দিন ৫৪
ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর)-রায়পুর (লক্ষ্মীপুর) - ভোলা = ৪৬.২৫ কি.মি.
চাঁদপুরে গিয়েও ইলিশ না খাওয়া লোকেদের ছোট্ট একটা তালিকা করলে এতে আমার নাম ঢুকে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। ছোটবেলা থেকেই কেন জানি এই মাছ পছন্দ না।
আগেরদিন যাত্রা শেষ করেছিলাম ফরিদগঞ্জে। চাঁদপুর থেকে সিএনজিতে চেপে ফরিদগঞ্জ পৌঁছেই পদযাত্রা শুরু। রস উপচে পড়ার উপক্রম হওয়া খেজুর গাছে বাঁধা একটা পাত্র দেখে ভারী লোভ হলেও নিপা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে নিজেই নিজেকে সামলালাম। চতুরা পার হতেই রাস্তার দুধারের খেজুর গাছের জায়গা নিল কলাগাছ। আর খেজুরতলার পরের রাস্তায় শুধু সীম আর সীম।
গৃদকালিন্দিয়া নামক বাজারে অন্য দোকানপাটের চেয়ে স’মিলই বেশি সংখ্যায়। চরমান্দারী পেরিয়েই বর্ডার বাজার। এই জায়গাটা আক্ষরিক অর্থেই বর্ডার। চাঁদপুর আর লক্ষ্মীপুর জেলার সীমানা এখানেই। বর্ডার বাজারের শেষাংশে ইলিশ মাছের রুপালী প্রতিকৃতি জানান দিল চাঁদপুরের শেষ সীমানায় আমার অবস্থান।
এরপরই প্রবেশ করলাম লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায়। এদিকের রাস্তায় ড্রাইভিং স্কুলগুলোর শিক্ষানবিশ ড্রাইভারদের খুব দৌরাত্ম্য। কাঁপা কাঁপা হাতের ড্রাইভিং দেখে চোখ-কান খোলা রাখতে হচ্ছে। খাল্লার পোল, লেংড়া বাজার পার হয়ে রায়পুর সদর। মেডিক্যালের সহপাঠী তন্ময়ের বাড়ি এখানেই। ওকে ফোন করতেই চৌরাস্তায় চলে এলো ও। দেখা করেই চলে যেতে উদ্যত হলেও তন্ময় তার বাড়ি নিয়েই ছাড়লো। কাকা-কাকিমা খাওয়ালেন বেশ যত্ন করে।
রায়পুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে তন্ময়ের কাছ থেকে যখন বিদায় নিচ্ছি, মাথায় তখন রাজ্যের চিন্তা। মজু চৌধুরী হাট থেকে সর্বশেষ লঞ্চ ছাড়বে বিকেল ৩টায়। হাতে সময় আছে সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা আর পথ বাকি আছে ২২ কিলোমিটার। মাথা থেকে সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে দিলাম ঝাড়া এক হাঁটা। এই রাস্তা এমনিতেই বেশ ভালো। মধুপুরের পর থেকে যেন আরো বেশি মসৃণ।
সোনাপুরের পরের বাজারটার নাম বাসা বাড়ী বাজার। রাখালিয়া বাজার থেকে মোড় নিলাম ডানদিকে। এক্সকিউজ মি বলে স্মার্ট একটা ছেলে কথা বলতে এলো। খুবই আগ্রহ নিয়ে এটা-সেটা জানতে চাইলো সে। দালাল বাজার ইউনিয়ন থেকে প্রবেশ করলাম লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলায়। এর মধ্যেই চৌদ্দ-পনের বছর বয়সী এক সাইকেল আরোহী এসে মোটামুটি শ’খানেক প্রশ্ন করে ফেললো। এমনিতেই আমার তাড়া, তার উপর লাগাতার প্রশ্নে আমি ত্যক্তবিরক্ত। শেষে জিজ্ঞেস করল - ‘আপনি ভোলা কেমনে যাবেন? নদী কেমনে পার হবেন?’ আমি ব্যাকপ্যাক দেখিয়ে বললাম - ‘এই ব্যাগে একটা যন্ত্র আছে যেটা পায়ে লাগালেই পানির উপর দিয়ে হাঁটা যায়। ওইটা দিয়েই পার হবো। পদ্মা নদীও ওইটা পরেই পার হইসি। ’
সম্ভবত উত্তর পছন্দ না হওয়ায় সে আর ঘাঁটালো না। আমি আপদ দূর হয়েছে দেখেই খুশি। এই রাস্তাটা বেশ সরু। পাশাপাশি দুটো অটোই চলতে পারে না। বাড়ির সামনে মাঝে মাঝেই একটা-দুটো দোকান। যশোর-মাদারীপুরের দিককার ডুবুরি পেশার মতো এদিকে আছে ধামা মিস্ত্রী। তাল গাছ, নারিকেল গাছ ইত্যাদি পরিষ্কার করার কাজ করে এরা। দোকানগুলো সয়লাব এদের বিজ্ঞাপনে। সাদ্দার পোল পার হতেই অনেক পিছন থেকে এক লোক ডাক দিল। আমি থেমে যেতেই দৌড়ে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো - ‘ভাই, আপনি কি বিকাশের সিম বেচেন?’ এমনিতেই প্রচন্ড তাড়া, তার মধ্যে দুনিয়ার সব উদ্ভট প্রশ্ন। রসূলগঞ্জ পার হয়ে নবীগঞ্জ বাজার। বেশিরভাগ পুকুরের উপরিভাগই ঢাকা জাল দিয়ে। পুকুরে যাতে কেউ চুরি করেও জাল মারতে না পারে, সেজন্যই এই ব্যবস্থা। গুগল ম্যাপের দেখানো রাস্তা ধরে এক বাড়ির উঠোনে গিয়ে পড়লাম। আর রাস্তা নেই। ত্রাণকর্তার ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক। কিলোমিটার খানেক পথ দেখিয়ে তুলে দিলেন কড়ইতলায়।
কড়ইতলা থেকে হাতের ডানে মাটির রাস্তায় নামলাম। এই মাটির রাস্তায় মিহি পাউডার বালু সর্বত্র। একটা গাড়ি পাশ দিয়ে যাওয়া মানে শরীর পুরো সাদা হয়ে যাওয়া। এই রাস্তাটাকে স্থানীয়রা বলেন বেড়ির রাস্তা। একটা জায়গায় পেলাম শত শত হাঁস। প্যাকপ্যাক শব্দে কান ঝালাপালা। বেড়ির রাস্তার দু’পাশেই অনেকগুলো ঘর। খুব সম্ভবত ইনারা খালি জায়গা পেয়েই ঘর তুলেছেন। কেউই খুব একটা অবস্থাপন্ন নন। তিনটার লঞ্চ/সী ট্রাক ধরার উদ্দেশ্যে হাঁটলেও তুমুল হাঁটায় দুইটা পাঁচ নাগাদ মজু চৌধুরীর হাট। সোয়া দুইটার সী ট্রাকে উঠে পড়লাম। ভোলা এমন একটা জেলা যার সাথে অন্য কোন জেলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগ নেই। মেঘনা নদী ধরেই চলতে শুরু করল সী ট্রাক। মাঝে একবার নদীর মাঝখানের ডুবোচর আটকে নষ্ট হল কিছুটা সময়। সাড়ে চারটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম ভোলার ইলিশা ফেরীঘাটে।
