দিন ২৫
বাংলা বাজার (নেত্রকোনা)-ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ)-জয়শ্রী বাজার (ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ)= ৩৮.৮২ কিমি
বিগত ছয় দিন ধরেই কেউ না কেউ হাঁটার সঙ্গী হিসেবে ছিল। বেশিরভাগ দিনই একাধিক জন।
নানান রকম শব্দ করে গরুগুলোকে নির্দেশনা দিচ্ছে পেছনে থাকা কৃষক। দূর্গাশম, সতরশ্রী বাজার হয়ে ঠাকুরকোণা নামক ছোট্ট একটা রেলস্টেশন। স্টেশন ঘিরেই এর আশপাশে গড়ে উঠেছে বাজার।
বাজারের শেষ মাথায় ধনাইখালী নদী। সেতু পার হতেই কলমাকান্দার দিকনির্দেশক সওজের সাইনবোর্ড। কলমাকান্দা নিয়ে বেশ কিছু অম্ল-মধুর স্মৃতি আছে আমার। আট-নয় বছর আগে বন্ধুরা মিলে নেত্রকোনার বিরিশিরি এসেছিলাম। গুগলম্যাপ তখন এত উন্নতি করেনি৷ ভরসা ছিল বাসায় থাকা বাংলাদেশের মানচিত্র। ওখানেই দেখেছিলাম নেত্রকোনা আর সুনামগঞ্জ পাশাপাশি দুটো জেলা। ভেবেছিলাম নেত্রকোনা যখন যাচ্ছি সুনামগঞ্জটাও ঘুরে যাব এই ফাঁকে। তখনো জানতাম না এইদুই জেলা পাশাপাশি হলেও বর্ষায় সড়ক যোগাযোগ তখন নেই বললেই চলে। সেবারঅপ্রত্যাশিত এক রাত কাটাতে হয় কলমাকান্দা উপজেলায়। রাত ১০টায় যখন কলমাকান্দা পৌঁছি তখন পুরো উপজেলা সম্ভবত ঘুমে। উপজেলার সব কুকুর মিলে আমাদের এমন দৌড়ানি দিয়েছিল, পুরো সদর বার কয়েক চক্কর দেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এই নাম দেখে তাই খানিকটা নস্টালজিক হয়ে গেলাম।
দেউলি বাজার থেকে ঢুকে পড়লাম বারহাট্টা উপজেলার সীমানায়। রেললাইন এতক্ষণ ডানে থাকলেও নদী পেরোবার পরে পাশ বদল করে চলে গেলো বামে। প্রচুর আকাশমণি গাছ মাথার উপরের আকাশের দৃষ্টিসীমা কমিয়ে দিয়েছে। ফাঁকে ফাঁকে আছে শিশু গাছ। গোপালপুর বাজারে দেখলাম প্রচুর ছোট ছোট বাচ্চা স্বচ্ছ ফাইলে প্রবেশপত্র সমেত ঘুরছে। পিএসসি পরীক্ষার্থী এরা। বারহাট্টা বাজার থেকে দুই পথে ধর্মপাশা যাওয়া যায়। মোহনগঞ্জ হয়ে বড় রাস্তা ধরে কিংবা থানার পাশের গ্রামীণ পথ ধরে। বড় রাস্তায় হাঁটতে বিরক্ত লাগার কারণেই ছোট রাস্তা ধরলাম। যাত্রাপথে তালগাছের দেখা মিলছিল প্রচুর। থানা পেরিয়ে বামের রাস্তা ধরেই যাচ্ছি।
হাতের ডানদিকে সঙ্গী হলো খাল। কয়েক বছর আগেও উত্তরবঙ্গের ট্রেডমার্ক নসিমন-করিমন নামক গাড়ি দেদার ব্যবহৃত হতো যাত্রী পরিবহনের কাজে। অধুনা এরা ব্যবহৃত হচ্ছে গরুটানার কাজে৷
ইটের খোয়ার রাস্তা ধরেই পথ চলছি। ছোট ব্রিজ পেরিয়েই চন্দ্রপুর বাজার। তারপর ডান দিকে ঘুরে নিলাম মাটির রাস্তা। এই রাস্তায় একসঙ্গে একজনের বেশি হাঁটার জো নেই। হাঁটতে পারে একজনই। ১০০ টাকা, ১০০ টাকা বলে গলা ফাটিয়ে পিচ্চিরা মিছিল করছে এক জায়গায়। আমি খানিক অবাক হলাম। আর এত বিষয় থাকতে একশ টাকা কেন মিছিলের স্লোগান হলো সে রহস্য খানিক পরেই উন্মোচিত হলো। অটোতে মাইক লাগিয়ে ন্যাশনাল কোম্পানির ৩শ টাকার এনার্জি বাল্ব ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এই এলাকার অনেকগুলো পাকা কবরেই চার কোণে চারটা কলসি সিমেন্ট দিয়ে মূল দেয়ালের সঙ্গে লাগানো দেখলাম। এর কোনো আলাদা ব্যাখ্যা আছে কিনা কে জানে। খানিকটা পাকা রাস্তার পরে আবার মাটির রাস্তা। এ রাস্তাটায় এত ঘন গাছ যে প্রায় জায়গাতেই সূর্যের আলো মাটির ছোঁয়া পাচ্ছিল না।
