দিন ১৩
দেলুয়াবাড়ী (মান্দা, নওগাঁ)-নাচোল (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)-আমনুরা (চাঁপাইনবাবগঞ্জ)-জুমার পাড়া (তানোর, রাজশাহী)= ৪১.৮৯ কি. মি.
উত্তরবঙ্গে আসার পর থেকে মাটির দোতলা বাড়িগুলো দেখে দারুণ লোভ হচ্ছিল। আফসোস করছিলাম একটা দিন যদি থাকার সুযোগ মিলতো।
এদিকটায় ধান কাটা শেষ। ধানের বদলে বিলে আছে প্রচুর বক। বিলগুলো কেমন যেন ন্যাড়া ন্যাড়া। চাষিরা অবশ্য বসে নেই। আবার মাঠে নেমে জমি চাষোপযোগী করতে ব্যস্ত। বাঁকাপুর বাজার পেরিয়ে দারুণ সুন্দর একটা বিল। পানিতে থই থই করছে আর তার মাঝে মাথা উঁচিয়ে আছে কচুরিপানার স্তূপ। যেন একেকটা ভাসমান দ্বীপ। দূর্গাপুর ঘাট নামক একটা জায়গার গাছতলা খুব চেনা লাগলো। একটু পরেই মনে পড়লো এই জায়গায় আমি মাস দেড়েক আগেই এসেছি। কান্তি আর সুমন সেবার রাজশাহী থেকে পদ্ম বিল দেখাতে নিয়ে এসেছিল এখানে। চৌবাড়ীয়া থেকে ডানে মোড় নিয়ে এগোচ্ছি। কিছু জায়গায় সাইনবোর্ডে লেখা রাজশাহীর তানোর আর কিছু জায়গায় লেখা নওগাঁরমান্দা। ভেতরের দিকে হলেও খড়িবাড়ী সড়কটা বেশ ব্যস্ত।
হাঁটার সময় ক'জন স্কুল শিক্ষার্থী ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলো- হোয়াটস ইউর নেম? হোয়ার আর ইউ ফ্রম? আমিও ইংরেজিতে উত্তর দিয়ে তাদের কৌতূহল জিইয়ে রাখলাম। নাকইল থেকে প্রবেশ করলাম নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলায়। বেশ কিছুদূর যেতেই ক্লাস নাইন পড়ুয়া এক ছেলে আমার সমান্তরালে রাস্তার ওপাশে সাইকেল চালাতে চালাতে ঠারে ঠারে দেখছিল আমাকে। সাহস সঞ্চয় করে আমাকে প্রশ্ন করার পরে ওর সঙ্গে বিস্তর আলাপ হলো। হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর ব্যাপারটা ছেলেটাকে বেশ আন্দোলিত করলো। নিজের বাড়ির সামনে এসে ছেলেটা বিদায় নিল। দু'শ মিটারও সামনে এগোইনি এর মধ্যেই পেছন থেকে ডাক। বাড়ি থেকে মোবাইল নিয়ে এসে সেলফি তুলে রাখলো বন্ধুদের দেখাবে বলে। অল্প এগিয়ে বামে মোড় নিতেই সুন্দর একটা রাস্তা। হাতের ডানপাশে খাল আর রাস্তা দারুণ ছায়াঘেরা। বনগাঁ নামক জায়গা থেকে শুরু রাজশাহীর তানোর উপজেলা। এদিকে প্রচুর আদিবাসী গ্রাম। কুসুমপুকুর ছাড়াতেই রাস্তার দু'ধারে আমবাগান। চোরখৌর নামক অদ্ভুত নামের একটা জায়গা পেলাম। কেওয়া পাড়ার পর থেকে এদিকের বাড়িগুলোতে হাঁড়ি ঝুলতে দেখা যাচ্ছে।
এখানে সবাই হাঁড়িতেই কবুতর পালন করে। অনেকগুলো মাটির ঘর পেরিয়ে বিল্লী বাজার। বিল্লীর পর থেকেই শুরু চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা। নাচোলের নাম শুনলেই মাথায় চলে আসে তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ইলা মিত্রের কথা। এদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি পল্লী শিশু নিকেতন নামক বেশ ক'টা বেসরকারি বিদ্যালয়ও চোখে পড়লো। মাটির ঘর এখানেও প্রচুর। তবে এদের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য আছে। এই মাটির ঘরগুলোর দেয়ালে আঁকা আছে আল্পনা।
এক বাড়ির চালে চাল কুমড়া দেখতে দেখতে মাটির তৈরি মসজিদও দেখা হয়ে গেলো। আরো কিছুক্ষণ পা চালিয়ে হাটবাকইল বাজার। এ রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে হাতের বামের মাটির রাস্তা ধরলাম। দু'ধারে কৈশোর অনুত্তীর্ণ তাল গাছ জানান দিচ্ছে, এ রাস্তার বয়স খুব একটা বেশি নয়। চার কিমি পথ মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে উঠে পড়লাম পাকা সড়কে। বটতলা বাজার অতিক্রম করে লক্ষ্মীপুরের মোড়ের দিকে যখন এগোচ্ছি, তখন সাইকেলে চেপে যাওয়ার সময় এক কিশোর আমার ব্যাগের ঝুলতে থাকা স্ট্র্যাপ ধরে টান দিল। আমি বেশ খানিকটা হতভম্ব হয়ে গেছিলাম এ আচরণে। টংপাড়া হয়ে আমনুরা পৌঁছাতে সাড়ে চারটে প্রায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী আজকের হাঁটা এখানেই শেষ করার প্ল্যান থাকলেও হাতে সময় আছে দেখে এগিয়ে গেলাম খানিকটা। ঝিলিম বাজার অতিক্রম করে কলেজ পাড়া৷ এরপর থেকেই শুরু তানোর উপজেলা। জুমার পাড়া নামক জায়গায় আজকের মতো হাঁটা শেষ করে অ্যাপে দেখলাম আজ পাড়ি দিয়েছি ৪১.৮৯ কিমি পথ।
অটো/বাসচেপে চাঁপাই পৌঁছাতে সন্ধ্যা। নেমেই আশরাফুল ভাই আর আমিরের উষ্ণ আলিঙ্গনে। ফ্রেশ হয়ে এদিক সেদিক যেতেই বুঝতে পারলাম আমার আসার খবর আমির সবদিকেই চাউর করেছে। বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্ব শেষই হচ্ছে না। এক ফাঁকে ঘুরে আসলাম চাঁপাইতে কর্মরত আমার বোনের সহপাঠী তিথির বাসা। সহকারী বিচারক তিথি ওর ছাত্রাবস্থায় দেখা তিথির মতোই নরম-সরম স্বভাবের রয়ে গেছে এখনো৷ ওর বাসা থেকে আমরা তিনজন যখন আশরাফুল ভাইয়ের মেসে ফিরছি, রাত সাড়ে নয়টাতেই চাঁপাইয়ের রাস্তা-ঘাট সুনশান তখন।
চলবে...
আরও পড়ুন>>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২০
এএ