ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০
 পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪) কুড়াইতলীর ভোর

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৩৪
কুড়াইতলী বাজার (পলাশ, নরসিংদী)-কালিগঞ্জ (গাজীপুর)-টঙ্গী (গাজীপুর) - আশুলিয়া বাজার (ঢাকা)= ৪০.৮১ কিমি

ডাবল কুসুমওয়ালা ডিমের সঙ্গে চা পান করেও সায়মন ভাই চর্ণগরদী বাজারে মালাইচায়ের প্রভূত সুনাম করাতে সেটাও না চেখে পারা গেলো না। গতকাল হাঁটা শেষকরে ছিলাম কুড়াইতলী বাজারে।

গতকালের বিকেলের বাজারের সঙ্গে আজ সকালের বাজারটা মেলানো গেলো না। সাত-আটটা দোকান মিলিয়ে তখন বড়জোর জনাবিশেক লোক ছিল বাজারে। আর এই সাতসকালে এই বাজারটাই ফ্রেশ সবজির বাজারে পরিণত হওয়ায় এখন লোকে লোকারণ্য।

হাঁটা শুরু করতেই অনেক মাছের ঘের চোখে পড়লো। নরসিংদীর বিখ্যাত কলাবাগান তো আছেই, এর ফাঁকে ফাঁকে বেশ কিছু আনারস বাগান। এই জায়গাতে আনারস বাগান দেখে খানিকটা অবাক হলাম। আর এই আনারস বাগানগুলো আলাদা কোনো জমিতে করা হয়েছে এমনও নয়। নিজেদের বসত-ভিটার সামনের জায়গাতেই লোকে চাষ করেছে আনারস। আজিম ভাইয়ের সঙ্গে ফোন কথা বলার সূত্রে জানতে পারলাম রাবান নামক এই জায়গাটা বিখ্যাত আনারসের জন্যই। নরসিংদীর অন্য অংশের তুলনায় খানিক উঁচু-নিচু আছে জায়গাটা।

রাস্তাটা মুগ্ধ করছে বেশ। মাথার উপরে যেন সবুজের ক্যাথেড্রাল। তার ফাঁক-ফোঁকড় গলে চলে আসা সূর্যরশ্মির দিকে চোখ রেখে পথচলা। খানিক এগিয়েই পাশের বিলে প্রচুর শাপলা। মাঝে কদিন নিয়মিত শাপলার দেখা পেলেও ময়মনসিংহ অঞ্চল পার হওয়ার পর আর দেখা মিলছিল না। চামড়াব নামক জায়গা পার হয়ে ঘোড়াশাল স্টেশন। ঘোড়াশালে শেষবার এসেছিলাম সাইকেলে চেপে। বই-পত্রে ঘোড়াশাল নিয়ে এটা-সেটা পড়ে এই জায়গাটা নিয়ে একটা কল্পনার জগত ছিল মনে। ইচ্ছে ছিল এখানেই রাত্রিযাপনের। আসার পরে জানতে পেরেছিলাম থাকার কোনো ব্যবস্থাই নেই এখানে। বিফল মনোরথে সেবার থাকতে হয়েছিল গাজীপুর চৌরাস্তার ভয়াবহ এক হোটেলে।  রাবানের আনারস ক্ষেত। শীতলক্ষ্যার উপরের শহীদ ময়েজ উদ্দীন সেতু পেরিয়েই গাজীপুরের কালিগঞ্জ উপজেলা। নদীর ওপাড়ে বিশাল সব কল-কারখানা। বিকটাকৃতির সিমেন্ট কারখানা দেখলাম একটা। আর দেখলাম আশপাশের এলাকার পচনশীল-অপচনশীল সব ময়লা নির্দ্বিধায় ভাসানো হচ্ছে শীতলক্ষ্যার জলে।

