ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ট্রাভেলার্স নোটবুক

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪২)

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৩ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০২০
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪২) চোখ জুড়ানো সরিষা ক্ষেত।

বাবর আলী। পেশায় একজন ডাক্তার। নেশা ভ্রমণ। তবে শুধু ভ্রমণ করেন না, ভ্রমণ মানে তার কাছে সচেতনতা বৃদ্ধিও। ভালোবাসেন ট্রেকিং, মানুষের সেবা করতে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের এই ডাক্তার হেঁটে ভ্রমণ করেছেন দেশের ৬৪ জেলা। সেটা আবার ৬৪ দিনে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? সেটা নিয়ে ধারাবাহিকভাবে লিখেছেন বাংলানিউজের ট্রাভেলার্স নোটবুকে। ৬৪ দিনে থাকবে ৬৪ দিনের ভ্রমণ-অভিজ্ঞতা।

দিন ৪২
ঝিকরগাছা (যশোর)-কলারোয়া (সাতক্ষীরা)-গোপালপুর চৌরাস্তা (কেশবপুর, যশোর)= ৩৬.৭২ কিমি

সকালে বেরোতে যাবো এমন সময় দেখি আহাদ ভাইও রেডি। জানালেন উনিও খানিকটা পথ হাঁটবেন।

যদিও সঙ্গে সাইকেল নেবেন উনি। ঝিকরগাছা বাজারের দিকে যেতে একটা বাইপাস রোড আছে। আহাদ ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী সেটাই ধরলাম। এই রাস্তাটা বেশ নিরিবিলি। নরম রোদে হাঁটতে বেশ আরাম অনুভূত হচ্ছে। পেছন থেকে বাজার হয়ে মহাসড়কে উঠলাম আমরা। এই মহাসড়কটাই সোজা বেনাপোল পর্যন্ত এগিয়েছে।  

এর সংস্কার কাজ চলছে গত বছর দুয়েক ধরেই। কাজ আর শেষ হয় না। খোয়া বিছানো রাস্তা, পিচের অস্তিত্ব নেই। কলকাতা যাওয়ার সময় এই পথেরই নিয়মিত যাত্রী আমি। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে কপোতাক্ষ নদ। এদিকে কপোতাক্ষ তাও কিছুটা যৌবন ধরে রেখেছে।

হাজিরালী মোড় পর্যন্ত সঙ্গ দেওয়ার জন্য এসেছিলেন আহাদ ভাই। মোড়ে এসে জানালেন আরো খানিকটা পথ যাবেন। বামে মোড় নিয়ে কলারোয়ার রাস্তা। খাঁটি কলকাতার বাচনভঙ্গিতে দু’পক্ষের গালাগালের মাঝে পড়লাম রেলগেটের কাছে এসে। আহাদ ভাই সাইকেল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছে বলে আমাদের চলার গতি কিছুটা শ্লথ। আমারও আজ অবশ্য খুব একটা তাড়া নেই। হেলেদুলে চলছি। কাউরিয়া পার হয়ে শুরু হলো এদিকের বাওড়ের গল্প।  

ঝিকরগাছা সদরের কপোতাক্ষ। এসব বাওড় নাকি বেশিরভাগই লিজ দেওয়া হয়। ধান কাটার পরে রাস্তার দু’পাশ এখনো ফাঁকা। কিছু জায়গায় সরিষা লাগানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বেশ অনেকগুলো থাই পেয়ারা বাগান এদিকে। এই পেয়ারাগুলো সাইজে বড় হলেও খেতে কেমন পানসে। গাছে থাকতেই পেয়ারাগুলো মুড়ে দেওয়া হয় পলিথিনে। পোকার আক্রমণ থেকে বাঁচানোই উদ্দেশ্য।

দুই কিলোমিটার হাঁটার জন্য এসে সাত কিলোমিটারের বেশি হেঁটে বিদায় নিলেন আহাদ ভাই। বেজিয়াতলা বাজারের কাছে আমাকে দেখে এক লোক বলে উঠলো-পাগলনি কোনো? ফোনে আমাকে চাটগাইয়া বলতে শুনে পাশের লোককে জানান দিল তার ধারণাই ঠিক! নারাংগালী মোড় হয়ে নওয়ালী বাজার। একের পর এক পেঁপে বাগান এদিকে। বল্লা বাজারের কাছে এক বয়স্ক লোক থামালেন আমাকে।

