দিন ৩২
নাসিরনগর (ব্রাক্ষণবাড়িয়া)-ভৈরব (কিশোরগঞ্জ)= ৩৬.০৭ কিমি
সকাল সাতটা নাগাদ পায়ে পায়ে চলা শুরু নাসিরনগর কলেজ মোড় থেকে। কুয়াশার চাদর তখনও লেপ্টে আছে প্রকৃতির গায়ে।
এই রাস্তাটার সমান্তরালেই কাটা হয়েছে সরু প্রশস্ততার একটা খাল। সেচ কাজের সুবিধার জন্যই মূলত৷ এর পাড়েই এই হেমন্তকালে অসময়ের কাশফুল চোখে পড়লো। রাস্তার সঙ্গী হয়েই একদম সোজা এগিয়েছে খালটা। এই রাস্তাতে গাছ-গাছড়া নেই তেমন একটা। তার বদলে ঝোপ-ঝাড়ে ভর্তি। ঝোপের জন্য হাঁটার জায়গা পাওয়া মুশকিল। গাড়িকে সাইড দিতে গিয়ে ঝোপে ঢুকে পড়তে হচ্ছে মাঝে মধ্যেই। আর সেখানে আছে মূর্তিমান আতংক কাঁটাযুক্ত বরই গাছ।
আঞ্চলিক হাঁস প্রজনন খামারের বড়সড় ভবনের পরেই তুল্লাপাড়া। বিশাল অঞ্চল নিয়ে খামার হলেও এতে হ্যাচারি মোটে একটি। বাকিগুলো সব প্রশাসনিক ভবন, স্টাফ কোয়ার্টার, রেস্টহাউজ ইত্যাদি। কুন্ডা বাজারের কাছে আসতেই আমান ভাইয়ের ফোন। আজ কিছুটা পথ আমার সঙ্গী হবেন উনি৷ সেচকাজের জন্য খনন করা খালটি তখনো রাস্তার পাশে প্রবাহমান। এর কিছু অংশ গভীর আবার কিছু অংশে পায়ের গোড়ালিও ডোবে না।
পাশের গ্রামগুলোতে যাওয়ার জন্য এর উপর দিয়ে বানানো হয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট সেতু। তিতাস নদীর উপর কুন্ডা ব্রিজ। ওখানেই অপেক্ষা করছিলেন আমান ভাই। অদ্বৈতমল্লবর্মণের কিংবা ঋত্বিক ঘটকের তিতাস নদীটি এখন আর আগের সেই তিতাস নেই। তিতাস এখন ইটভাটার পাশের একটি নদীর নাম। দু’পাশে যতদূর চোখ যায় খালি ইটভাটা।
সেতুর ওপাশেই সরাইল উপজেলা। আদিগন্ত বিস্তৃত ধরন্তী বিল বেশ মনোলোভা। লোকে নাকি এই জায়গাকে মিনি কক্সবাজার নামেও ডাকে। আমান ভাই জানালেন বর্ষায় শুক্রবার নাকি তিল ধারণের জায়গা থাকে না রাস্তার দু’পাশে। পানি নেমে গিয়ে এখন অনেক জায়গায় শুরু হয়েছে চাষ। যেসব জায়গায় পানি আছে সেখানে লোকে মাছ ধরছে সোৎসাহে। সরাইল মোরগ লড়াই ও কুকুরের জন্য বিখ্যাত বলে জানতাম। আমান ভাই যুক্ত করলেন নতুন তথ্য।
দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্যও সরাইলের বেশ নাম-ডাক। দু’জন লোকের মধ্যে ঝগড়া লাগলে প্রায় সময়ই সেটা দুই পাড়ার লোকেদের শক্তি প্রদর্শনীর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ধরন্তী বিলের দু'পাশে রাস্তার পাশে তেমন কেন বাজার নেই। আছে শুধু ইটভাটার চিমনি। বর্ষা মৌসুমের আলসে সময় ঝেড়ে নতুন করে তৈরি হচ্ছে ইটভাটাগুলো।
মূলবর্গ চাকসারবাজারের পরে কালিকচ্ছ বাজার। এদিকের বাজারগুলোর দুটো অংশ থাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে। মূল সড়ক কিংবা মহাসড়কের উপরের বাজারের অংশের নাম হয় সড়ক বাজার। আর মূল বাজার থাকে সাধারণত আরেকটু ভেতরের দিকে। কালিকচ্ছ বাজারেই দেখা পেলাম বব মার্লের মতো দেখতে এক পাগলের। হাতে লাঠি থাকায় ছবি তোলার সাহস করিনি অবশ্য। অল্প কয়েক কদম হাঁটতেই বিজিবি এলাকা। এর পরের অংশটুকুতে প্রচুর পুকুর। মৎস্য চাষ এদিকে ভালোই জনপ্রিয়। আরেকটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো এখানকার অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বিদের নামের শেষাংশে সনাতন ধর্মাবলম্বিদের টাইটেল। মহাসড়ক ধরেই এগোনোর ইচ্ছা থাকায় সরাইল সদরে যাওয়ার পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। আমান ভাইয়ের বাড়ি সরাইলে হওয়ায় উনিই অনুরোধ করলেন একবার ঘুরে যেতে। কয়েক কিমি বেশি পথ হলেও না করলাম না।
বড় রাস্তা থেকে কলেজ রোডটা ধরে এগোলাম সদরের দিকে। প্রথমেই পড়লো সকাল বাজার। খানিক বাদে বিকাল বাজার। রাতের বাজারের উদ্দেশ্যে ইতি-উতি তাকালেও সে আশায় গুড়েবালি। আমান ভাই নিয়ে গেলেন আড়ি ফাইল নামক মসজিদে। ১৬৬২ সালে স্থাপিত তিন গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদটা প্রথম দর্শনেই প্রশান্তি জোগায়।