ডানে রেললাইন নিয়ে চলতে চলতে একসময় গোলাবাড়ী। খানিক বাদেই মোটরসাইকেল নিয়ে নরসিংদী থেকে চলে এলেন আজিম ভাই। পূবাইল কলেজের শিক্ষক এই ভদ্রলোককে আমার নরসিংদী এসে ফোন করার কথা। নানান ঝামেলায় আমি ভুলে গেলেও উনি ভোলেননি। সকালে কলেজ যাওয়ার পথেই দেখা করতে চলে এসেছেন। চা-নাশতার ফাঁকে প্লাস্টিক নিয়েই গল্প হলো বেশি৷ দুপুরের খাবার দাওয়াত ওনার কলেজের সামনেই করার আমন্ত্রণ জানিয়ে উনি বিদায় নিতেই আমি আবারো হাঁটা শুরু করলাম। মুনসুরপুর হয়ে শ্রমিক কলেজ মোড় চলে এলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। খুব ব্যস্ত এই মহাসড়ক ধরে হাঁটলেও আজ হাঁটার গতি অপেক্ষাকৃত ভালোই। একে একে পার হলাম কাপাসিয়া মোড়, তুমিলিয়া।

'মামা, কই যাইবেন?- এই প্রশ্নটাই জানান দিচ্ছে ঢাকার দিকেই এগোচ্ছি। আমি একবার নিজ মামার সামনে রিকশাওয়ালাকে মামা সম্বোধন করে খানিক পরিচয় সংকটে পড়েছিলাম। সেন্ট জন'স চার্চ, চুয়ারিয়াখোলা হয়ে বান্দাখোলার কাছে আসতেই সঙ্গী হলেন রনি ভাই। দিনের পরবর্তী সময়টুকু উনি যতদূর সম্ভব হাঁটবেন আজ। রেললাইন এতক্ষণ হাতের ডানে থাকলেও দড়িপাড়া লেভেল ক্রসিং থেকে চলে এলো হাতের বামে। রাস্তার একদম পাশঘেঁষা প্রচুর কলাগাছ। রাস্তার পাশে এত কলাগাছ নরসিংদীতেও দেখিনি।

পূবাইল স্টেশন হয়ে কলেজ মোড় এসে ফোন দিলাম আজিম ভাইকে। আজ দুপুরের খাবার আজিম ভাইয়ের সৌজন্যে। খানিক বাদেই আবার পথে নামলাম। মীরেরবাজার, তালটিয়া হয়ে পৌঁছে গেলাম মাজু খান বাজারে। এদিকে রাস্তার দুপাশে দেখার মতো তেমন কিছুই নেই। খালি দোকান-পাট আর বড় সব দালান। শীতলক্ষ্যার তীরের আবর্জনার স্তূপনিমতলায় অপেক্ষা করছিলেন রফিক ভাই। নরসিংদীর পলাশের এই বাসিন্দা সেই পলাশ থেকে চলে এসেছেন এদিকে। সুপ্রভাত পলাশ নামক একটি সংগঠন চালান উনি। সেসব নিয়ে কথার ফাঁকে চলে এলাম টিঅ্যান্ডটি বাজার। টঙ্গী স্টেশনের কাছে এসেই ফোন দিলাম শাহরিয়ার ভাইকে। এই মানুষটার সঙ্গে আমার দেখা হওয়ার কথা ছিল কিংবা দেখা হওয়া উচিত ছিল বান্দরবানে। কিন্তু শেষমেষ দেখা হলো কিনা টঙ্গীতে। তার পিছু পিছু চলে গেলাম স্টেশন থেকে মিনিট দুয়েকের দূরত্বের চেঞ্জ দ্যা লাইভস ফাউন্ডেশনে। মূলত রেললাইনের ধারের পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে সংগঠনটি।