 'তোমার কি বিরেনের (ব্রেনের) কোনো সমস্যা আছে?'- বলে প্রশ্ন ছুড়লো। এ প্রশ্ন কেন মনে হলো সেটা জিজ্ঞেস করতেই উত্তর- 'কোন সুস্থ লোক এভাবে হাঁটে নাকি?' আমি হেসে উড়িয়ে দিতেই পরের প্রশ্ন শুনে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে গেল। বয়স্ক লোকটি বললেন তোমার নিশ্চয় কোনো বদ মতলব আছে। আমি সহজে মেজাজ হারাই না। এ প্রশ্ন শুনে ওই লোকের সঙ্গে বেশ ভালো বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে গেলাম। আমার কী দেখে ব্রেনের সমস্যা আর বদ মতলব মনে হলো সেটার ব্যাখ্যা চাইলাম তার কাছে।

মির্জানগর হাম্মামখানা। আমার এলোমেলো চুল দেখেই নাকি তার মনে হয়েছে। আমি এসব ব্যাপারে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারি সাধারণত। কিন্তু এবারে কেন জানি লোকটাকে ছাড়তে মন চাইলো না। তাকে আমার সঙ্গী হয়ে কলারোয়া পর্যন্ত যেতে বললাম। হাসপাতালে গিয়ে আমার মানসিক সুস্থতা আর থানায় গিয়ে আমার বদ মতলব দুটাই পরীক্ষা করার আহ্বান জানাতে মধ্যস্থতা করতে এগিয়ে এলেন আরেক ভদ্রলোক। ওনার মধ্যস্থতায় আমি আবার হাঁটা শুরু করতেই মধ্যস্থতাকারী বয়স্ক ভদ্রলোককে শুনিয়ে ছাড়লো নিজের ছেলেকে নিয়ে এত ভাবলে তোমার ছেলেটা আজ জেলে থাকতো না।

তামিম ইকবাল নামক বাস সার্ভিস দেখলাম একটা। খানিম পরেই ক্যাচ করে ব্রেক কষে একটা সাইকেল থামলো আমার ঠিক সামনেই। চালকের আসনে একটু আগের সেই বয়স্ক ভদ্রলোক। ক্ষমা চাইতে এসেছেন আমার কাছে। আমি হেসে হাত মিলিয়ে কিছুদূর এগিয়ে পেলাম সাদিপুর বাঁশতলা। এখানে একটা ইলেকট্রিকের পোলে একই সঙ্গে হাজাম আর ডুবুরির নম্বর দেওয়া। দুই বিপরীত মেরুর দুই পেশাজীবীর যোগাযোগটা কীভাবে কে জানে! 

হাজারীবাগ নামক জায়গা থেকে যতই এগোচ্ছি ততই চোখে পড়ছে মাছ চাষের পুকুরগুলা। এই এক জেলায় লোকেরা যতবার পাগল ডেকেছে, অন্য কোনো জেলাতে একসঙ্গে এত লোক আমাকে পাগল নামে অভিহিত করেনি। বাঁকড়া বাজারে ঢুকার মুখেই মোটরসাইকেল নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন কাজী সোহেল ভাই। সঙ্গে ওনার ক্লাস নাইন পড়ুয়া ছেলে নিসর্গ। নিসর্গ আমাকে বরণ করে নিল গোলাপ দিয়ে। আজ রাতে আমি সোহেল ভাইয়ের বাসায় অতিথি।

ডিসেম্বরের হালখাতা। এখান থেকে সোহেল ভাই আমার সঙ্গে হাঁটা শুরু করলেন। আর ওনার ছেলে খুব শ্লথগতিতে চালাচ্ছে মোটরসাইকেল আমাদের সাথে সাথেই। বাঁকড়া যদিও একটা ইউনিয়ন তবে এর কলেবর উপজেলা সদরের মতোই। অনেকগুলো বহুতল ভবনের পাশাপাশি আছে ফুটপাতও। ইউনিয়ন পর্যায়ে ফুটপাত দুষ্প্রাপ্য বস্তু। সোহেল ভাইয়ের এই অঞ্চল নিয়ে বেশ জ্ঞান। ওনার বর্ণনা শুনতে শুনতেই এগোচ্ছি। দরগাহ ডাঙ্গায় পেলাম বিশাল এক বট। উচ্চতায় যতটুকু বেড়েও ঠিক ততটুকু।  

