দিন ৩৬
মানিকগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ- আলাদীপুর (রাজবাড়ী)=৪৬.১৫ কিলোমিটার
পুরো পদযাত্রায় এই প্রথমবারের মতো সকালে বেরোবার সময় দরজা-জানালা-ব্যালকনি ভালোমতো চেক করে মূল দরজায় তালা মেরে রাস্তায় নামার অভিজ্ঞতা হলো। ব্যবসায়িক কাজে মানিকগঞ্জে পৌঁছে আগের রাতেই মুজিব ভাই কুয়াকাটা অভিমুখে রওনা দেওয়ায় উনার ফ্ল্যাটে তখন শুধু আশরাফুল আর আমি।
সুন্দর একটা সকালে দারুণ একটা সূর্যোদয় দেখতে দেখতে চলে এলেন সাংবাদিক চন্দন ভাই আর সোহেল ভাই। উনারাও সঙ্গী হবেন আমাদের। তবে মোটরসাইকেলে। নদীর ওপাড়েই প্রচুর রেস্টুরেন্ট। তৌফিক ভাই জানালেন বিকেলে বেশ জমজমাট থাকে নদীর তীরঘেঁষা এসব রেস্টুরেন্ট। আন্ধারমানিক নামক জায়গা পেরিয়েই শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে প্রবেশ করলাম। মানিকগঞ্জ শহর থেকে গ্রামের দূরত্ব খুব একটা বেশি না। জয়নগরের দিকে দেখা মিলল প্রচুর গাছের। খানিক বাদেই পৌঁছে গেলাম শিক্ষার আলো পাঠশালায়। বাচ্চারা আমাদের জন্য পাঠশালার সামনেই প্লাস্টিক সচেতনতা বিষয়ক প্ল্যাকার্ড নিয়ে অপেক্ষা করছিল। এই সামাজিক সংগঠনটি চালান সানী রহমান মিন্টু ভাই। ২০১১ থেকে যাত্রা শুরু করে এ পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় লেভেলে ৬০০ শিক্ষার্থীকে স্কুলের বাইরে বিনামূল্যে পাঠদানে সহায়তা করেছেন তিনি। এ কাজের স্বীকৃতিস্বরুপ ২০১৮ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে পেয়েছেন জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড।
আমার পদযাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বাচ্চাদের জানিয়ে পাঠশালা প্রাঙ্গণেই রোপণ করলাম দুটি চারা। ইতোমধ্যে সাভার থেকে রওনা দিয়ে চলে এসেছেন খোকন দা। সকালের নাশতাটা এখানেই সেরে আবার হাঁটা শুরু করতেই আমার সঙ্গে তখন আরও বেশ ক'জন। পাঠশালায় প্রবেশের পর থেকে এখানেই কেটে গেছে দুটি ঘণ্টা। মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। আমার আজকের দুই ঘণ্টা হাঁটার সঙ্গী আশরাফুল আর খোকন দা ছাড়াও শিক্ষার আলো পাঠশালার আরও বেশ ক'জন। একসঙ্গে এত লোক হাঁটছে আমার সঙ্গে, এটা ভেবেই বেশ থ্রিল অনুভব করলাম। ধাপ কাটা বেশকিছু খেজুর গাছ অতিক্রম করে প্রবেশ করলাম মুন্নু সিটিতে। সাবেক মন্ত্রী মুন্নু এখানে গড়ে তুলেছেন প্রচুর প্রতিষ্ঠান। শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে মেডিক্যাল কলেজ, কী নেই এখানে! মেডিক্যাল কলেজের সামনে দিয়ে মহাসড়কে। ঘিওর উপজেলার শুরু এখান থেকেই। প্রথমেই পড়ল বানিয়াজুরী। ভয়াবহ গতিতে কানের পাশে হাওয়া লাগিয়ে ছুটে যাচ্ছে বাস- ট্রাকগুলো। বামে মোড় নিলাম পুখরিয়া বাস স্টপ থেকে। মহাসড়ক ছেড়ে গ্রামের ভেতরের রাস্তা দিয়েই এগোনোর প্ল্যান। পিচ করা রাস্তা ইটের সলিং হয়ে একসময় রূপ নিলো মাটির রাস্তায়। দু'পাশে বাঁশবাগান। কিলোমিটার দুয়েক খানেক যেতেই গুগল ম্যাপের দেখানো পথের সঙ্গে বাস্তবের সামঞ্জস্যতা না থাকায় মহাসড়ক ধরতেই হলো। মাঝখানে পড়ে সময় নষ্ট হলো আরও বেশ কিছুটা।
