দিন ২১
ধনবাড়ী (টাঙ্গাইল)-জামালপুর = ২৯.২৯ কিমি
ধনবাড়ীর নওয়াব বাড়ির নাম-ডাক অনেক আগেই শুনেছি। কাল বেশ রাত্তিরে পৌঁছানোতে সেদিকে আর যাওয়ার জো ছিল না।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি প্রথম দর্শনেই মুগ্ধতা ছড়ালো। পাশেই সুবিশাল দীঘি। মূল ফটকের বাইরে জুতা রেখে ভেতরে ঢুকতেই মসজিদের বাইরের বারান্দায় কোরান তেলাওয়াতে মশগুল বাচ্চাদের দেখা। হাতের ডানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কুয়াশাঘেরা দীঘি দেখলাম কিছুক্ষণ। মূল মসজিদের বিপরীতেই নওয়াবের কবর৷ রকি ভাই দিলেন খুবই ইন্টারেস্টিং একটি তথ্য। নওয়াবের কবরের পাশে পুরো বছরই ২৪ ঘণ্টা জুড়ে কেউ না কেউ কোরান তেলাওয়াত করে। এরকম ঘটনা আমি আগে শুনিনি কখনো। মসজিদ থেকে বেরিয়েই ধরলাম এন-৪। এই রাস্তাই আমাদের নিয়ে যাবে জামালপুর অভিমুখে। আজকের গন্তব্য জামালপুরের দূরত্ব ধনবাড়ী থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সকালে বেরুবার সময় রকি ভাইও বেরুলেন আমাদের সঙ্গে। কিছুক্ষণ আমাদের সঙ্গে হাঁটার ইচ্ছে তার। ফরহান ভাই আর খোকন দা তো আছেনই। আজ শুরু থেকেই বেশ কুয়াশা। শীতের লেশমাত্রও নেই যদিও। রুপশান্তি নামক বাজার পেরিয়ে বিলের পানিতে বেশকিছু শাপলা চোখে পড়লো৷ আরো খানিক এগিয়ে যেতেই যেন শাপলার রাজ্য৷ দারুণ লাগছিল দেখতে। নল্যা বাজার ছাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই সাংসারিক নানান টুকিটাকি বিক্রির উদ্দেশ্যে বের হওয়া তিন সাইকেল আরোহীর দেখা। জিনিসপত্রের ভিড়ে তাদের সাইকেলের মূল ফ্রেমই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। আরো আরো শাপলার দেখা বানিয়াজান বাজারের কাছে। বলদি আটা নামক এক মজার নামের বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়েই ছিনাবাড়ী সেতু।
সেতুর ওপার থেকেই জামালপুর জেলা। স্বাগতম জামালপুর লেখা তোরণে দারুণ ছন্দের এক ছোট ছড়া লেখা।
‘মাঠে শস্য, মঞ্চে নাট্য
কণ্ঠেভরা সুর,
সম্প্রীতি আর সূচের কাজে
শ্রেষ্ঠ জামালপুর৷’
তোরণের ওপারেই পলিথিনমুক্ত জামালপুর লেখা দেখে ভালো লাগাটা বেড়ে গেলো অনেকখানি। হাঁটতে হাঁটতেই খোকন দা জানালেন ধনবাড়ীও পলিথিনমুক্ত। গত রাতে কেনাকাটার সময় দোকানি ওনাকে এ তথ্য দিয়েছেন। অল্প এগিয়েই দিগপাইত উপ-শহর। রাস্তার ধারে পড়ে আছে কাটা কড়ই গাছ। রাস্তা সম্প্রসারণের কোপানলে পড়েছে এরা। গাছ না থাকায় দারুণ রোদে হাঁটতে হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের চেয়ে এদিকে এমনিতেই গরম বেশি। ছোনটিয়া মোড় পার হতেই জামালপুর ইপিজেডের নির্মীয়মাণ অঞ্চলে প্রবেশ করলাম। সুবিশাল এলাকাজুড়ে ইট, বালি, সিমেন্ট, খোয়ার রাজত্ব। দেখেই ধারণা করা যায় এই ইপিজেড চালু হলে পাল্টে যাবে এ এলাকার চেহারা। আদর্শ বটতলা পার হয়ে রঘুনাথপুর দিঘুলী।
আজ আরেকটা মজার ব্যাপার ঘটছে। যেখানেই চা পানের বিরতি নিচ্ছি, সেখানেই চা বিক্রেতা বেশ দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকে। আমরা চারজন মানুষ চার রকমের চায়ের ফরমায়েশ আমাদের। কারো চিনি ছাড়া চা, কারো লিকার চাসহ নানান ফ্যাকড়া। তবে আজকের পথটা ভয়ানক ধূলাবালিতে ভরা। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বিচ্ছিরি রাস্তা বলা চলে। সকালে কুয়াশার জন্য দূরের জিনিস দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর এখন এই মাঝ দুপুরে ধূলার জন্য দশ হাত দূরের জিনিস অস্পষ্ট। এর মধ্যেই নাক-মুখ ঢেকে আমাদের গল্প চলছে। কখনো রকি ভাই, কখনো ফরহান ভাই কিংবা কখনো খোকন দা এর সঙ্গে কথা ফুরোচ্ছেই না।
চোখ আটকালো একটি ঘোড়ার গাড়িতে। সাধারণত ঘোড়ার গাড়ির সামনে ঘোড়া থাকে। এটার সামনে-পেছনে দু’দিকেই ঘোড়া। জাংলা দেওয়া আমতলা হয়ে বিনন্দের পাড়া। মঙ্গলপুর ছাড়িয়ে অল্প এগিয়েই খোকন দা খানিকটা অসুস্থ বোধ করায় ওনাকে ভ্যানে তুলে দিলাম। টিউবওয়েল পাড় মোড় নামক একটা জায়গার পরই জামালপুর পৌর এলাকা শুরু। একে একে বেলটিয়া বাজার, খুপিবাড়ী পার হয়ে লুইসপার্ক। রকি ভাই জানালেন এটা এই অঞ্চলের অন্যতম বিনোদনকেন্দ্র। বিসিক পার হয়ে শেরপুর বাইপাসের কাছে আসতেই চলে এলো জামালপুর শেখ হাসিনা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র নাহিদ। তখন বাজে মোটে সাড়ে তিনটা। আজকের হাঁটার পরিসমাপ্তি টানলাম এখানেই। নাহিদের বাইকে চড়ে ওদের হোস্টেলের দিকে রওয়ানা হওয়ার আগে বিদায় দিলাম রকি ভাইকে। উনি ধনবাড়ী ফিরবেন।
সকালে ১৫-২০ মিনিট হাঁটার উদ্দেশ্যে বের হয়ে উনি পুরো রাস্তা হেঁটে চলে এসেছেন জামালপুর। মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাস দেখে চক্ষু চড়কগাছ। এত বিশাল মেডিক্যাল ক্যাম্পাস আর কোথাও চোখে পড়েনি। নাহিদের রুমে এই পুরো পদযত্রায় প্রথমবারের মতো বিকেলে বিছানায় পিঠ ঠেকানোর সুযোগ হলো। শেষ বিকেলে আনারুল ট্রেন স্টেশনে তুলে দিল ফরহান ভাইকে। তিন দিন সঙ্গ দেওয়ার পরে ভাইয়ের আজ বিদায়ের দিন৷রাতের দিকে নাহিদ আর আনারুলের বাইকে চেপে চক্কর দিলাম জামালপুর শহরে। একটা সোজা রাস্তা ধরেই পুরো শহর। জামালপুরের নামকরণ করা হয়েছে যার নামে সেই হযরত শাহজামালের মাজার দেখা হলো। জামালপুরের প্রখ্যাত ডিসি অফিস দেখে হাসপাতাল হয়ে মেলান্দহ এর চাচির চামালাই হাউজের বিখ্যাত মালাই চা পান করেই দিনের পরিক্রমা শেষ।
চলবে…
আরও পড়ুন>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০২০
এএ