হালতি বিল, চলনবিলাঞ্চল, নাটোর থেকে: আয়োজনটা আগের দিন থেকেই শুরু। পুকুর ও কইচা, কুনি বা দহ- যে নামেই ডাকি মাছ আছে তাতে।
বৃহত্তর চলনবিলাঞ্চলের অন্যতম বড় অংশ হালতি বিলে গিয়ে দেখা গেলা এমনটি। বছর শেষে মাছ ধরা এখানে উৎসব। এ বিলে মাছের প্রধান উৎস প্রাকৃতিক। বর্ষার ক’মাস বিল ভরে ওঠে কানায় কানায়। তখন হারিয়ে যায় জমির মালিকদের সীমানা। জল টইটম্বুর বিলে তখন মাছেদের একক আধিপত্য।
বিলের এক পাশের তুলনামূলক গভীর অংশে গড়ে ওঠা অভয়ারণ্য থেকে মা মাছেরা গোটা রাজ্য তাদের অধিকারে নেয় প্রজন্ম বাড়িয়ে। সেই নতুন প্রজন্মই শুষ্ক মৌসুমে বিলবাসীর শেষ আকাঙ্ক্ষার বস্তু। অন্যতম আয়ের উৎস।
আগের দিন শেষ বিকেলে রুপালি পুঁটির লম্ফঝম্ফ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাই পরের দিনে সকালের আয়োজন কোনোভাবেই মিস করা যায় না। কারণ আয়োজনটা আরও বড়। সেচা হবে বেশ বড় একটি কইচা। বিলাঞ্চলে এ নামটিই পরিচিত বেশি। বিলের এক কোণে বড় বা ছোট আকৃতির পুকুর সদৃশ গর্তকেই কুনি বা কইচা বলে। বিলের পানি যখন শুকাতে থাকে তখন মাছের আশ্রয় হয় এগুলো।
বিল হালতির মধ্যের পুবের গ্রাম একডালায় আয়োজনটা বেশ বড়। আগের দিন পানি শুকানো হয়েছে অনেকটা। তারপর রাত জেগে চৌকি দেওয়া। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে শুরু কর্মযজ্ঞ। গ্রামগুলো সব দ্বীপের মতো। গায়ে গায়ে ঠেসা বাড়ি সব। সবার মধ্যে মিলটাও তাই বেশি। বাড়ির নারীদের সব আগে থেকেই বলা, ‘সকালে কিন্তু মাছ বাছতি হবি। ’
পানি যখন একেবারে অল্প হয়ে আসে তখন জাল ফেলে শুরু হয় মাছ ধরা। সাধারণত বড় মাছগুলো ধরার জন্যই জাল। বড় মাছের মধ্যে বোয়াল আবার প্রধান। মূল্যবান বেশি।
একটি বোয়াল ধরা দিলেই শুরু হয চিৎকার। গোষ্ঠীর লোকও তো বটেই, পাড়ার লোকও জড়ো হয় এসময়। আর ছোট বড় একটি দল তো প্রথম থেকেই ঝাঁকা নিয়ে কোমর সমান কাদায়।
মাছগুলো ধরে প্রথমে রাখা হয় ঝাঁকা বা ঝুড়িতে। তবে বড়গুলো পাঠিয়ে দেওয়া হয় উপরে। কাদা মাছ প্রথমে থাকে একাকার। পরে উপরে উঠিয়ে ধুলেই বের হয রোদচকচকা রুপালি রং। তবে শোল, কই, চ্যাং বা টাকির কথা আলাদা।
বড় মাছ ধরা শেষ হলে কাদায় হাত গেঁথে গেঁথে ধরা হয় বাইন বা গচি, শিং, মাগুর, কই শোল, টাকি। বোয়ালও পাওয়া যায় দু’একটি।
পুঁটি, কাকিলা, খলিসা, ট্যাংরা, বোয়াল, শিং, বাতাসি, মাগুর, কই, চিংড়ি, বাইন, শোল, টাকি, মলা, চান্দা, বাটা এসব কুনিতে মেলা প্রধান মাছ। রুই, কাতলা, চিতল মেলে কদাচিত।
ছোটমাছগুলো প্রথমে ঝুড়িতে করে ফেলা হয় পাড়ের পাটির উপর। সেখানে গোল হয়ে বসে থাকেন নারীরা। তাদের কাজ ট্যাংরা, কাকিলা, পুঁটি, খলিসা, মলা, চান্দা এগুলো আলাদা করা। আনন্দের সঙ্গে এ কাজ করছেন তারা।
শিং, শোল, টাকি আবার আলাদা জায়গায় রাখা। এগুলোর দাম বেশি। জ্যান্ত রাখা চাই ভালো দাম পাওয়ার জন্য। তাই সেগুলো রাখা বড় মাটির পাত্র কিংবা বালতিতে।
বোয়ালগুলো দেখার মতো। এ কুনিতে বোয়ালই ধরা পড়েছে বেশি। প্রায় তিন ঝুড়ি। দু’একটির ওজন আড়াই তিন কেজি। এছাড়া সারা বছর আরও বড় মাছ মেলে বলে জানালেন মালিকদের একজন আশরাফ।
আরেক মালিক মোক্তার জানান, আজ প্রায় ৫০-৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করবেন তারা। এছাড়া গত কয়েকদিন বেঁচেছেন বেশকিছু মাছ। সব মিলিয়ে ৮০ হাজার তো হবেই।
কোন মাছের কেমন দাম পাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, জ্যান্ত মাছের দাম বেশি। এছাড়া বোয়ালের ভালো দাম পাওয়া যায়। এসব মাছ যাবে পাইকারি বাজারে। বোয়াল ছোট ২০০-২৫০, বড় ৩০০-৪০০, টাকি ২৫০, শোল ৩০০, শিং ৪০০-৬০০, খলিসা ৮০-৯০, পুঁটি ৪০-১২০, চিংড়ি ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হবে।
এসব মাছ খাওয়া থেকে উৎসব করে ধরা এবং বিক্রি করা তাদের জন্য বেশি আনন্দের বলে জানান কলিম। বিলে কারেন্ট জাল ফেলে অবাধে মাছ ধরায় শুষ্ক মৌসুমে এসব কুনি, পুকুরে আগের মতো বড় মাছ মেলে না বলে মত তার। সরকারকে এ ব্যাপারে আরও কঠোর হওয়ার আবেদন কলিমের মতো উপস্থিত সবার।
দিনের শুরুতে এমন চমৎকার একটি উৎসব সত্যি মন ভালো করে দেয়। যারা দর্শক শুধু তাদের নয়, সবার।
বাংলাদেশ সময়: ১২১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৬
এসএস/এএ/জেডএস
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট