দিন ২২
জামালপুর-নকলা (শেরপুর)- রামের কান্দি বাজার (নকলা, শেরপুর)= ৩৪.৫৮ কিমি
যেকোনো ছাত্রাবাসেই বৃহস্পতিবার রাত মানেই মোটামুটি চাঁদরাতের খুশি। পরদিন শুক্রবার বলে কথা।
কুয়াশার মধ্যেই হাঁটতে হাঁটতে সেতুলী ব্যাম্বো গার্ডেন। এরপরেই ব্রহ্মপুত্র নদ। কদিন আগেই পরিমল ভট্টাচার্যের শাংগ্রিলার খোঁজে বইটা পড়তে পড়তে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি তথা এর গতিপথ নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহ জন্মেছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে তিব্বতের সাংপো নদীই আমাদের ব্রহ্মপুত্র কিনা সে অনুসন্ধানে বেরিয়েছিলেন বেশ কজন ব্যক্তি। তার মধ্যে ছিলেন শরৎচন্দ্র নামে একজন। ইনি অবশ্য চট্টোপাধ্যায় নন, দাস। জন্ম চট্টগ্রামে। এই বইটা মুগ্ধতার মায়াজালে আটকে রেখেছিল বেশ ক'দিন। চোখের সামনে ভোরের প্রথম কিরণে এই নদী দেখে সেসব কাহিনীই মনের গহীন কোণে উঁকি দিচ্ছে। জামালপুর ব্রহ্মপুত্র ব্রিজের নিচে রোপণ করা হয়েছে ধান। কালচে মাটিতে সবুজ ধান কেমন জানি মানচিত্রের অনুভূতি জাগাচ্ছিল। ব্রিজের ওপারেই শেরপুর জেলা। বড় রাস্তা ছেড়ে ডানের ছোট রাস্তায় নামলাম আমরা। খোকন দা আজও আছেন সঙ্গী হিসেবে। এই রাস্তাটা দেখে আমাদের দু’জনের মুখেই হাসি। গতকাল মহাসড়কের ধূলাবালিতে প্রাণ জেরবার হয়ে গেছিল। আজ বেশিরভাগ পথই এই ছোট্ট রাস্তা ধরেই। এই সাতসকালেই ভ্যান বোঝাই সবজি নিয়ে কৃষক চলেছে বাজারের উদ্দেশ্যে। বলাইর চর, ফকিরগঞ্জ বাজার হয়ে একসময় পৌঁছে গেলাম চর সাহাব্দি। এদিকে রাস্তা আর তার দু'পাশ আরো সুন্দর। খোকন দা বলে উঠলেন, এসব রাস্তাই হয়তো স্বর্গে যাওয়ার রাস্তা।
এদিকে পাকা বাড়ির দেখা নেই একদম। বেশিরভাগ বাড়িই আপাদমস্তক টিনের তৈরি। শুধু নিচের দিকের ভিত্তির ফুট দুয়েক ইট-সুরকিতে বানানো। কুমড়ার চর পার হয়ে গেলাম আনন্দবাজারে। নাম আনন্দবাজার হলেও আনন্দ বিকিকিনির কোনো দোকান দৃষ্টিগোচর হলো না। একটি সুপারি গাছের তৈরি মাচায় বিশ্রামের লোভ সামলাতে না পেরে বসে পড়লেন খোকন দা। জিরোতে জিরোতেই লোকের কৌতূহল নিবৃত্ত করছিলাম আমরা।
কিলোমিটারখানেক এলাকাজুড়ে রাস্তার দুই ধারে পড়লো কাঁঠাল গাছ। জংগলদী পেরিয়ে মৃগী নদীর উপর সেতু পেরোলাম। এই নামের রোগের নাম জানা ছিল আগে। একইনামে নদী আছে সেটা জানা ছিল না। খুনুয়া হয়ে ভীমগঞ্জ বাজারে পৌঁছাতেই আগে থেকেই অপেক্ষারত রেদোয়ান আর মাহমুদের সঙ্গে দেখা। ওরা বাকি পথটুকু হাঁটবে আমাদের সঙ্গে। এই দুজন সবে এসএসসির গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হয়েছে এইচএসসিতে৷বীর মুক্তিযোদ্ধা আতিউর রহমান ডিগ্রি কলেজের মূল ফটকটা তৈরি নৌকার আদলে। ওখান থেকে হাতের বামে মোড় নিয়ে রঘুনাথপুর। সেলিম ভাই জামালপুরের দিকে আসার আগেই বলেছিলেন এদিকে লোকে বাড়ির একেবারে আঙিনাতেই প্রিয়জনের কবর দেয়৷ গোরস্থানে কবর দেওয়া কিংবা গোরস্থান দেখা যায় কম। জামালপুরে এই ব্যাপারটা চোখে না পড়লেও শেরপুরে এসে সেলিম ভাইয়ার কথার সত্যতা পেয়ে গেলাম। অবাক হলাম বেশকিছু পানের বরজ দেখে। এ অঞ্চলে পান চাষ হয় এ তথ্য জানা ছিল না। আন্ধারিয়া সুতিরপাড় পার হয়ে মাটির রাস্তায়। বেশ কদিন পরে আজ আবারো মাটির রাস্তা পেয়ে ভালোই লাগছিল। এতক্ষণ রাস্তার দু’পাশে ধানক্ষেত থাকলেও এবার খানিকটা সঙ্গ দিতে এলো অগুনতি কচুরিপানা। মাঝে