দিন ১৮
মাড়মী বটতলা (ঈশ্বরদী, পাবনা)-নওগাঁ বাজার (তাড়াশ, সিরাজগঞ্জ)= ৪১.৮৫ কিমি
পুরো রাতজুড়ে চলা ঈদে মিলাদুন্নবীর ওয়াজ এই ভোরেও শেষ হয়নি। তসলিম ভাইয়ের বাড়ি থেকে পথে নামতেই বিহারী পাড়ার লোকেদের চোস্ত উর্দু শুনতে শুনতে ভ্যানে চেপে চলে এলাম মাড়মী বটতলায়।
রাস্তায় লোক কিংবা যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। রাস্তার দশা অবশ্য বেহাল। মাঝের ফুটদুয়েক অংশে পিচ আছে, আর দুই পাশের পিচ ঝড়-বন্যায় উধাও। আরেক জায়গায় রাস্তার পাশের দু’টি গাছ গোড়াসহ রাস্তার কিছু অংশ নিয়ে উপড়ে পড়ে আছে পাশের পুকুরে। পাশেই অর্ধেক খুলে রাখা একটা প্যান্ডেলের বাঁশে দুষ্ট ছেলের দল ওঠা-নামা করছে।
সুলতানপুরের পরই দরগা বাজার। ওখান থেকে বামে মোড় নিয়ে পারখিদিরপুরের রাস্তায়। গত ক’দিন নানান ফসল দেখলেও শিমের ক্ষেত চোখে পড়েনি। এদিকে সারবদ্ধ শিমের ক্ষেত থেকে চোখ ফেরানো দায়। চলতি পথে এক মুরব্বি থামিয়ে জীবন-বৃত্তান্ত নিলেন। সব শুনে চোখ আক্ষরিক অর্থেই কপালে তুলে বললেন- এও কি সম্ভব? ধানি জমি ছাড়া অন্য জমিতে লিচু গাছের সংখ্যাই বেশি। পারখিদিরপুর থেকে কিছু অংশ পড়লো আটঘরিয়া উপজেলায়। এদিকে প্রত্যেক বাড়ির সামনে আর কিছু থাকুক না থাকুক, একটা খড়ের গাদা থাকবেই। বেশ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা পেরিয়ে রোকনপুর। এখান থেকেই শুরু হলো মাটির রাস্তা। এক ছেলে থামিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলো- 'লাইনের কাম কইরবার আইছেন?' কোন লাইন আমার তৎক্ষণাৎ বোধগম্য না হলেও সামনে কিছুদূর এগিয়ে রেললাইন দেখে লাইনের ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম।
ডি বি গ্রাম থেকে শুরু চাটমোহর উপজেলার সীমানা। খানিক পর মাটির রাস্তা থেকে পাকা রাস্তায় এসে পড়লাম। ধানক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর শিম গাছ। খানিক পরে বামে সঙ্গী হলো রেললাইন। গফুরাবাদ রেলস্টেশন পড়লো পথে। স্টেশনের পথ না ধরে মুন্নাফের মোড়ের পথ ধরলাম। রেললাইন ছিল এতক্ষণ হাতের বাম পাশে, এবার ডান পাশে পড়লো। রাস্তার পাশের একটা স্কুলে গেলাম। প্রধান শিক্ষককে আমার ভ্রমণের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলার পরে ভদ্রলোক বেশ শীতল আচরণ করায় বেরিয়ে এলাম। ভ্যানে স্পিকার বাজিয়ে টক ঝাল মিষ্টি জলপাইয়ের আচার বিক্রির বেশ চল আছে এদিকে।
দেবীপুরের পরে পড়লো অসাধারণ এক রাস্তা। ডি বি গ্রাম-কয়রাপাড়ার সংযোগকারী রাস্তা এটা। রাস্তার দু'পাশে দারুণ এক বিল। এই রাস্তার ধারে কিছু সময় বসে না থাকলে পাপ হতো৷ এতদিন ধরে শুনে আসা প্রশ্ন বাড়ি কোঠের স্থান নিল বাড়ি কদ্দুর। কয়েকটা জেলা পেরোতেই বদলে গেলো প্রশ্নের ধরন। বালুরদিয়ারের পরে রাস্তা চলে গেলো খড়ের দখলে। সবাই রাস্তায় খড় শুকাচ্ছে দেদারসে। চায়ের দোকানগুলোতে বেজায় ভিড়। চায়ের দোকান তো নয়, যেন একেকটা সিনেমা হল। বাহাদুরপুর, মথুরাপুর পার হয়ে তেনাছেড়া মোড়ে এসে পড়লাম বড় রাস্তায়। ভাদড়া বাইপাস থেকে ডানে মোড় নিলাম। এর মধ্যেই ফোন দিলেন চাটমোহর ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত শফিক ভাই। রাজারদিয়ার, উথুলী পার হয়ে ফায়ারসার্ভিস অফিসের সামনে। ভদ্রলোক দারুণ আন্তরিক। আমার সঙ্গে হেঁটে জাদ্রিস মোড় চলে আসলেন আর আপ্যায়ন করলেন চলনবিলের মাছ দিয়ে।
