দিন ৩১
বাহুবল (হবিগঞ্জ)-নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)= ৪১.০১ কিমি
মাহফুজ আর ইন্তেখাব দু’জনেই পরিবার থেকে দূরে একা থাকলেও দু’জনে মিলে করলো আতিথেয়তার চূড়ান্ত। এই সাতসকালেও খেজুর-কাজু ইত্যাদি সব খাইয়েই ছাড়লো।
এই রাস্তায় বেশ কিছু আনারস বিক্রেতা চোখে পড়লো। থরে থরে সাজানো রসালো ফলে চোখ রাখতে রাখতেই মহাসড়ক ছেড়ে হাতের ডানের ছোট রাস্তায় নামলাম। এই রাস্তায় প্রচুর বালি। আশপাশের এলাকাগুলো অধুনা উপজেলা হওয়া শায়েস্তাগঞ্জে পড়লেও এই অংশটা পড়েছে আবার হবিগঞ্জ সদর উপজেলায়। একটু পরেই খোয়াই নদীর দেখা। বেইলি সেতুর উপর থেকেই লোকে বিশাল সুতা দিয়ে ছিপ ফেলেছে।
এত কষ্ট না করে পাড়ে বসে মাছ ধরলেই তো পারে এরা। খোয়াইয়ের ওপারেই শায়েস্তাগঞ্জ পুরনো বাজার। নতুনবাজারের তুলনায় রঙে-ঢঙে ম্রিয়মান বলা চলে। বাজারের মধ্যিখানে সুন্দর একটা মসজিদ। তার পাশেই বাল্লা রেলগেট। পুরো এলাকাটাই বেশ জমজমাট। শায়েস্তাগঞ্জ সম্প্রতি উপজেলা হলেও এর অবস্থানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই জায়গাটা। অন্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থাটা এখান থেকে সহজতর। ড্রাইভার বাজার ছাড়িয়ে আবার মহাসড়কে উঠে এলাম। এবার প্রথম থেকেই ডান পাশে আছে রেললাইন। মহাসড়কটাও বেশ ছায়াঘেরা। কড়ই গাছ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো দশাসই গাছ নেই। কদমতলী হয়ে সুতাং এর দিকে যেতেই সঙ্গী হলো হবিগঞ্জের রিয়াজ ভাই। খানিক বাদেই সুতাং নদী পড়ললো।
দেখতে শীর্ণকায় খাল যদিও এখন। কড়ই গাছের একাকিত্ব দূর করতেই কিনা সুতাং এর পর থেকে আকাশমণিও দেখা দিতে লাগলো। কিছুদূর গিয়েইহবিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। রিয়াজ ভাই জানাচ্ছিলেন এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হয়ে পুরো এলাকাটার চেহারাই গেছে পাল্টে। প্রাণ আর স্কয়ারের বিশাল সব স্থাপনা চোখে পড়ছে। কারখানা আর কর্মীদের কোয়ার্টারে সয়লাব জায়গাটা। অলিপুরের কাছেই রিয়াজ ভাইয়ের বন্ধু নিজাম ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। অলিপুরে সেলিম ভাইয়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে এক দফা চা-বিস্কুট খাওয়ালেন উনি। নিজাম ভাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর রিয়াজ ভাই আবার হাঁটা শুরু করলাম।
অল্প যেতেই প্রবেশ করলাম মাধবপুর উপজেলায়। দু-তিনটে ছোটখাট বাজার পেরিয়ে শাহজীবাজার৷ এই জায়গায় একটা পুরনো রেলস্টেশন আছে। তাজপুর থেকে হাতের ডানে বাঘাসুরার সড়ক ধরলাম আমরা। মহাসড়ক থেকে আপাত মুক্তি। পিচঢালা এই রাস্তা আমাদের নিয়ে যাবে মোড়াকরি বাজারে। রিয়াজ ভাই বৃন্দাবন কলেজের পলিটিক্যাল সায়েন্সের ছাত্র। এর পাশাপাশি যুক্ত আছেন নাটকের সঙ্গে। কদিন আগেই পশ্চিমবঙ্গে তার নাট্যদলের সঙ্গে চারটি শো করে এসেছেন। ৪৭ এর দেশভাগ নিয়ে লেখা নাটকটির নাম বিভাজন। সেসব নিয়েই আলোচনা করতে করতে একে একে পেরোলাম কালিকাপুর, বাঘাসুরা। কালীগঞ্জ বাজার থেকে বিদায় নিলেন রিয়াজ ভাই।