কিলোমিটারখানেক পথ বালির রাস্তা। বালিতে পা দেবে যাওয়ায় এ রাস্তা দিয়ে চলতে বেগ পেতে হলো বেশি। ছোট একটি ব্রিজ পার হতেই শেরপুর সদর উপজেলা ছাড়িয়ে প্রবেশ করলাম নকলা উপজেলায়৷ খানিক বাদেই খোকন দা আজকের মতো হাঁটার ইস্তফা দিলেন। উনি ভ্যানে বাকিটা পথ এগিয়ে নকলাতে অপেক্ষা করবেন আমাদের জন্য৷ পথ চলতে চলতেই রেদোয়ান জানাল শেরপুরের প্রখ্যাত তুলসীমালা ধানের কথা। সুবিধাজনক একটা ক্ষেত দেখে চিনিয়েও দিল এই প্রজাতির ধান। কৃষ্ণপুর মধ্যপাড়া পার হতেই আদিগন্ত বিস্তৃত হলদে-সবুজ ধানের ক্ষেত। কিছুটা এগিয়েই মাত্র এক হাত পানিতে মাছ চাষ দেখলাম। এই অল্প পানিতেই বেশ বড় সাইজের রুই দেখা গেলো। গণপদ্দী বাজার থেকে শেরপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কে উঠে পড়লাম। জালালপুর ছাড়িয়ে আড়াইটা নাগাদ নকলা উপজেলা সদরে। ছিমছাম উপজেলা শহর।
হাতে আরো বেশ খানিকক্ষণ সময় থাকায় কালকের কিছু পথ এগিয়ে রাখার ছক এঁটে বেরুবার আগে বিদায় দিলাম মাহমুদকে। শেরপুরে ফিরে যাবে সে। খোকনদাকে এক জায়গায় অপেক্ষা করতে বলে আমি আর রেদোয়ান আবারো পথে৷ এই মহাসড়কে সোনার বাংলা পরিবহনের বাসের প্রচুর আনাগোনা৷ খানিক পরপর বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। এর অতিরিক্ত গতি মনে করিয়ে দিল চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটের মারছা পরিবহনকে। বাদাগৌড় মোড় পেরিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রেদোয়ানের মামা সাগর। ওনার বাড়ির পাশের ছোট রাস্তা ধরেই পরবর্তী পথ। এই রাস্তায় প্রচুর ছায়া। গাছগুলো নুইয়ে পড়ে মাথার উপর চাঁদোয়া তৈরি করেছে৷
রুনিগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে ফুটবল ম্যাচ ঘিরে বিশাল আয়োজন। খেলা তখনো শুরু না হলেও উৎসুক দর্শকের ভিড় মাঠের চারপাশে। রুনিগাঁও চৌরাস্তা মোড় পেরিয়ে মুক্তির বাজার। দৃষ্টিসুখকর রঙিন কাজ করা বাড়ির বাইরের দেওয়ালে চোখ বোলাতে বোলাতে রামেরকান্দি বাজার। আজকের দিনের হাঁটার ইতি এখানেই। । বাইকে করে এখান থেকে নিতে এলেন সাগর মামা।
রেদোয়ান আর আমি বাইকে চেপে বসতেই সাগর মামা আশপাশটা একবার ঘুরিয়ে দেখাতে চাইলেন৷ লোকে কত কিছু দেখে, আমরা দেখতে গেলাম কিনা কোল্ডস্টোরেজ! সাগর মামার বন্ধুর সৌজন্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের এই কোল্ডস্টোরেজে ঢুকে আমার চক্ষু চড়কগাছ৷ এত এত আলু! উত্তরবঙ্গে শত শত হিমাগার দেখলেও ভেতরটা ঘুরে দেখার সুযোগ মেলেনি। সাগর মামার বন্ধু নিয়ে গেলেন মূল চিলিং ঘরে। ভারী দরজার পাল্লা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই এক ঝাপটা ঠাণ্ডার পরশ চোখে-মুখে। কেরোসিন কাঠ নির্মিত তাকে থরে থরে সাজানো আলুরবস্তা। ভেতরের তাপমাত্রা দুই দশমিক দুই ডিগ্রি। ঠাণ্ডার অত্যাচারে বেশিক্ষণ থাকা গেলো না।
বাইকে চেপে নকলা উপজেলা সদরের হলপট্টিতে আসতেই পেয়ে গেলাম খোকন দাকে। মিনিট বিশেকের মধ্যেই খুঁজে পেলাম আপেল ভাইকে। উনি তাবাসসুম আপুর কাজিন হন সম্পর্কে। অধুনা পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন ইন্সপেকটর৷ একই সঙ্গে ঢাকা থেকে বদলি হয়ে আজ রাতেই চলে যাচ্ছেন খুলনাতে।
চলবে…
আরও পড়ুন>>
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১০৪২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০
এএ