ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০) ১০ পর্বের হাঁটার রাস্তা।

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ১০

শিবগঞ্জ (বগুড়া) - জয়পুরহাট = ৩৬.২২ কি. মি.

'তোককনু ওখানে যাস নে, তাও তুই গেলু। গেলু তো গেলু, খেলু, আবার লিয়েও এলু! (তোকে বলেছি ওখানে যাস নে, তাও তুই গেলি।

গেলি তো গেলি, খেলি, আবার নিয়েও এলি!)- বগুড়ার ভাষা নিয়ে এই ছিল আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা। মেডিক্যালের বন্ধু শামীমের কাছ থেকে বহুবার শুনেছি এই লাইনগুলো। ভোরবেলা এরকমই কিছু শব্দ শুনে ঘুম ভাঙলো। এই সকালে ওমর ভাইয়ের মা কোন ফাঁকে ডিম-খিচুড়ি বসিয়ে দিয়েছেন কে জানে। ১০ পর্বের হাঁটার রাস্তা। সকাল সকাল ভরপেট খেয়ে শিবগঞ্জ থানার সামনে যেতেই আগে থেকে অপেক্ষারত ফরহান আর কাননের সঙ্গে দেখা। বগুড়া মেডিক্যালের পঞ্চম বর্ষের এই দুই শিক্ষার্থী আজ আমার হাঁটার সঙ্গী। ওমর ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতেই করতোয়া নদীর উপর নির্মিত সেতু পড়লো। ভোরের প্রথম সূর্যের কিরণ নদীর পানির উপর পড়ে দারুণ এক দৃশ্য দেখা গেলো। আমতলীর দিকে মূল রাস্তা না ধরে গিয়ে ছোট্ট একটা শর্টকাট ধরলাম। এদিকেই দেখলাম মজার এক ব্যাপার৷ ঠাসাভাবে বোনা ধানক্ষেতের মাঝে মাঝে কলাগাছ৷ গ্রামের ভেতরকার রাস্তা হলেও আরসিসি ঢালাই করা। ওপথ ধরে চলতে চলতেই মহাসড়কে উঠে পড়লাম।

বামে মোড় নিয়ে হাইওয়ে ধরেই আলাদীপুর। এইদিকের রাস্তা ভয়াবহ। রাস্তায় পিচ বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। ধুলাবালিতে নাজেহাল অবস্থা। হরিপুর পেরিয়েই পেলাম গাংনাই নদী। দেশের বেশিরভাগ জায়গাতেই চকবাজারের অস্তিত্ব থাকলেও এবার পেলাম কিচক বাজার। এখান থেকে কিছুদূর রাস্তা বেশ ভালো। বলরামপুর পার করেই জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা। রাজশাহী বা চাঁপাইনবাবগঞ্জ গিয়ে কালাই রুটি খাওয়ার আগেই সাক্ষাৎ কালাই উপজেলার দেখা পেয়ে গেলাম চলতি পথে। এদিকের রাস্তায় গাছ বলতে শুধুই তাল গাছ। আর মাঝে মাঝে মরুভূমির অনুভূতি জাগাচ্ছে জনাকতক খেজুর গাছ৷ রাস্তা আবারো খারাপ হতে শুরু করলো পুনট হাটের পরে৷১০ পর্বের মেঘলা আকাশ। সরাইল পেরিয়েই রাস্তার দু’পাশে খালি গোবর আর গোবর। খানিক বাদেই শিমুলতলী বাজার। বস্তা বস্তা আলু হিমাগারে নেওয়ার জন্য জড়ো করতে দেখলাম এক জায়গায়। ভ্যানভর্তি গোবর নিয়ে ছুটে চলা ভ্যানের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়৷ পাঁচশিরা বাজার পেরিয়েই সুদৃশ্য কালাই পৌরসভা কার্যালয়। চলতে চলতে ফরহান আর কাননের সঙ্গে নানান বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। মেডিকেলীয় ব্যাপার-স্যাপারই বেশি। ওয়ার্ড, প্রফেসর, হোস্টেল, ক্যাম্পাস ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার মাঝেই এক জায়গায় দেখলাম জুতার কবরস্থান। হরেক রকমের জুতা তাদের জীবনকাল শেষ করে এক ডোবার পাড়ে নিভৃতে পড়ে আছে।