শিবালয় উপজেলার শুরু মহাদেবপুর থেকে। বেশকিছু গাড়ির কঙ্কাল নিয়ে যেতে দেখলাম মহাসড়ক ধরে। বরংগাইলের কাছে সওজের একটা সাইনবোর্ড জানান দিচ্ছে, এই রাস্তায় ৪০০ ঘনফুটের বেশি বালি/পাথর কিংবা ১০ চাকার ট্রাক চলা নিষেধ। একই রাস্তায় খানিক পরে লেখা ৩০০ ঘনফুটের বেশি বালি/পাথর কিংবা ৬ চাকার ট্রাক চলা নিষেধ। ১০ চাকার ট্রাক একই রাস্তায় কিলোমিটার দুয়েক চলে ৪টা চাকা খুলে নেবে কি-না সেই নিষ্পাপ আলোচনায় লিপ্ত হলাম আমরা। ফলসাটিয়ার পরে পেলাম অক্সিজেন রিসোর্ট নামক একখানা রিসোর্ট।
চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম টেপড়া বাস স্ট্যান্ডে বসে। আমাদের হাঁটাহাঁটি দেখে এক লোক জিজ্ঞেস করলেন- 'এ আবার কেমন শখ?' অল্প পরেই পেলাম ইছামতি নদী। চট্টগ্রামে ঠিক এই নামেই আছে একটা নদী। সেতু পেরিয়ে উথুলী বাজারের কাছে হাতের বামের ছোট শর্টকাট নিলাম। নবগ্রামের কাছে আখের রস দেখে খোকন দা থেমে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে। আখের রস খেয়ে চাঙা হয়ে আবার হণ্টন।
আজকের দিনটা বেশ ফলময় যাচ্ছে। দুপুরে রসে টইটুম্বুর জাম্বুরার পরে এখন এই আখের রস। 'ধরবো না আর জাটকা, ইলিশ খাবো টাটকা'- লেখা সাইনবোর্ড আছে পাটুরিয়া ফেরীঘাটের কাছে। অল্প পরেই পাটুরিয়া ফেরিঘাট। আজ পেরোতে হবে পদ্মা। এপথে ফেরিই একমাত্র বাহন। ফেরি চেপে বসার খানিক বাদে ফেরি রওনা দিল ওপাড়ের দৌলতদিয়া ঘাটের উদ্দেশে। পদ্মার ওপর চোখ বুলাতে বুলাতেই ওপাশে।
ফেরি ভিড়তেই প্রবেশ করলাম নতুন একটা জেলায়। রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলায় স্বাগত জানাল ফেরির জন্য অপেক্ষারত লাইন ধরে দাঁড়ানো শত শত বাস-ট্রাক। সেসবের ফোঁকর গলে মূল হাইওয়েতে যেতে যেতেই নেমে এলো সাঁঝের আঁধার। অন্ধকারে পথ চলা আমার নিজেরই খুব একটা পছন্দ না। দু'পাশের কিছুই তখন আর দৃশ্যমান থাকে না। অন্ধকারে আমরা নিজেরাই গল্পে মশগুল হলাম। আহমেদ ছফা থেকে শুরু করে হুমায়ূন আহমেদে গিয়েও গল্পের রেশ কাটছিল না। গল্পে গল্পে গোয়ালন্দে পৌঁছালে আজকের দিনের মতো থামলেন খোকন দা। আমি আর আশরাফুল আরও খানিক এগিয়ে আলাদীপুরে গিয়ে শেষ করব আজকের হাঁটা। পা চালিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম দুজনেই।
মকবুলের দোকান নামক জায়গায় গোয়ালন্দ ছাড়িয়ে ঢুকলাম সদর উপজেলায়। খানখানাপুর হয়ে আলাদীপুরে দিনের হাঁটা শেষ করলাম রাত আটটা দশ নাগাদ। এর মধ্যেই কতদূর এসেছি ফোনে সে ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন নান্নু ভাই। আজ রাতের আশ্রয়দাতা নান্নু ভাই। আলাদীপুর থেকে ঢাকা ফিরে যাবে আশরাফুল আর আমি ফিরব গোয়ালন্দ বাজারে, যেখানে অপেক্ষা করছিলেন নান্নু ভাই আর খোকন দা। নান্নু ভাইয়ের ঘরে ঢুকতেই আমাকে এক নজর দেখতে এলেন উনার শাশুড়ি। উনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমরা আজ মানিকগঞ্জ থেকে হেঁটে এখানে পৌঁছেছি।
আরও পড়ুন>> পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
বাংলাদেশ সময়: ১০০৬ ঘণ্টা, মার্চ ০৩, ২০২০
টিএ