মাটশিয়া পার হয়ে বড় খোরদা থেকে প্রবেশ করলাম সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলায়। কলারোয়া ঢুকতেই স্বাগত জানাল প্রচুর খেজুর গাছ। কথায় কথায় জানতে পারলাম সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে আমার বছর পাঁচেক আগেই দেখা হওয়ার কথা ছিল। আমাদের ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের এক প্রোগ্রামে আসার কথা ছিল ওনার।

ফিরোজ ভাই, জাহিদ আর রুদ্র যোগ দিল খোরদো বাজার থেকে। মাঝে রাস্তার পাশ থেকে শাক আলু কিনলেন সোহেল ভাই। টাকা দেওয়ার সময় সোহেল ভাই বিক্রেতাকে বললেন- 'আমরা ঠকছি না তো?' এক টাকা কম থাকায় আবার জিজ্ঞেস করলেন - 'আপনি ঠকছেন না তো?' আরো কিছু পথ পেরিয়ে খোরদো বাওড়। বেশ বড়সড় এই বাওড়। বাকিদের মধ্য থেকে ফিরোজ ভাইয়ের সাথেই গল্প হচ্ছে বেশি। ভদ্রলোক ছবি তোলেন, সিনেমাটগ্রাফি করেন আর সঙ্গে করেন গানও।  

দুই বিপরীত মেরুর দুই পেশাজীবী
নানান বিষয়ে কথা হচ্ছে তার সঙ্গে। কপোতাক্ষ নদ কেন মরে যাচ্ছে এর জুতসই ব্যাখ্যা পেলাম হাঁটতে হাঁটতে। এক নদীর এত এত বাঁক আগে কখনো পাইনি। পাকুড়িয়া বউ বাজারের বেশিরভাগ দোকানে লেখা শুভ হালখাতা। বছরের এই সময়ে এই লেখা দেখে খানিকটা অবাক হলাম। পরে জানলাম এই হালখাতা মূলত ধান ওঠার সময় কেন্দ্র করেই। এদিকে সরিষা বেশ বড় হয়েছে। চারপাশ ছেয়ে গেছে হলুদে। আমার রীতিমতো মাথা খারাপ দশা। যত সরিষা ক্ষেত দেখেছি, তার মধ্যে এই জায়গাটা এগিয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে।

সরিষা ক্ষেতের পাশেই মৌমাছির চাষ হচ্ছে। কপোতাক্ষের পাড় ঘেঁষে বেড়িবাঁধের মাটির রাস্তা ধরেই পথ। রাস্তার দু'ধারে বাবলা গাছ। আর নিচের ক্ষেতে আদিগন্ত বিস্তৃত সরিষা। কাশিয়াডাঙ্গা বাজার হয়ে কপোতাক্ষের তীরে এসে খেয়ায় পার হলাম নদী। নদীর এপারে যশোরের কেশবপুর উপজেলা। আরো খানিকটা এগিয়ে গোপালপুর চৌরাস্তার কাছেই শেষ করলাম আজকের হাঁটা।  

আমার আজকের আশ্রয়স্থল কাজী সোহেল ভাইয়ের বাড়ি পর্যন্ত যাবো তারই বাইকে চেপে। ফেরার পথে সুযোগ হলো একটা মুঘল স্থাপনা দেখার। তালাবদ্ধ মীর্জানগর হাম্মামখানা দেখে ঠিক মন ভরলো না। সরসকাটি বাজারে এসে সন্ধ্যার অন্ধকারে ফিরোজ ভাইয়ের দরাজ গলায় তারই রচিত তিনটা গান শুনে বাড়ির পথে। আর ফিরতে ফিরতে দু-তিনটে দোকানে ভাজা-পোড়া, চা-কফি খেলাম। বেশিরভাগ দোকানেই কদিন আগে ভরপেট খেয়ে গিয়েছেন মুন ভাই। সোহেল ভাই খেতে খেতে সেসব গল্পই করছিলেন। বেতনা নদী লাগোয়া সোহেল ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভর সন্ধ্যা।

চলবে...

আরও পড়ুন>>

** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮)

পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)​
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)

বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০২০
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।