দিন ২৪
ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা-বাংলা বাজার (নেত্রকোনা)= ৪৭.১৪ কিমি
আংকেল সকালে মন্ডা খাইয়ে ছাড়ার পরে এন্ডোমন্ডো চালু করতে করতে সকাল সাড়ে ৬টা। রেদোয়ান আর প্রান্ত ভাই আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন ব্রহ্মপুত্র সেতুর কাছের জয় বাংলা চত্বরে।
আমি চোখ সরু করে সাইকেলের দিকে তাকাতেই জানালো, সাইকেল ঠেলে ঠেলেই হাঁটবে। আজ খোকনদা'র চলে যাওয়ার দিন। সকালে উঠেই বাস ধরার কথা থাকলেও খানিকটা পথ হাঁটার লোভ উনি সামলাতে পারলেন না।
শম্ভুগঞ্জের কাছে আসতেই দু'পাশে ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আগেরদিনই জয়নুল সংগ্রহশালায় জয়নুলের ইকরা শম্ভুগঞ্জের কয়েকটা দারুণ স্কেচ দেখেছিলাম৷ সেই শম্ভুগঞ্জ আর এই শম্ভুগঞ্জ মেলাতেই পারছিলাম না। তবে এই ময়লাগুলো নিয়ে ময়মনসিংহের মেয়র সাহেবও নাকি বেশ উদ্বিগ্ন। সঙ্গী তিন ময়মনসিংহবাসীর কাছে এই তরুণ মেয়রের প্রশংসা শুনলাম ব্যাপক। তার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে ওরা দারুণ উচ্ছ্বসিত। অল্প এগিয়েই চায়না মোড়। এখানের টোলঘরের কাছ থেকেই গত তিনদিনের সঙ্গী খোকনদা বিদায় নিলেন। এই ক'দিন টানা একসঙ্গে থাকার ফলেই কিনা বিদায়বেলায় মন ভার হলো।
অল্প এগিয়েই চায়না টাউন। চীনে পড়াশোনা করা মাকিফ আছে বলেই এত এত চায়নিজ জায়গা চোখে পড়ছে কিনা কে জানে। পাথরভাঙ্গা বাজারের কাছেই এভারেস্ট নামক কম্বল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এই একটি পর্বতের নামে হেন কোনো বস্তু নেই যে বাজারজাত করা হয়নি। পানির বোতল থেকে শুরু করে উড়োজাহাজ কোম্পানীনি পর্যন্ত৷ স্বপ্না মোড়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহের পথ ধরলো মাকিফ।
রশিদপুর সদর পেরিয়ে ভাঙাড়ির দোকানে রিসাইকেল হওয়ার অপেক্ষায় শত শত বোতল চোখে পড়লো। স্বাগতম তারাকান্দা উপজেলা লেখা গেটের কাছে আমাদের এই উপজেলাতে স্বাগত জানালো শত শত শাপলা। ছোট্ট একটা ছাপড়া দোকানে সকালের নাশতা করতে করতে রেদোয়ান আবিষ্কার করলো এই দোকানের পেছন থেকে শাপলার বিলটা একদমই কাছে। এ যেন শাপলা ভিউ রেস্টুরেন্ট। গাছতলা বাজার হয়ে দয়ারামপুর যেতেই রাস্তা পিচ করার কাজের মাঝে পড়ে গেলাম। এখান থেকেই ফিরতি পথ ধরলেন প্রান্ত ভাই।
নির্বাচনী বাজার নামক জায়গা পেরিয়ে সাধু পাড়া৷ আজ রাস্তার দু'পাশে কোনো গাছ নেই। খুব সম্ভবত রাস্তা সম্প্রসারণের কাজের সময় কাটা পড়েছে। গাছ নেই তাই একটু ছায়াও নেই। একে একে পেরোলাম কাশীগঞ্জ বাজার, গজহরপুর, খিচা বাজার। রাস্তার বামে ধানক্ষেত আর ডান দিকে বেশির ভাগ সময়েই কচুরিপানার বহর। বেলতলী বাজারে আসতেই তারাকান্দা উপজেলার সীমানা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম গৌরীপুর উপজেলায়। চরপাড়ার পর থেকে বাম দিকে পড়লো মনাটি বিল। এখানেই অনেক দিন বাদে গরু দিয়ে হাল চাষ দেখলাম।
ট্রাক্টরের দৌরাত্ম্যে এই জিনিসের দেখা মেলা ভার। শ্যামগঞ্জের পরেই নেত্রকোনা উপজেলার পূর্বধলা উপজেলা। নেত্রকোনা গেটের কাছের ফিলিং স্টেশনে লেখা- ফিটনেসবিহীন গাড়িতে তেল সরবরাহ করা হয় না। পূর্বধলা উপজেলার নাম দেখেই মনে পড়লো ক্রাচের কর্নেলের কথা। ঝালশুকা নামক বাজার পেরিয়ে শ্যামগঞ্জ বাজার। খানিক আগে ময়মনসিংহেও পেয়েছি শ্যামগঞ্জ বাজার। এই বাজারের বেশিরভাগ দোকান-পাটই টিনের তৈরি। ঘরগুলোর দিকে নজর বুলালেই বোঝা যায় অনেক পুরনো বাজার। আয়তনেও বিশাল। বাজারের শেষ কোণে শ্যামগঞ্জ পাট বাজার অতীতে পাটের গৌরবের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