আকাশ ছুঁতে চাওয়া কিছু ইউক্যালিপটাস গাছ ছায়াদান করে একটু স্বস্তি দিল ধুলাবালিতে জর্জর তিন যুবককে। বালাইটের পরেই শুরু হলো ক্ষেতলাল উপজেলা। উপজেলা জুড়ে প্রচুর সবুজ ক্ষেত পেলেও লাল ক্ষেতের দেখা মেলেনি। সুড়াইল মোড় ছাড়িয়ে নিশ্চিন্তা বাজারের কাছে এসে পেলাম মাটির দোতলা বাড়ি। দুই সঙ্গী কিছুটা ক্লান্ত থাকায় রাস্তার পাশের ঘাসে জিরোলাম কিছুক্ষণ। ..উঠেই আবিষ্কার করলাম ফরহানের ব্যাগে প্রমাণ সাইজের জোঁক। মাটির ঘর বাজার পেরিয়ে নিমতলী থেকে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন সায়হাম ভাই। ওনার বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলায়। বাকিটা পথ আমাদের সঙ্গেই হাঁটবেন।

ফরহান আর কাননের হাঁটাহাঁটির অভ্যেস নেই দেখে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই কষ্ট হচ্ছিল। বটতলী বাজারে দুপুরের খাবার পরে ওরা বিদায় নিল। প্রায় ২৭ কিমি হেঁটে ওরা দু’জন ওদের ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে গেলো। বাজার পেরিয়েই তুলসী গঙ্গা নদী। এরমধ্যেই জয়পুরহাটের ছড়াকার মোস্তফা আনসারি মামা ও মঞ্চকর্মী লালন ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ হচ্ছিল। সায়হাম ভাইয়ের সঙ্গে পাহাড়ের টুকিটাকি নিয়ে গল্প করতে করতেই পেরিয়ে গেলাম বানিয়া পাড়া, কোমরগ্রাম।

পাহাড়ের গল্প যেন শেষহবারই নয়। এই বিষয় নিয়ে কথা বললে ক্লান্তিও লাগে না। একে একে হিচমী বাজার, ব্র্যাক মোড় ছাড়িয়ে শহরের কাছ আসতেই আমাদের রিসিভ করলেন মোস্তফা মামা, লালন ভাই এবং সুমন ভাই। ওদের পিছু পিছু মধুমিতা সুইটমিটে যেতেই মামা প্যাড়া খাইয়ে দিলেন।

আমার আজকের আবাস সাজু ভাইয়ের বাড়ি। সামনের উঠোনে একচিলতে বাগান নিয়ে একতলা বাড়িটাতে ঢুকেই মন ভালো হয়ে গেলো। মামা এখানে ড্রপ করে যেতেই ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দারুণ আন্তরিক মোস্তফা মামা খানিক পর এসে নিয়ে গেলেন শহীদ আবুল কাশেম ময়দান সংলগ্ন লাইব্রেরি ক্লাবের সাংস্কৃতিক ভবনে। আমাকে ঘিরেই ছোটখাটো একটা বৈঠকি আড্ডার আয়োজন করা হয়েছে সেখানে৷ দারুণ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হলো সেখানে। ঘণ্টা দেড়েকের আড্ডায় আমার এই পদব্রজ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার আদ্যপান্ত জানালাম উপস্থিত সবাইকে। এরপর মোস্তফা মামার পিছু পিছু প্রেসক্লাবে৷

সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডার পর যখন সাজু ভাইয়ের বাড়ি ফিরেছি তখন আমাকে দেখার জন্য ওদের গোষ্ঠীর সব পিচ্চি-পাচ্চা, কিশোর-কিশোরী হাজির। চাচার বিয়ে উপলক্ষে এদের বেশিরভাগই এসেছে নানার বাড়ি৷ নানান কৌতূহলের জবাব দিতেই কে জানি আরটিভির রিপোর্টটা বের করে ফেললো। এবার শুরু হলো ঝপাং ঝপাং সেলফি। আর রাতে খাবার পরে পিচ্চিরা আসল অটোগ্রাফ চাইতে! আমি জীবনে কোনোদিন অটোগ্রাফ দেইনি। শুনে এসেছি অটোগ্রাফের দিন শেষ, এখন নাকি ফটোগ্রাফের দিন। আমার বেলায় ফটোগ্রাফ নেওয়া শেষে লোকে এলো অটোগ্রাফ চাইতে।

প্রথম ৩-৪ জনের বেলায় ওদের নাম দিয়ে কিছু একটা মিলিয়ে লিখে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। যেমন নয়নকে দু'চোখ ভরে দুনিয়া দেখার পরামর্শ দিলাম। সেতুকে লিখে দিলাম সব কিছুর মেলবন্ধন হওয়ার চেষ্টা করতে। শেষের দিকে বাকিদের যখন নামের সঙ্গে শুভেচ্ছাসহ লিখছি, ততক্ষণে জনপনের পিচ্চিকে অটোগ্রাফ দেওয়া শেষ।

চলবে...

আরও পড়ুন>>

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।