নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে: একটি মাসিক পত্রিকার কাভারস্টোরি পড়ে সেই ছাত্রজীবনে নিঝুম দ্বীপের প্রেমে পড়েছিলাম। এর পর ১৮ বছর কেটে গেছে, কিন্তু নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি।
তাই বাংলাদেশের প্রতিটি দর্শনীয় স্থান নিজের বাড়ির আঙ্গিনা বানিয়ে ফেলা বন্ধু এজাজুল হক মুকুল ১৫ জানুয়ারি পড়ন্ত বিকেলে ফোন দিয়ে যখন নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার প্রস্তাব দিল, বললাম একটু থাম!
মুকুলকে কল ওয়েটিংয়ে রেখে ফোন দিলাম আমার স্থানীয় অভিভাবক বাংলানিউজের এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেনকে। নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার অনুমতি চাওয়া মাত্রই, তিনি বললেন ‘যাও’।
আনন্দে নাচতে শুরু করলাম! এত দিনের স্বপ্ন পূরণ হতে চলছে! শরীর ও মনে সে কী শিহরণ! মুকুলকে জানিয়ে দিলাম, যাচ্ছি তোদের সঙ্গে। আমাদের যাত্রা শুরু কোথা থেকে- কখন?
১৬ জানুয়ারি সাড়ে ৫ টায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। সাড়ে ৪টার মধ্যে হাজির থাকতে হবে। দেরি করলে মিস! এটুকু বলেই ফোন কেটে দিল মুকুল।
সঙ্গে আর কে কে যাচ্ছে? কাপড়-চোপড় কি পরিমাণ নিতে হবে? ক’দিনের ট্যুর?-এসব জিজ্ঞেস করার সুযোগ পাওয়া গেল না।
পরের দিন (১৬ জানুয়ারি) বিকেল সাড়ে ৪টায় সদরঘাট গিয়ে দেখি হাতিয়াগামী এমভি ফারহান-৪ এ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন হাতিয়ার ডাকসাইটে সাংবাদিক শামিমুজ্জামান। মানুষটার সঙ্গে আগে কখনো দেখা হয়নি। অথচ প্রথম দেখায় পরম আত্মীয় বনে গেলেন তিনি। কেবিনের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, আপাতত বিশ্রাম নিন, পরে কথা হবে।
লঞ্চ ছাড়ার আধা ঘণ্টা আগে সফর সঙ্গী হিসেবে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল রাজু হামিদ, উৎপল দাস, শয়িরত, জাহাঙ্গীর কিরণ, শিমুল, মঈন, মাসুদ রানা ও সুলতান।
এদের মধ্যে একজন কেবল বড় ভাই। বাকি সবাই বন্ধু ও ছোট ভাই। প্রত্যেকেরই নেশা ভ্রমণ, পেশা সাংবাদিকতা।
সন্ধ্যার আকাশে আধখানা চাঁদের বাঁধভাঙা হাসি। শীতের সন্ধ্যায় নদীর নিথর জলের বুকে কল্লোল তুলে লঞ্চ ছুটছে। লঞ্চের ছাদে চলছে ১১ পাগলের সেলফি উৎসব। এ কাজে সব চেয়ে বেশি উৎসাহ জোগাচ্ছে ১১ পাগলের আপাত সর্দার এজাজুল হক মুকুল!
