ঢাকা: শরীয়তপুরের ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিসের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায় দেওয়া হবে সোমবার (০৫ ডিসেম্বর)।
রোববার (০৪ ডিসেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল রায়ের এ দিন ধার্য করেছেন বলে জানান প্রসিকিউটর রেজিয়া সুলতানা চমন।
এ মামলার দুই আসামির মধ্যে সোলায়মান মোল্লা ওরফে সোলেমান মৌলভী গ্রেফতারের পর অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ায় তাকে মামলার দায় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর ইদ্রিস আলী সরদারও পলাতক।
চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করবেন।
গত বছরের ১৪ জুন সোলায়মান-ইদ্রিসের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন ট্রাইব্যুনাল। ওইদিনই রাতে গোয়েন্দা পুলিশ সোলায়মান মোল্লাকে গ্রেফতার করলেও ইদ্রিস সরদার পলাতক।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর তাদের বিরুদ্ধে সাত খণ্ডে ৮৫২ পাতার তদন্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রসিকিউশনে হস্তান্তর করেন তদন্ত সংস্থা।
এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গত বছরের ১৬ নভেম্বর প্রসিকিউশন দুই আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিলের পর ২২ ডিসেম্বর এ অভিযোগ আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ০২ মে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের চারটি অভিযোগে সোলায়মান-ইদ্রিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল।
গত ০২ নভেম্বর মামলার সর্বশেষ ধাপ উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক (আর্গুমেন্ট) উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণা অপেক্ষমান (সিএভি) রাখেন ট্রাইব্যুনাল।
প্রসিকিউটর হৃষিকেশ সাহা ও প্রসিকিউটর সাবিনা ইয়াসমিন খান মুন্নি রাষ্ট্রপক্ষে এবং সোলায়মানের পক্ষে তার আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম ও পলাতক ইদ্রিসের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আব্দুশ শুকুর খান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
২০১০ সালে শরীয়তপুরের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ তালুকদার রাজাকার সলেমান ও ইদ্রিস আলী সরদারসহ আরও সাতজন রাজাকারের (তাদের অনেকেই মারা গেছেন) বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন।
চার অভিযোগ
শরীয়তপুরের পালং উপজেলার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাশিপুর মুসলিম পাড়ার মৃত চাঁন মোল্লার ছেলে সোলায়মান মোল্লা (৯০) ও একই উপজেলার মাহমুদপুরের মৃত হামিক আলী সরদারের ছেলে ইদ্রিস আলী সরদার (৬৭)।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়, সোলায়মান মোল্লা ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। এরপর স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় শরীয়তপুরে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুন্ঠন, অগ্নিসংযোগসহ সব ধরণের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন।
সোলায়মান মোল্লা ১৯৬৩ সালের পর মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে শরীয়তপুর জেলার পালং থানার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ইদ্রিস আলী সরদার ওরফে গাজী ইদ্রিস ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে মানবতাবিরোধী একই রকম অপরাধ করেন। তিনি ১৯৬৯ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ইদ্রিস ইসলামি ছাত্রসংঘের সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা মাদারীপুরের এআর হাওলাদার জুট মিলে রাজাকার হিসেবে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। তাদের সহায়তায় পাকিস্তানি সেনারা এলাকার কয়েকশ’ নারী-পুরুষকে গুলি করে হত্যা করে। নারীদের হত্যার আগে ক্যাম্পে নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতন চালায়।
অভিযোগে বলা হয়েছে, একাত্তরের ২২ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত তাদের নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে শরীয়তপুর সদর উপজেলার তখনকার পালং থানার আংগারিয়া, কাশাভোগ, মানোহর বাজার, মধ্যপাড়া, ধানুকা, রুদ্রকরসহ হিন্দু প্রধান এলাকাগুলোতে ব্যাপক অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় রাজাকাররা। ওইসব গ্রামের নয়জনকে হত্যায় সহায়তা করেন আসামিরা। তারা শহীদদের অবস্থান দেখিয়ে দেন, আর পাকিস্তানি সেনা সদস্যরা ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। তিন শতাধিক বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ধর্ষণ চালান তারা।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২২ মে আসামিরা দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ১০০ থেকে দেড়শ’ জন সদস্যসহ শরীয়তপুর জেলার পালং থানা এলাকায় কয়েকটি গ্রামে হামলা চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কৃষক আব্দুস সামাদসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ২০০ মানুষকে গুলি করে হত্যা ও বাড়ির মালামাল লুট করেন।
দ্বিতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ মে পালং থানার মালোপাড়া ও রুদ্রকর গ্রামে হামলা চালিয়ে মঠের পুরোহিতকে গুলে করে হত্যা ও গ্রামগুলো থেকে মামালাল লুট ও আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করেন আসামিরা। মালোপাড়া থেকে ৩০/৪৫ জন নারী ও পুরুষকে ধরে মাদারীপুর পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে তিনদিন আটকে রেখে নারীদের ধর্ষণ করে ছেড়ে দেন। কিন্তু পুরুষদের গুলি করে হত্যা করেন।
তৃতীয় অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৬ জুন একই থানার শৈলেন্দ্র কৃষ্ণ পালের বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুইজনকে হত্যা করে ও হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতন করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেন আসামিরা।
চতুর্থ অভিযোগে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা দখলদার বাহিনীর সহায়তায় এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অপরাধ করেন। এ সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভয়-ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে পালং থানার এক থেকে দেড় হাজার মানুষকে দেশত্যাগ করে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণে বাধ্য করেন।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৪, ২০১৬
ইএস/এএসআর