ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ১৭

ঈশ্বরদী (পাবনা)-ভেড়ামারা (কুষ্টিয়া)-দাশুড়িয়া (পাবনা)-মড়মী বটতলা মোড় (পাবনা)= ৩৫.৪৪ কিমি

তসলিম ভাইয়ের ভাই-ভাবিরা আগেরদিনই বলে রেখেছিলেন আজ যেন কোথাও না যাই। সঙ্গে ভাইপো-ভাইঝিদেরও আবদার।

ওনাদের সবার আজ ছুটির দিন। পুরোদিন আমার ভ্রমণের গল্প শুনবেন বলেই এই আদেশ নাজিল হলো। কিন্তু এভাবে অলস বসে থাকলেতো আর চলে না৷

সকালের হালকা গুমোট আবহাওয়াতেই যখন বেরুলাম তখন সবে সাড়ে ৬টা। স্টেশন রোড ধরে বাজারের দিকে যেতেই কাকা মিসাইলের (উড়ন্ত কাকের অব্যর্থ নিশানা) শিকার! হাতটা পরিষ্কার করেই বড়-সড় এক বটতলা পেয়ে গেলাম। জায়গার নাম ফকিরের বটতলা। আমার চুল-দাড়ি বড় থাকলে নির্ঘাত এই জায়গায় বাবাপোজে একটা ছবি তুলতাম।

ঈশ্বরদী বাজারের ফকিরের বটতলা।  ছবি: বাংলানিউজ

আজকের গন্তব্য কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা। ওখান থেকে ফিরতি পথে আবার ঈশ্বরদী। পুরো যাত্রায় আজই একটা রাস্তায় হাঁটার পুনরাবৃত্তি করতে হবে। গুগল ম্যাপ জানিয়ে দিল পোস্ট অফিস মোড় থেকে ডানে এগোলে পাওয়া যাবে শর্টকাট। এই রাস্তাটা উমিরপুর হয়ে রূপপুর মোড়ে গিয়ে মিশেছে৷ দেখা মিলছিল ভারী গামবুট আর হেলমেট পরা প্রচুর লোকের। সাইকেল কিংবা ভ্যানে চেপেছে। এরকম প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট পরা মানুষ দেখতে আমার দেশীয় চোখ অভ্যস্ত না। কৌতূহলী চোখ নিয়ে এদের দিকে তাকাতে তাকাতে একসময় বুঝলাম এরা সবাই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মী।

অল্প এগিয়েই উমিরপুর। এই রাস্তাটা বেশ নিরিবিলি। দারুণ সব বাড়ি রাস্তার দু'ধারে। বাড়ি পেরিয়ে পড়লো নারিকেল গাছের সারি। আরো এগোতেই ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের প্রভাবে নুইয়ে পড়া ধানক্ষেত দেখে মন খারাপ হলো।

উমিরপুরের রাস্তা।  ছবি: বাংলানিউজ

পথের বামপাশে খানিক উঁচুতে রেললাইন। এই রেললাইন পাকশী স্টেশন হয়ে এগিয়েছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজের দিকে। ইপিল ইপিল গাছের ঠাস বুনুনির মধ্যে দিয়ে ফোঁকর গলে ৭টা ৪০ নাগাদ সূর্যদেব মেঘ ফুঁড়ে তার উপস্থিতি জানান দিলেন। বাঘইল সাঁকোর মুখ হয়ে রূপপুর মোড়ের কাছে এসে মহাসড়কে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এহেন বিশাল কর্মযজ্ঞ কয়েক মাইল দূর থেকেও নজরে আসে। মানুষ আর যন্ত্র দুই-ই কাজ করে চলছে অবিরাম।

ঘাড় উঁচিয়ে অতিকায় সব ক্রেন দেখতে দেখতে পথ চলছি। ঘাড় নিচু করতেই চোখ গেলো স্থলে সার বেঁধে রাখা শত শত সাইকেল-মোটরসাইকেলে। এই পারমাণবিক কেন্দ্র ঘিরে ঈশ্বরদী ও এর আশপাশের এলাকার লোকজনের বিপুল কর্মসংস্থান হয়েছে। উর্দি পড়া সেনাবাহিনীর বেশ ক'জন করে সদস্যকে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক ফটকে। নিরাপত্তার কড়া ব্যবস্থা। এত নিরাপত্তার ফাঁক গলে বালিশ কেলেংকারি কীভাবে ঢুকে পড়েছিল কে জানে!

রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামনে সাইকেল-মোটরসাইকেলের সারি।  ছবি: বাংলানিউজ

হাঁটতে হাঁটতেই লালন শাহ সেতু। টোলপ্লাজার আগের চত্বর থেকে ডানে খানিক এগোলেই পাকশী স্টেশন আর তার সামনেই সাড়ম্বরে দাঁড়িয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। আবার গোল চত্বর হয়ে টোলপ্লাজার সামনে এবার। আগেই জানতাম এই সেতু দিয়ে হেঁটে চলাচল নিষিদ্ধ। সাইকেলও চলতে দেওয়া হয় না। ক্রস কান্ট্রি সাইক্লিং রাইডে সেবার আমরা গরুর ট্রাকে করে সেতু পার হয়েছিলাম, সেটা আমারখুব স্পষ্ট মনে আছে। আমি তাও একবার ওনাদের অনুরোধ করলাম। ওনারা এরপরে আমাকে একটা ভ্যানে তুলে দিলেন। এক ভাই বুদ্ধি দিয়েছিলেন, টোলপ্লাজার লোকের সামনে ভ্যানে উঠে মাঝ সেতুতে নেমে পড়তে। বেআইনি কিছু করার ইচ্ছে নেই দেখে সেসবে আর গেলাম না৷ অপর পাশের টোলপ্লাজায় অপেক্ষা করছিলেন কুষ্টিয়ার হাসান ইমাম ভাই। আমার সরঙ্গ হাঁটবেন বলে উনি কুষ্টিয়া শহর থেকে চলে এসেছেন। মহাসড়ক ধরে ভেড়ামারার রাস্তা। হাসান ভাই এখন কুষ্টিয়া থাকলেও ছোটবেলা কেটেছে ভেড়ামারাতেই। এটা-সেটা চেনাচ্ছেন উনি।

এই মহাসড়কটা বেশ প্রশস্ত। রাস্তার দু'পাশে কলাগাছ আর তার নিচের খাদে লিচুগাছ। অল্প বাদেই মহাসড়ক ছেড়ে ষোলদাগ নামক জায়গার সরু রাস্তাতে। এই সড়কটার দুপাশের বাড়িগুলো দারুণ। সবার বাড়ির সামনেই এক চিলতে করে কম-বেশি ফুলের বাগান। এক ভদ্রলোককে দেখলাম সাইকেলের ক্যারিয়ারে বস্তায় ভরে ছাগল নিয়ে যাচ্ছে। ভেড়ামারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কাছে এসে আবার মহাসড়কে। এই রাস্তার বাম পাশেই রেললাইন আর তার পরেই গঙ্গা প্রধান খাল। রেল লাইনটা যদিও এখন আর ব্যবহৃত হয় না।

লালন শাহ সেতু চত্বর।  ছবি: বাংলানিউজ

বাঁক ঘুরতেই চেয়ারম্যান মোড়৷ এক জায়গায় সাইনবোর্ডে দেখলাম ‘বাদক বেদনা বন্ধ’ তথা সন্তান না হওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়। সোজা রাস্তা ধরে এগোতেই ভেড়ামারা রেলস্টেশন। বেশ বড়-সড় এই স্টেশন পেরিয়ে ভেড়ামারার শাপলা চত্বর। খানিকক্ষণ এদিক-সেদিক ঘুরে একই পথ ধরে আবার ফেরা। মতিন হাট হয়ে আবার লালন শাহ সেতু। ফের ভ্যানে উঠতেই পুলিশ থামাল আমাদের ভ্যানচালককে। ভ্যানওয়ালা হাতে কিছু গুঁজে দিতেই তাকে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে কিছু অমূল্য উপদেশ দিয়ে পুলিশ মহোদয় বিদায় নিলেন।