গোহালাকান্দার কাছে বিশাল সব ধান শুকানোর চাতাল। বেশকিছু জায়গায় নুড়ি উঠে আছে দেখে আমার আর রেদোয়ানের হাঁটতে বেশ বিরক্ত লাগছিল। ভবের বাজার পার হয়ে নারান্দিয়া বাজারের কাছে আসতে বিশাল সব রাইস মিল। ময়মনসিংহ-নেত্রকোনার রাস্তাটা আমার কাছে মনে হলো বড্ড রহস্যময়। রাস্তার কিছু অংশ খুবই ভালো আবার কিছু অংশ ভয়ংকর রকমের খারাপ। আরেকটা জিনিসের অভাবখুব অনুভূত হচ্ছিল। সেটা হলো মাইলফলক। এ পথের কোথাও নেই মাইলফলক। হিরণপুরের কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী অটোওয়ালাকে দেখালো রেদোয়ান। এক অটো বোঝাই করে পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্ছে সে। বাগড়া বাজারে কেউ বাগড়া না দেওয়ায় নির্বিঘ্নে চলে এলাম ঝাউসী। এখান থেকেই ডানপাশে সঙ্গী হলো রেললাইন।
চল্লিশা বাজার ছাড়িয়ে সামনে এগোতেই বামে মগড়া নদী। রাজেন্দ্রপুর হয়ে সাকুয়া বাজারের কাছাকাছি আসতেই রাস্তা রীতিমতো ভয়াবহ। বিজিবি সদর দপ্তর পেরিয়েই নেত্রকোনা পৌরসভার গেট। পারলা বাজার হয়ে ঢাকা বাসস্ট্যান্ড থেকে বিদায় নিল রেদোয়ান। আমার সঙ্গে ওর হাঁটার কথা ছিল একদিন। সে জায়গায় কি এক নেশায় পড়ে হাঁটলো তিনদিন। আনন্দ বাজার হয়ে শহরে ঢুকেই মগড়া নদীর উপর ছোট্ট একটা ব্রিজ। এরমধ্যেই মিষ্টি ব্যথা ওরফে আরমান ভাই ফোন করে জানিয়ে দিলেন ওনার অবস্থান।
কালীবাড়ি মোড়ে আসতেই উনি আমার ব্যাকপ্যাক রেখেই দিলেন একপ্রকার। নেত্রকোনায় আমার থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন বাপ্পী ভাইয়ের বন্ধু শাহীন ভাই। আরমান ভাই ঠিক এই সময়েই নেত্রকোনায় থাকাতে উনি বললেন ওনার বাসাতেই থেকে যেতে। দোটানায় পড়ে গেলেও নেত্রকোনা সরকারি কলেজে কর্মরত শাহীন ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে তাকে জানাতেই উনি বললেন আমার যেখানে ইচ্ছা সেখানেই উঠতে। মগড়ানদীর পাড়ের আরমান ভাইয়ের বসের বাড়িটাই জিতে গেলো।
আরো খানিকটা দিনের আলো থাকাতে ঠিক করেছিলাম আরো কিছুক্ষণ হাঁটবো। কলেজ থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম চলতেই পেছন থেকে ভাইয়া বলে ডাক এলো। নীলুফাকে দেখে বেশ অবাক হলাম। ক্যাম্পে একসঙ্গে চাকরির সুবাদে পরিচয়। ওর বাড়ি নেত্রকোনায় এটা জানা ছিল না। কথায় কথায় জানালো সে চল্লিশা বাজারে আমাকে হাঁটতে দেখেছে। আমি কিনা নিশ্চিত না হওয়ায় আর ডাক দেয়নি। সোজা রাস্তায় এগিয়ে থানার মোড় হয়ে তেরী বাজার। বারহাট্টার রাস্তা ধরেই যাত্রা। রাজুর বাজারে এসে মোড় নিলাম ডানে। খানিক এগিয়েই শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস। আধো আলো, আধো অন্ধকারে আরো কিছু সময় হেঁটে বাংলা বাজারের কাছে ইস্তফা টানলাম ছয়টা পনের নাগাদ।
অটোতে চেপে কালীবাড়ি মোড়ের বাড়িটায় ফিরে এসে ফ্রেশ হয়ে একটু এলিয়ে বসতেই দই নিয়ে এলেন আরমান ভাই। দই খেতে খেতেই আলাপ মামুন ভাই আর আলমগীর ভাইয়ের সঙ্গে। এর মধ্যেই চলে এলেন সায়েম ভাই। কক্সবাজারে আমাদের ফ্ল্যাটে মাঝে মাঝেই আসতেন উনি। এত দূরে এসে পরিচিত মুখ দেখে ভালোই লাগলো। আরমান ভাই তার রাঁধুনীসত্তা যে ভুলে যাননি তার প্রমাণস্বরূপ অসাধারণ বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে খাওয়ালেন রাতের খাবার।
কদিন ধরেই শুভাকাঙ্ক্ষীরা ফোনে বলছিল আমি নাকি বেশ শুকিয়ে গেছি। কেন জানি আমার আয়না দেখা খুব একটা হয় না। আজ আয়না দেখে খোকন দার পোস্টে করা কেউ একজনের কমেন্টটাই মনে পড়রো-
‘ধান শুকায় ঘাটায়,
মানুষ শুকায় হাঁটায়। ’
চলবে...
আরও পড়ুন
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২০
এএ