অল্প এগিয়েই বিশাল এক ঝগড়ার একেবারে মাঝে গিয়ে পড়লাম। উৎসুক নয়নে কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে সেটা জানার জন্য এতগুলা মানুষের মাথার উপর উঁকি দিয়ে ঝুঁকিও নিলাম। স্কুল ফেরত দুই বালকের ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছে প্রতিবেশী দুই পরিবারও। একজন নাকি আরেকজনের মন্টুতে লাথি মেরেছে। ঝগড়ার বিষয়বস্তু শুনে আমি তাড়াতাড়ি প্রস্থান করলাম। সিংধা থেকে কিছু অংশ পড়লো মোহনগঞ্জ উপজেলায়। এর পরপরই শুরু সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা উপজেলা।
সুনামগঞ্জে ঢুকেই আবার পাকা রাস্তা। এই রাস্তাটা দেখতে ভারি সুন্দর। সাপের মতো একেবেঁকে এগিয়েছে ধানক্ষেতের মাঝে। এ পথ ধরেই চলে দেড়টা নাগাদ ধর্মপাশা। মধ্য ও পূর্ব বাজার পেরিয়ে ছায়াঘেরা একটা রাস্তায় এসে পড়লাম। হলিদাকান্দা পার হওয়ার পরেই হাওর এলাকায় প্রবেশ। দু'পাশের দৃশ্যপট গেছে পাল্টে। আদিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেতের জায়গা নিয়েছে নৌকা, মাছ ধরার নানান জাল, হাঁস ইত্যাদি। মহদীপুর বাজারে দেখলাম মেডিক্যালেরই জুনিয়র মেহেদীর চেম্বারের সাইনবোর্ড। পরিচিতজনেরা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে ভেবেই ভালো লাগলো। কান্দাপাড়া বাজার ছাড়াতেই যে রাস্তাটার প্রত্যাশা করছিলাম, সেটা পেয়ে গেলাম। পুরো বর্ষা পানিতে গাডুবিয়ে রেখে সদ্যই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে রাস্তাটা। দু'পাশে এখনো বেশ পানি আছে। প্রচুর নৌকা চলাচল হচ্ছে।
হাঁটা হচ্ছে কম, ছবি তোলা হচ্ছে বেশি! ভাঙা একটা সেতুর কাছে কয়েক শত হাঁসের প্যাকপ্যাক শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। এই রাস্তাটা ভালোই অবস্থাসম্পন্ন ছিল বলেই ধারণা। দু’ধারেই ছিল সিমেন্টের ব্লক। টানা বর্ষায় সেগুলো ভেঙে টুকরো হয়ে গিয়েছে। হাওরের পানিতে নৌকার প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে চলে এলাম জয়শ্রী বাজার। দুপায়ে পথচলার পরিসমাপ্তি আজকের মতো এখানেই।
আমার আজকের থাকার ব্যবস্থা ধর্মপাশায়। মুনীমের কাজিন কায়সার ভাই এর মধ্যেই ফোন দিয়েছেন বেশ কবার। আমাকে বাইকে করে কান্দাপাড়া পর্যন্ত এগোতে বললেন উনি। কান্দাপাড়ায় অপেক্ষা করছেন তিনি। বাকি পথ ওনার বাইকে চেপে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি। উনি একসময় চট্টগ্রামে চাকরি করার সুবাদে মেজবানী বিষয়ক আলোচনা জমে উঠতে সময় লাগলো না। মুনীমের চাচার সৌজন্যে হাওরের নানান মাছ দিয়ে ভরপেট রাতের খাবার।
চলবে...
আরও পড়ুন...
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১০০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২০
এএ