ডান পাশেই সাগর দীঘি। আর বাঁ দিকে আড়িফাইল মাজার তথা জোড়াকবর। স্থানীয়রা অবশ্য একে গায়েবি মাজার নামেই বেশি অভিহিত করেন। স্থানীয়ভাবে প্রচলিত আছে, রাতারাতি এই মাজার নির্মিত হয়েছে। নিজ সরাইল, পাঠান পাড়া হয়ে কুট্টাপাড়া মোড়। যেতে যেতেই একটা পাড়া দেখালেন আমান ভাই। বাজারের পাশের এই পাড়া এমনিতে জমজমাট থাকলেও রাস্তায় নারীরাই বেশি চলা-ফেরা করছে দেখলাম। গতকালের মারামারির জের ধরেপুলিশি ভয়ে রাস্তায় কোন পুরুষ দেখা গেল না। এখান থেকে বিশ্ব রোড একদম সন্নিকটেই। বিশ্বরোডে একদফা ভূরিভোজন শেষে বিদায় নিলেন আমান ভাই। খানিক দূর এগিয়েই মালিহাতা বাজার। রাস্তায় গাছ নেই, তাই নেই ছায়াও।
মহাসড়ক ধরে যতই এগোচ্ছি ততই ইটভাটার স্থলাভিষিক্ত হচ্ছে অটো রাইস মিলগুলো। এদিকের রাইস মিলগুলোর বিশেষত্ব হলো ধান শুকানোর জন্য এর বিশাল চাতালগুলো। শেরপুরের দিকে অনেক রাইস মিল দেখলেও সেগুলোতে এত বড় চাতাল ছিল না। বেড়তলা পেরিয়ে বগইর নামক স্থান থেকে আশুগঞ্জ উপজেলার শুরু। খড়িয়ালার কাছে শ্বেতপাথরের আবছা একটা স্মৃতিফলক জানান দিচ্ছে ঠিক এই জায়গাতেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান।
কামাউড়া পার হয়েবাহাদুরপুরের দিকে এগোতেই উঁকি দিতে শুরু করেছে কারখানাগুলোর প্রকাণ্ড দেহ আর ধোঁয়া নির্গমনের পাইপ। বিশাল এক পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপের ভেতর খেলতে ব্যস্ত দুই শিশুকে দেখলাম সোহাগপুরে। জুতার একপাশ ছিঁড়ে গেলো সোনারামপুরের কাছে এসে।
আশুগঞ্জের কাছেই চাতালকল নারী শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য গোছানো দিবাযত্ন কেন্দ্র দেখে মুগ্ধ হলাম। কেউ অন্তত এদের কথা ভেবেছে। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন রোডের মুখে সুন্দর একটা শহীদ মিনার পেরিয়ে রেলগেট। এখানেই দুই বৃদ্ধাকে হাতে ধরে রাস্তা পার করিয়ে দিল এক হিজড়া। দোকানে চাঁদাবাজি ছাড়া প্রকাশ্যে কোন ইতিবাচক কাজে এদের দেখে ভালোই লাগলো। মেঘনানদীর উপর নির্মিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু পেরিয়েই ভৈরব। এই সেতুর উপর দিয়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। ভৈরবে প্রবেশ করে একই সাথে পা রাখলাম কিশোরগঞ্জ জেলায় এবং ঢাকা বিভাগে। এই তিনদিনে তিনটা ভিন্ন বিভাগে পদার্পণ করেছি। অল্প এগিয়েই দুর্জয় মোড়। এখান এসেই ফোন দিলাম মাসুদ ভাইকে। উনি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ভৈরবে। উপজেলা পরিষদে কীভাবে আসতে হবে সে পথ বাতলে দিতেই কমলপুর হয়ে মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমি গন্তব্যে চলে এলাম।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল ভবনের নীচতলায় উনার অফিস। থাকেন দোতলায়। তার পাশের কক্ষটা পিয়নকে বলে সাফ-সুতরো করে দিতেই আমি বোঁচকা সমেত ওখানে।
সন্ধ্যার দিকে কুলিয়ারচর থেকে দেখা করতে চলে এলো মেহেদী ভাই। দুর্জয় মোড়ের কাছের সর্দার হোটেলে নিয়ে গিয়ে খাওয়ালেন দই, পেঁয়াজে ভরপুর মোগলাই আর কফি। খানিক বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেতে গিয়ে পরিচয় হল উপজেলার আরো বেশকিছু অফিসারের সঙ্গে। ভৈরবে প্রচুর জুতার দোকান এবং কারখানা থাকলেও মেঘনার ওপারে আমার জুতা ছিঁড়ে যাওয়ার পর পুরো রাস্তায় তীক্ষ্ণ নজর রাখা সত্ত্বেও দেখা মেলেনি কোনো মুচির।
চলবে...
আরও পড়ুন...
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১৬১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০
এএ/