এর নেপথ্যে আছেন আরেক পাগলাটে লোক রাসেল ভাই। আমি যখন এর আঙিনায় ঢুকেছি তখন ক্রিকেট খেলা হচ্ছে ধুমসে। শাহরিয়ার ভাই আগেই আমার কথা বলে রেখেছিলেন ওদের। হাজারো কৌতূহলী প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তুললো আমাকে। এক পিচ্চি জানতে চাইলো- 'আপনার পায়ে কি চাক্কা লাগাইছেন?' আমি কেন হাঁটছি এই প্রশ্নের জবাবে বাচ্চাদের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার নিয়ে বললাম কিছুক্ষণ। তবে সব পাগলাটে লোক এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত বলে এর আঙিনার কোথাও নেই একটুকরো ময়লা। শাহরিয়ার ভাই, অন্তর ভাই, আপু আর বাচ্চাদের কাছ থেকে বিদায়নিয়ে আবারো পথে।

অল্প এগিয়ে শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে গিয়ে অপেক্ষা করছিল আরেক সারপ্রাইজ। টঙ্গীর নিজাম ভাই আরো দশ-বারো জনকে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন ওখানে। আমি আসছি শুনে বিকেলের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার টিকিটও করেছেন ক্যানসেল। বেশি অবাক হয়েছি মতিঝিল থেকে মনির ভাই চলে আসাতে। ফুল-কেক মিলিয়ে আয়োজনের চূড়ান্ত। কেকের উপর আবার লেখা 'বাবরের বান্দরামী'!কালিগঞ্জের রাস্তাসবার সঙ্গে এক টুকরো করে কেক মুখে দিয়ে বিদায় দিলাম রফিক ভাই আর রনি ভাইকে। দিনের আলো প্রায় শেষের দিকে হলেও তখনো সাকুল্যে হেঁটেছি ৩২ কিমির মতো। নানান জায়গায় থেমে কিছুটা হলেও সময়ের তুলনায় পিছিয়ে আছি। ওখান থেকে বেরিয়ে হাঁটা ধরলাম। এবার সঙ্গী নিজাম ভাই, হাসান ভাই, মাসুম ভাইরা। যথেষ্ট পা চালিয়েই হাঁটতে শুরু করলাম। বার দুয়েক তুরাগের উপর নির্মিত ব্রিজ পার হতে হলো। চারপাশে ধুলা আর ধুলা। আর জায়গায় জায়গায় ময়লা ফেলার জায়গায় ভয়াবহ দুর্গন্ধ। গত ৩৩ দিনেও এত ধুলার সম্মুখীন হইনি সব মিলিয়ে। ধউরের পরে দু’পাশে শুধু বিল আর বিল৷ আর ডানপাশে বিলের মাঝে মাথা উঁচিয়ে আছে ইটভাটাগুলো।
আশুলিয়া বাজারের কাছে হাঁটা শেষ করলাম সোয়া ছয়টা নাগাদ। চেঞ্জ দ্য লাইভস ফাউন্ডেশনের বাচ্চাদের সঙ্গেআজ থাকবো উত্তরাতে বান্ধবী শবনমের বাসায়। বাকি পথটুকু বাসে চেপে আজমপুর বাসস্ট্যান্ড৷ এখানে আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন বাংলানিউজের সাংবাদিক আজিম রানা ভাই, মাহবুব ভাই, জনি ভাই আর রাজীব ভাই। পরিত্যক্ত এক দোকানের ভাঙা ইটে বসে চায়ের ফাঁকে আড্ডার মাঝেই চলে এলেন আরিফ ভাই। ওনাকে একজোড়া জুতা আনতে বলেছিলাম। উনি সঙ্গে একটি টিশার্টও নিয়ে চলে এসেছেন। খানিক বাদেই দেখা দিলেন আশরাফুল ভাই। ভাবিসমেত এসে এক বোতল মধু হস্তগত করে উনি বিদায় নিতেই আমি ৩ নম্বর সেক্টরে শবনমের বাসার পথ ধরলাম। দুজনে মিলে বন্ধু-বান্ধবদের প্রেম-বিয়ে নিয়ে প্রচুর পরচর্চাতে একনিষ্ঠ শ্রোতার ভূমিকায় ছিলেন তাসনীম ভাই।

চলবে...

আরও পড়ুন...​

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)

পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।