সামনে এগিয়েই বড়াল নদী। বিগত বছরগুলোতে এ নদী মরা থাকলেও গত বছর থেকে নদী শাসনের ফলে এটি পূর্ণ যৌবন ফিরে পেয়েছে। জীবননগর পেরিয়ে মহিতুল ভাইয়ের দোকান। উনি স্থানীয় সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত। চায়ের সঙ্গে এক দফা আড্ডা হলো তার সঙ্গেও। এর মধ্যেই বারবার কথা হচ্ছিল আরিফ ভাই আর ফরহান ভাইয়ের সঙ্গে। ওনাদের আজ আমার সঙ্গে হাঁটার কথা। কিন্তু বেলা গড়িয়ে দুপুর হলেও ওনাদের দেখা নেই তখনো।
জীবননগরের পরের রাস্তাটা সরল বিস্তৃতির। চরপাড়া, বিশিপাড়া পর্যন্ত অনেক লোকের বাস৷ দোদারিয়া ছাড়িয়েই দু'পাশেই চলনবিল। সঙ্গে বোনাস হিসেবে প্রচুর বাতাস। বাতাসের কারণে রাস্তাটা ইট বিছানো হলেও হাঁটতে কোনো বেগই পেতে হচ্ছে না। বিলের অধিকাংশ ধানই কাটা শেষ। খড় আঁটি বাঁধতেই ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক-কিষাণীরা। বওসা বাজারের পরে আত্রাই নদীর উপর নির্মিত ব্রিজ পার হলাম। আত্রাইকে সবশেষ পেয়েছিলাম দিন কয়েক আগে নওগাঁর মান্দায়। আজ আবারো দেখা হয়ে গেলো। রঙিন ছাতা হাতে এক বয়োজ্যেষ্ঠকে দেখা গেলো। তার পেছনে বিশাল লম্বা হাঁসের সারি। ভদ্রলোক যেন চলনবিলের হাঁসওয়ালা। চিনাভাতকুর বাজার পেরিয়ে আবারো আত্রাই নদী। চলনবিলকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে এই নদী।
আরো একটা সুন্দর ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম হান্ডিয়ালে। এদিকের বাজারগুলো দেখলাম মূলত বটগাছকেন্দ্রিক। বাজারের কেন্দ্রস্থলে বটগাছের উপস্থিতি লক্ষণীয়। হান্ডিয়াল বাজার পেরিয়ে ডানে ঘুরলাম। খানিক যেতেই গুগল ম্যাপ ধরে যেতে যেতে এক পুকুর পাড়ে উঠে গেলাম। এরপর আর যাওয়ার রাস্তা নেই। আবার ম্যাপ ধরে হাঁটা দিতেই এক গ্রামবাসীর রান্নাঘরের পেছনে। এদিকেও এগোবার পথ নেই। গুগলম্যাপের ভরসায় না থেকে স্থানীয় লোকের দেখিয়ে দেওয়া পথ ধরে আবার সঠিক রাস্তায়। খড় দিয়ে বানানো কাকতাড়ুয়ায় চোখ রাখতে রাখতে ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম নওগাঁ বাজারে। নাম নওগাঁ বাজার হলেও এর অবস্থান সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায়। আজকের হাঁটা এখানেই শেষ। আজ থাকার ব্যবস্থা তাড়াশ বাজারের কাছে পলাশ সূত্রধর ভাইয়ের বাসায়। ভ্যানে চেপে ওনার নির্দেশনার সূত্র ধরে চলে এলাম তাড়াশে। আমাদের আসা উপলক্ষে উনিও রওয়ানা দিয়েছেন ঢাকা থেকে। খানিক অপেক্ষার পর উনি চলে এলেন। এবার বাকি সময়টুকু অপেক্ষা আরিফ ভাই আর ফরহান ভাইয়ের জন্য। ওনারা আসতেই আবার ভ্যানে চেপে পলাশ ভাইয়ের বাড়ির গলিতে ঢুকছি তখন রাত আটটা।
চলবে…
আরও পড়ুন>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
বাংলাদেশ সময়: ১০২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০
এএ