দিন ৪
চিকলী বাজার (নীলফামারী)-রংপুর সদর= ৩৫.২৩ কি. মি.
‘বৃক্ষরোপিত সবুজ তারাগঞ্জে আপনাকে স্বাগত, ১ ঘণ্টায় ২ লাখ ৫০ হাজার’ দিনের শুরুটা হয়েছিল এই সাইনবোর্ড পড়ে। সকালটা এর চেয়ে ভালো মনে হয় আর হতে পারতো না।
সাজিদ ভাইয়ের কাছে বিদায় নিয়ে ভোরের মৃদুমন্দ আলোয় হাঁটতে দারুণ লাগছিল। এক কিলোমিটার যেতে না যেতেই আমার সামনে নতুন কেনা হিরো গ্ল্যামার বাইকটা ক্যাঁচ করে ব্রেক কষলো। সাজিদ ভাই অশ্রুসজল চোখে নেমেই আবার কোলাকুলি করলেন। ‘আপনাকে একদম একলা ছাড়তে মন চাইছে না। মন মানছিল না দেখে আবার গাড়ি ঘুরিয়েছি। আমার সময় আর শারীরিক সামর্থ্য থাকলে আমি পুরোটা পথই আপনার সঙ্গে যেতাম।
আর ভাই আজ থেকে আমি প্লাস্টিক ব্যবহার করবো না’- জলভরা চোখে আলিঙ্গনে আবদ্ধ অবস্থাতেই বললেন। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এই লোকটাকে আমি গতকাল সকালে এই সময়েও চিনতাম না। মানুষ কত বিচিত্র। যোগাযোগটা কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না- এই কথা দিয়ে ওনাকে বিদায় দিলাম। আমার কাছে বাকি জীবনটা সৈয়দপুর শহরটা ‘সাজিদপুর’ হয়েই থাকবে।
গাছের ফোঁকড় দিয়ে সূর্যের আলো এসে নানান রকম বিচিত্র কারিকুরি করছে রাস্তার গায়ে। দু'পাশের রাস্তায় অনেক ইটভাটা। ইটভাটার ক’জন শ্রমিক থামিয়ে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করলো। খিয়ার জুম্মা বাজার পেরিয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম তারাগঞ্জ সদরে। পুরো জায়গাটা রেস্তোরাঁ আর বাস কাউন্টারে ভর্তি। বাজার ছেড়ে সামনের দিকটায় বগুড়া সেচ খাল।
রাস্তার দু’পাশে উন্নয়নের মচ্ছব লেগেছে যেন। তারই ফলশ্রুতিতে অবিরাম ধূলিঝড়। ধূলির দুনিয়া শেষ হয়ে চোখ আঁটকালো দারুণ সুন্দর লাল মাটির একটি রাস্তার দিকে। ঠিক যেমনটা বান্দরবান-রাঙামাটির দিকে দেখা যায়। ঘনিরামপুর ছাড়াতেই পড়লো যমুনেশ্বরী নদী। পাড়ের মরা কাশফুল শরৎ শেষের বার্তা জানাচ্ছে যেন। ইকরচালী বাজারের আগেই পল্লী উন্নয়ন একাডেমির বিশাল এলাকা। নির্মাণযজ্ঞ চলছে মহা সমারোহে।
রাস্তার দু'ধারে এবার ধানক্ষেতের পাশাপাশি মাছ চাষের বিশাল সব পুকুর নজরে আসছে। বামনদীঘি ছেড়ে এগোতেই এক ছেলে প্রশ্ন ছুড়লো- ‘ভাই কি আমাজন জঙ্গলে যাবেন?’
-এই রাস্তা দিয়ে আমাজন যাওয়া যায় নাকি? আমি তো যদ্দুর জানি এটা দিয়ে বড়জোর রংপুর পৌঁছানো যাবে!
ছেলেটা কিলোমিটারখানেক সঙ্গ দিয়ে ওর বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বিদায় নিল। অল্প এগোতেই বিআরটিসির দুর্ঘটনাকবলিত একটি বাস দেখলাম। বালাবাড়ি বাজার পেরিয়ে পেলাম ‘বাছুর বান্ধা’ নামক জায়গা। গাইবান্ধা নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, এবার বাছুরবান্ধাও দেখা হলো।
রাস্তায় প্রচুর খড় বোঝাই ভ্যান চোখে পড়ছে। সরু একটা সেতু পেরিয়ে রংপুর সদর উপজেলায় ঢুকতেই চোখে পড়লো ভিন্নজগৎ নামে একটা পার্কের গেট। টেকনাফ-তেঁতুলিয়া সাইকেল রাইডের সময় এই পার্কটাতে যাওয়া হয়েছিল। তাই আর আগ্রহ বোধ করলাম না। সলেয়াশাহ বাজার ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই হরকলি, তারপরেই পাগলাপীর নামক জায়গাটা। এখান থেকে সোজা রাস্তাটা গেছে রংপুর শহরের দিকে আর বামের রাস্তা এগিয়েছে জলঢাকা, তিস্তা ব্যারেজের পানে। মন্থনার কাছাকাছি এক ছাপড়া হোটেলে খেলাম দুপুরের খাবার। বিল দেওয়ার সময় হোটেলের ছেলেটার সঙ্গে আলাপচারিতায় উঠে এলো ছেলেটার চট্টগ্রাম দযাপনের গল্প। বেসরকারি একটা পলিটেকনিকে পড়ত সে চট্টগ্রামে থাকাকালীন। ক'বছর হলো নিজ বাড়িতে এসে ভাতের হোটেল দিয়েছে।
ঘাঘট নদী অতিক্রম করতেই পড়লো জাফরগঞ্জ। এরপর থেকে সব জায়গার নামে উত্তমের রাজত্ব। একে একে পেরুলাম উত্তম হাজীর হাট, উত্তম হাছনা বাজার। এই উত্তম শেষ হবে কবে এটা চিন্তা করেই মন অস্থির। খানিক এগিয়ে পেলাম উত্তর- পশ্চিম বিজিবির হেডকোয়ার্টার। এখান থেকেই খুব ক্লান্তি লাগছিল। এর মধ্যেই ফোন করলেন সাংবাদিক বাদল ভাই। উনি টাউন হলে অপেক্ষা করছেন। সিও বাজার, মেডিক্যাল মোড় পার হতেই পা আর চলছিল না। তার ওপর শুরু হয়েছে শহরের কোলাহল।
এরকম নিঃশেষ আগে কোনোদিন লাগেনি। ধীর পায়ে ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, জিলা স্কুল, কালেক্টরেট সুরভি উদ্যান পার হয়ে টাউন হলে এসেই বাদল ভাইদের দেখা মিললো। কিছুক্ষণ গল্প-গুজবকরে মেডিক্যালের বান্ধবী মণিকে ফোন করে পথের দিশা জেনে নিলাম। মণির নানাবাড়িতেই আজ রাতের আশ্রয়। মাহিগঞ্জ থেকে রিকশায় চেপে ছোট্ট ছিমছাম বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই মনটা ভালো হয়ে গেলো। গোসল সারার সময় মনে পড়লো, এত ক্লান্তির কারণ। আজ দুপুরের পরে পানি খেতেই ভুলে গেছি। গোসল শেষে অতি আবশ্যিক চায়ে চুমুক দিতে দিতে মণির বড় মামির সঙ্গে কথা হচ্ছিল এটা-সেটা নিয়ে। নানান কথা মোড় নিল শেষমেষ আমার আর মামির চা প্রীতির দিকে।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
বাংলাদেশ সময়: ১০৩১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২০
এএ/