হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের চাঞ্চল্যকর মামলা দু’টির বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে স্থাপিত ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের অস্থায়ী আদালতে।
প্রথমে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছেন।
সোমবার (২৩ অক্টোবর) শুরু করে মঙ্গলবার (২৪ অক্টোবর) দ্বিতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন রাষ্ট্রপক্ষ। বুধবার (২৫ অক্টোবর) রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমানের সহকারী আইনজীবী আকরাম উদ্দিন শ্যামল বাংলানিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক দল। পক্ষান্তরে মামলার কিছু আসামি ধর্মীয় উগ্র জঙ্গিবাদী। জঙ্গিবাদ সম্প্রসারণে তারা শেখ হাসিনাকে পথের কাঁটা মনে করতেন। অন্য কিছু আসামি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত। তারাও ক্ষমতায় যেতে শেখ হাসিনাকে পথের কাঁটা মনে করতেন। এ দুই গোষ্ঠী তাদের অভিন্ন পথের কাঁটা দূর করতে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়েই মঙ্গলবার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়’।
হত্যা মামলায় ৫২ জন আসামির মধ্যে ৩ জনের অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় বর্তমানে আসামি সংখ্যা ৪৯ জন। অন্যদিকে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলাটির আসামি ৪১ জন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩৮ জনে। হত্যা মামলার ১১ জনকে বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলার অভিযোগের দায় থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল অভিযোগ (চার্জ) গঠনের সময়।
আসামিদের মধ্যে ২০১৫ সালের ২১ নভেম্বর রাতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক মন্ত্রী জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং গত ১২ এপ্রিল রাতে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ৩ জনকে হত্যার দায়ে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগী শরীফ শাহেদুল বিপুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
হত্যা মামলার ৪৯ আসামির মধ্যে ২৩ জন গ্রেফতার হয়ে কারাগারে, ৮ জন জামিনে ও বাকি ১৮ জন পলাতক আছেন।
জামিনে থাকা আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লে. কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, সাবেক তিন আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহিদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, মামলাটির তিন তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিন, সিআইডি’র সিনিয়র এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমান ও এএসপি আব্দুর রশীদ এবং সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম।
গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন- বিএনপির সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ২৩ জন।
পলাতক আসামিরা হলেন- বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জেল হোসেন কায়কোবাদ, হানিফ পরিবহনের মালিক মোহাম্মদ হানিফ, ডিজিএফআইয়ের সাবেক দুই পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আহমদ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, বিএনপির সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর দুই ভাই বাবু ওরফে রাতুল বাবু ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষ নেতা মাওলানা তাজউদ্দিন, জঙ্গিনেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর ও মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, দুই জমজ জঙ্গি সহোদর আনিসুল মোর্সালিন ও মুহিবুল মুক্তাকীন এবং পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন উপ-কমিশনার (পূর্ব) ও উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান।
মামলার আটজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনের জনসভায় সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা চালায়। হামলায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নির্মমভাবে নিহত হন।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। আহত হন শতাধিক নেতাকর্মী।
এ ঘটনায় মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় পৃথক তিনটি এজাহার দায়ের করেন।
মামলাটিতে ২০০৮ সালের ১১ জুন ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ (চার্জ) গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
২০০৯ সালের ০৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। ২০১১ সালের ০৩ জুলাই অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমাসসহ আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ফলে মোট আসামি দাঁড়ায় ৫২ জনে।
২০১২ সালের ১৮ মার্চ সম্পূরক চার্জশিটের ৩০ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের করার পর ফের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সব মিলিয়ে মামলার রাষ্ট্রপক্ষের মোট ৪৯১ জনের মধ্যে সাক্ষ্য দিয়েছেন ২২৫ জন সাক্ষী। গত ৩০ মে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি’র বিশেষ পুলিশ সুপার আব্দুল কাহার আকন্দকে আসামিপক্ষের জেরার মধ্য দিয়ে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়।
গত ১২ জুন থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত কারাগারে ও জামিনে থাকা ৩১ অসামির পরীক্ষা শেষে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় আত্মপক্ষ সমর্থন করেন তারা। গত ১২ জুলাই থেকে ১১ অক্টোবর পর্যন্ত ওই ৩১ আসামির আসামির পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন ৩১ জন সাক্ষী।
বাংলাদেশ সময়: ২০০৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৪, ২০১৭
এমআই/এএসআর