাউকে যদি বিনে পয়সায় দিক-নির্দেশনা দেওয়ার মতো উপকার করা যায়, তাতে মোটেও কার্পণ্য করি না আমরা। অতএব এই সহযোগিতা কলকাতায় আপনি সহজে-ই পাবেন।
তবে আমরা বাংলাদেশি বাঙালিরা অসহায়-দুস্থদের সহায়তায় যেরকম সহজেই মানিব্যাগে হাত দিই, কলকাতায় তেমনটা দেখা যায় না। তাদের কাছে প্রতিটি টাকাই অনেক গুরুত্ববহ। বাংলাদেশে যাতায়াত বা কেনাকাটায় দু-এক টাকা আমরা যেমন সহজেই ছেড়ে দিই, পশ্চিমবঙ্গে এমনটা দেখা যাবে না।
ওরা কাউকে এক টাকা কম দেবে না, আবার এক টাকা ছেড়েও দেবে না। মজার ব্যাপার হলো, ওখানে দূরত্ব অনুযায়ী রিকশা ভাড়া ১১ টাকা, ১৯ টাকা এরকমও হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা ইদানীং এসব চিন্তাও করতে পারি না। একটাকা কম-বেশি নিতে বা দিতে আমরা যথেষ্ট উদারতা দেখাই।
ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই আমার এক আত্মীয়ের বাসায় পৌঁছালাম। সময় অল্প থাকায় বেশিক্ষণ অবস্থান করার সুযোগ ছিল না। সবকিছুর খোঁজখবর-গল্পসল্প করেই বিদায় নিলাম। অনেকদিন পর বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি তাদের বাড়িতে। সঙ্গত কারণেই এক কাপ চায়ের প্রস্তাব পেয়েছিলাম আমরা। চায়ের তেষ্টা ছিল বটে, কিন্তু সময়ের সংক্ষিপ্ততাও ছিল। তদুপরি উদ্যোগ না দেখে বিনয়ের সঙ্গে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। তবে চায়ের পরিবর্তে ‘টা’টা হলেও চলতো কিছু! যা হোক, সময়ের অভাবের কারণে দ্রুতই বের হলাম।
বাঙালির অতিথিপরায়ণতা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। তবে বাংলাদেশি বাঙালির মাঝেই এখনও সেই অতিথিপরায়ণতা বেশ বিদ্যমান।
আত্মীয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে গোরাবাজার গেলাম। সেদিন চলার পথে কালীপূজা উপলক্ষে নির্মিত চমৎকার কিছু অস্থায়ী মণ্ডপ দেখলাম। বাঙালি হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা হলেও কালীপূজাও খুব ঘটা করে উদযাপন করা হয়।
বিশেষত কালীপূজা ও দীপাবলি একসঙ্গে হওয়ার কারণেই এটি জাঁকজমকপূর্ণ আলোর উৎসবে পরিণত হয়। তবে এদিন ভারতের সবখানে কিন্তু কালীপূজা হয় না। এই পূজা মূলত বাঙালি হিন্দুরাই করে। তবে সর্বত্রই দীপাবলি বা দিওয়ালি অর্থাৎ আলোর উৎসব হয়।
বাজার থেকে কিছু কেনাকাটা সেরে খেয়াল হলো এবার তো মাটির কাপে চা খাওয়ার পালা। অনিন্দ্যকে বললাম, ভাইডি, দাদাদের দেশে এসে মাটির কাপে দুধ চা না খেলে পুরো ভ্রমণের স্বাদটাই তো নষ্ট হয়ে যাবে। অতএব, চায়ের দোকানের সন্ধান করলাম। চা খেতে খেতে খোশগল্প চলতে থাকে।
মাটির কাপের চায়ের স্বাদ বেশ অনন্য। পালবাড়ির গনগনে আগুন থেকে তুলে আনার পর মাটির কাপ কিন্তু ধোয়া হয় না। বরং সামান্য ছাইও লেগে থাকতে পারে। কেতলিতে তৈরি চা এই কাপেই সরাসরি ঢেলে পরিবেশন করা হয়। ছাই ও পোড়ামাটির সংস্পর্শে চায়ের স্বাদ যেন বেড়ে যায়। একটু অন্যরকম প্রাকৃতিক অনুভূতি। তবে এই মাটির কাপ ঢাকার চায়ের দোকানের বারবার ব্যবহৃত কাচের কাপ কিংবা এককালীন প্লাস্টিকের কাপের চেয়ে বেশি নিরাপদ ও জীবাণুমুক্ত, এব্যাপারে একদম নিশ্চিন্ত। মাটির কাপও এককালীন ব্যবহৃত হয়।
চা খেতে খেতে চারপাশটা দেখি আর কলকাতার সংস্কৃতি নিয়ে দু’জনে আলোচনা জমাই। এখানের মেয়েরা খুবই স্বাধীনচেতা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ব্যস্ত থাকেন।
গ্রামাঞ্চলে মেয়েদের বাইসাইকেল ব্যবহার খুব চোখে পড়ার মতো। তরুণী-নারীরা সাইকেল চালিয়ে বাজারে বা কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। তাও আবার শাড়ি পরেই। মেয়েরা স্কুলেও যায় সাইকেল চালিয়ে। দিনে-রাতে সবসময়ই নারীরা পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। নারী-পুরুষের ভেদাভেদ খুব একটা চোখে পড়েনি।
চা শেষ করে এবার হোটেলে ফেরার পালা। দু’জনে চরে বসলাম টোটোতে। বাংলাদেশে যাকে আমার ইজিবাইক বলি, কলকাতায় তাকে বলে টোটো। সম্ভবত সারাদিন এদিক-সেদিক টোটো করে ঘুরে বেড়ায় বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে টোটো। তবে আমরা ছোটকাল থেকেই যে ‘টোটো কোম্পানির ম্যানেজার’ নামে পরিচিত ছিলাম এই ইজিবাইকের সঙ্গে সেই টোটো কোম্পানির কোনো সম্পর্ক নেই বলে নিশ্চিত হলাম।
সকাল ১১টার মধ্যে হোটেলে পৌঁছালাম। দ্রুত গুছিয়ে নিয়ে বের হলাম বিমানবন্দরের উদ্দেশে। ১২টার মধ্যে পৌছালাম নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
এবার আমার সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত প্লেন ভ্রমণের যাত্রা শুরু। ঝলমলে দিনে মেঘের দেশে উড়ে বেড়ানো আর কল্পনার চেয়েও সুন্দর মেঘের সৌন্দর্য উপভোগ করার পালা।
চলবে…
বাংলাদেশ সময়: ১০৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১২, ২০১৯
এমকেআর/জেআইএম