গতকালের মতো বৃষ্টি না থাকলেও আজ বাতাস আছে বেশ। বাতাসের তাণ্ডবে লুঙ্গি পরিহিত অনেক পুরুষকে মেরিলিন মনরোর পোজে ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকতে দেখা গেলো। আবার রূপপুর এসে এবার ভেতরের রাস্তা ধরে না এগিয়ে মহাসড়ক ধরলাম। পরিকল্পনা ছিল ঈশ্বরদীতেই আজকের হাঁটার ইতি টানার। তবে হাতে প্রচুর সময় থাকায় আরো কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম৷ মহাসড়ক ধরে চলার পথে চোখে পড়ছে অনেক লিচু গাছ। রূপপুর আবাসিক হোটেল নামক একটি হোটেলের দেখা পেলাম যেখানে শুধু পুরুষদের থাকার ব্যবস্থা আছে। দিয়ার সাহাপুর পেরিয়ে চোখে পড়লো নির্মাণাধীন বিশাল সব ভবন। রূপপুরে কর্মরত বিদেশি নাগরিকদের জন্যই গড়ে তোলা হচ্ছে এ বিশাল ভবনগুলো। লিচু গাছের প্রাচুর্যের মধ্যে এ বিশাল অট্টালিকাগুলো বড্ড বেমানান।

রাস্তায় পেলাম কিংবদন্তি এক নারীর সাইনবোর্ডের দেখা। যিনি একই সঙ্গে মানুষ ও গবাদি পশুর চিকিৎসা করেন। সময়ে মিললো না বলে ওই নারীর পদধুলি নেওয়া হলো না। একে একে পার হলাম জয়নগর, মিরকামারী, চাঁদ আলী মোড়। দাশুড়িয়া থেকে ঢুকলাম হাতের বামে। ধান শুকানোর বড় সব চাতাল পড়ে আছে। অল্প যেতেই রেললাইন। আরো খানিকটা এগিয়ে মড়মী বটতলায় যখন আজকের দিনের হাঁটা শেষ করেছি ততক্ষণে এন্ডোমন্ডো অ্যাপ জানাচ্ছে পুরো দিনে হেঁটেছি ৩৫.৪৪ কিমি।

ঈশ্বরদী ফিরে গোসল সারতেই তসলিম ভাইয়ের বন্ধু সাংবাদিক ফেরদৌস ভাই বাইক নিয়ে হাজির। ওনার বাইকে চেপে রওয়ানা হলাম প্রেসক্লাব অভিমুখে। পথে গাট্টাগোট্টা একসাইকেল আরোহীকে দেখে থামলাম। আখাউড়া-মুজিবনগর ক্রস কান্ট্রি রাইডে বের হওয়া ছোট ভাই সতীশকে পেয়ে গেলাম। আর খানিক এগোতেই পেলাম নাসরিন আর শিউলি আপুকেও। সবাইকে নিয়েই এবার প্রেসক্লাবের উদ্দেশ্যে৷

আমার ও বাকিদের ভ্রমণের উদ্দেশ্য, এর প্রভাব, সচেতনতা ইত্যাদি নিয়ে কথা হলো সাংবাদিকদের সঙ্গে। সন্ধ্যা নামতেই স্টেশন চত্বরের ঘাসে বসে বাদাম চিবুলাম কিছুক্ষণ। ওদের সবারই সাইকেলে কম-বেশি কাজ করার ছিল বলে চলে গেলাম সাইকেল সারাইয়ের দোকানে। দোকানের বিপরীতেই ফকিরের বটতলা। এর নিচে পাতা বেঞ্চিতে বসেই অনেকদিন পর বেশ আড্ডা হলো।

খানিক বাদেই পাবনা থেকে চলে চলেন লনি ভাই আর তার বন্ধু। লনি ভাইয়ের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল বেশ ক'বছর আগে। চায়ের ফাঁকে ফাঁকে পাহাড় নিয়ে গল্প হচ্ছিল বেশ। চা পর্বের পরে ঈশ্বরদীর বিখ্যাত তৃপ্তি হোটেলে তৃপ্তি নিয়ে খাওয়া হলো নান আর হালিম। তৃপ্তি হোটেলের মজার একটা ব্যাপার আছে। স্টেশন লাগোয়া এই হোটেল ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকে বলে এর কোনো গেট/শাটার নেই। চালু হওয়ার পর থেকে ঈদ ছাড়া এই হোটেল কখনো বন্ধ থাকে না।

চলবে...

আরও পড়ুন>>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২০
এএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।