দিগন্তে আবছা টিলার প্রতিরূপ দেখেই পথ চলছি। ধরমন্ডল নামক স্থান থেকে প্রবেশ করলাম ব্রাক্ষণবাড়িয়ায়। একই সঙ্গে পরিবর্তন হয়ে গেলো বিভাগও। এখন পা রেখেছি চট্টগ্রাম বিভাগে। দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু বিল আর বিল। রাস্তার পাশের বাড়িগুলোতে কোনো মানুষ নেই। সবাই ব্যস্ত মাঠে। শত শত লোক ধান কাটছে বিলে। ধান বোঝাই করে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে মূলত কিশোরেরা। ধানের বোঝার আড়ালে তাদের মাথা দৃশ্যমান নয়। দৌলতপুর বাজারের কাছে পিএসসি পরীক্ষা ফেরত এক পিচ্চি আমাকে দেখে ডিজে নামে অভিহিত করলো।
এদিকের বাড়ীঘর সব টিনের তৈরি। ধানকাটা ছাড়াও আরেকদল লোককে দেখছি মাটি কাটায় ব্যস্ত। প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরে মাটি কাটার ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। রাস্তার যেসব অংশ ভেঙে গেছে সেসব অংশে মাটি ভরাট করার কাজটা এলাকার লোকেরা স্বেচ্ছাশ্রমেই করে দিচ্ছে। বেশ আনন্দ পেলাম এদের কার্যাবলী দেখে। সুবিদপুর, লক্ষ্মীপুর থেকে আবার ঢুকে পড়লাম হবিগঞ্জে। এবারের উপজেলার নাম লাখাই। বিলের পাশে খড় পোড়ানো চলছে সমানতালে। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট বেশ পুরনো এক মসজিদ পেলাম মোড়াকরি বাজারের কাছেই। যে জিনিসটা ভালো লাগল সেটা হলো এই মসজিদটা আধুনিকায়ন করা হলেও পুরনো অংশটুকুতে হাত দেওয়া হয়নি। অবিকল আগের মতোই রেখে দেওয়া হয়েছে। মোড়াকরি বাজার থেকে বড় রাস্তায়। বাজারের খানিক পরেই বলভদ্র নদী। বিশাল সব নৌকা ভেড়ানো তীরে৷ বলভদ্র সেতুর উপরে ম্যানুয়াল টোল প্লাজা দেখলাম। একটা বড় বাঁশ রাখা আছে ওই রাস্তার মুখে। টাকা দিলে হাত দিয়ে বাঁশটা তুলে দেয় ওখানের কর্মচারী। খানিক বাদেই একটা সরু খালের উপরে পাশাপাশি দুটো সেতু। একটা পরিত্যক্ত। ওই পরিত্যক্ত সেতুকেই ঘর-দোর বানিয়ে ফেলেছে একটি পরিবার৷ এই রাস্তায় প্রচুর সিএনজি চলে। শ্রীঘর নামক জায়গা পেরিয়ে খাল পেলাম একটা। খালে পানির পরিমাণ কম, কচুরিপানার পরিমাণ বেশি। সাড়ে চারটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম নাসিরনগর কলেজ মোড়ে। আজকের হাঁটার ইতি টানলাম এখানেই। আজ রাতে থাকার ব্যবস্থা সাকিব ভাইয়ের বাসায়। আমান ভাইকে ফোন করে কীভাবে যাবো সেটা জেনে নিলাম। উনি পথের দিশা জানাতেই লোকাল সিএনজিতে চেপে চৈয়ারকুড়ি বাজার। একে একে পরিচিত হলাম আমান ভাই, সাকিব ভাই, আকাশ ভাই, সঞ্জীব দার সঙ্গে। ওনারা জানালেন কাছেই নাকি আছে একটা জমিদার বাড়ি। হুমায়ুন আহমেদের শেষ চলচ্চিত্র ঘেটুপুত্র কমলার চিত্রায়ন হয়েছিল সেখানে। হরিপুর ইউনিয়নের এই জমিদার বাড়ি মিস করাটা উচিত হবে না বলে ওনারা সায় দিতেই আবার ওদিকে ছুট। সন্ধ্যার আঁধারে এর এ-গলি ও-গলিতে হাঁটতে গিয়ে ওদের কথাই ঠিক মনে হলো। তবে পিড়া দিল একটা ব্যাপার।
জমিদার বাড়ির ভেতরে বাস করছে আশপাশের প্রায় ১০০ ভূমিহীন পরিবার। এর মধ্যে অনেকে আবার ভেতরে টিনের ঘর বানিয়েছে আলাদা করে। এক কিশোরকে জিজ্ঞেস করলাম ক'বছর ধরে এখানে আছে সে৷ উত্তর এলো ওই কিশোরের জন্মই এখানে। ফিরতে পথে খেলাম শ্যামপুর বাজারের কাটাগজা আর চৈয়ারকুড়ি বাজারের আদর্শ গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রসমালাই। চৈয়ারকুড়ি বাজারে দেখা হলো নাজমুল ভাইয়ের সঙ্গে। ওদের সঙ্গে আরো একটা নবাব বাড়ি দেখে সাকিব ভাইয়ের বাড়ির পথ ধরতে ধরতে রাত আটটা।
চলবে...
আরও পড়ুন...
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২০
এএ