ইলিশা ফেরীঘাট ভোলা সদর উপজেলার অন্তর্গত। একে একে পার হলাম পন্ডিতের হাট, ব্যারিস্টার কাচারী, ইলিশা পাকার মাথা। এখানের বাজারে টিনের তৈরি দোকানপাটই বেশি। ইলিশা বাজার পার হয়ে পরাণগঞ্জ থেকে ডানের রাস্তাটা চলে গেছে ভেদুরিয়া ফেরীঘাটে। আমার গন্তব্য সোজা রাস্তাতেই। ভোলার রাস্তা যেন মসৃণতার অপর নাম। এত বড় রাস্তায় কোথাও এতটুকু ভাঙা নেই। বাপ্তা পার হয়েই অল্প এগিয়েই ইলিশ ফোয়ারা। আর তার পাশে বিশাল একটা মাঠ। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই সেখানে সান্ধ্য ভ্রমণে ব্যস্ত। মাঠের এক কোণে বসে ফোন দিলাম আফিফ ভাইকে। উনি নাঈম ভাইয়ের কাজিন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি আসতেই আজকের হাঁটার ইস্তফা টানা হলো।
আফিফ ভাইয়ের বাইকে চেপে হোটেল আলাউদ্দীনে এসে ভরপেট খেয়ে বাংলা স্কুলের সামনে আবার খাওয়া হল হালিম। আজ থাকব নাঈম ভাইয়ের বসায়। হাওয়ার বেগে নোটরসাইকেল চালিয়ে খানিকক্ষণের মধ্যে সোজা নাঈম ভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দিলেন আফিফ ভাই।
চলবে...
আরও পড়ুন
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫৩)
**পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫০)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৯)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৮)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৭)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৬)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৫)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৪)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪৩)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪০)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৯)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৮)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৭)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৬)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৫)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৪)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩৩)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৩০)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৯)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৮)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৭)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৬)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৫)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৪)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২৩)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-২০)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৯)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৮)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৭)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৬)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৫)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৪)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১৩)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১১)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-১০)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৯)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৮)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৭)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৬)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৫)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (পর্ব-৪)
** পায়ে পায়ে ৬৪ দিনে ৬৪ জেলা (দিনাজপুর-৩)
** পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (ঠাকুরগাঁও-২)
** পায়ে পায়ে ৬৪ জেলা (পঞ্চগড়-১)
বাংলাদেশ সময়: ১০১১ ঘণ্টা, মার্চ ২২, ২০২০
এইচএডি/