মাঘের প্রচণ্ড শীতে মেঘনা নদীতে ভেসে চলা লঞ্চে ছাদে আমাদের পাগলামি বেশি রাত পর্যন্ত চলল না। রাতের খাবার খেয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়লাম আমরা সবাই।
প্রচণ্ড এক ধাক্কায় ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে ৭টায়। আমাদের লঞ্চ এমভি ফারহান-৪ হাতিয়ার তমরউদ্দিন ঘাটে এসে ভিড়েছে। কেবিনের দরজা খোলার আগেই দেখি কাঁচের জানালা দিয়ে তিন শিশু উঁকি মারছে। ওরা আমাদের ব্যাগ বহন করতে চায়।
সূর্যমামা ওঠার আগেই ঘুম থেকে উঠেছে ওরা। এই মুহূর্তে লাল টুকটুকে সূর্যটা ওদের বাড়ির নারকেল আর খেজুর গাছের ডগার সাথে লেপ্টে আছে শীতের জ্যাকেট পরে।
ঘাট থেকে নেমে মোটরসাইকেলে চেপে সোজা হাতিয়া উপজেলা পরিষদে গিয়ে ঢুকলাম। সেখান থেকে সংগ্রহ করালম দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মানচিত্র। এ কাজে আন্তরিক সহযোগিতা দিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান মো. মাহবুব মোর্শেদ। অত্যন্ত ভাল মানুষ তিনি। কদাচিৎ এরকম মানুষের সাক্ষাৎ মেলে!
আমরা সময় বেশি নষ্ট করলাম না। ফের মোটরসাইকেলে চেপে সোজা চলে গেলাম নলচিরা ঘাটে। আমাদের উদ্দেশ্য নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার আগে হাতিয়া উপজেলা সদর থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে আরেকটি নয়নাভিরাম উপ দ্বীপ ঘাসিয়ার চর দেখা।
নলচিরা থেকে ঘাসিয়ার চরে নির্ধারিত কোনো রুট না থাকায় একটি স্পিডবোট ভাড়া করতে হল। এ কাজে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউসের ব্যক্তিগত সচিব মো. মুজিবুর রহমান।
হাতিয়া থেকে নিয়ে যাওয়া ভাত-মাছ-সবজি দিয়ে নির্জন ঘাসিয়ার চরে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। শহর থেকে দূরে উদোম আকাশের নিচে নিরিবিলি পরিবেশে একবেলা খেয়ে নির্মল আনন্দ উপভোগের জন্য এমন আদর্শ জায়গা পৃথিবীতে আর আছে কিনা, আমার জানা নেই।
চারদিকে বিরাণ মাঠ। কোথাও কোনো ঘর-বাড়ি নেই। অনেক দূরে গরু-মহিষ আর ভেড়ার পাল আপন মনে ঘাস ছিঁড়ছে। রাখালরা হয়তো আরো পরে চরে এসে গরু-মহিষগুলো ঘরে নিয়ে যাবে। অথবা গরু-মহিষের সঙ্গে থেকে যাবে ঘাসিয়ার চরে।
দৈত্যাকৃতির রুই মাছের ঝোল, চরে চাষ করা ফুলকপি-শিম ও আলুর মিশেলে রান্না করা ঘন সবজিযোগে উদর পূর্তি করে মখমলের মত ঘাস বিছানো ঘাসিয়ার চরে শরীরটা এড়িয়ে দিলাম।
হঠাৎ কানে ভেসে এল চরঘাসিয়া সূর্যমুখী আশ্রয়ণ প্রকল্পের অস্থায়ী কার্যালয়ের উঁচু ঢিপিতে দাঁড়িয়ে কে যেন চিৎকার করে আমাদের ডাকছেন। আমরা ছুটে গেলাম।
গিয়ে দেখি মহিষের খাঁটি দুধ দিয়ে বিশেষ প্রকারের চা বানানো হয়েছে আমাদের জন্য। চায়ে পানির কোনো বালাই নেই। গরম দুধের মধ্যে লিকার ছেড়ে দিয়ে তৈরি এ চা না খেলে অর্ধেক জীবনই মাটি!
অনেক ভাললাগা আর মুগ্ধতা নিয়ে ভোলার মনপুরা ও নোয়াখালীর হাতিয়া দ্বীপকে আলাদা করে রাখা ঘাইসার খাল (মূলত ঘাসিয়ার খাল) থেকে ফের যখন স্পিডবোটে উঠলাম তখন চারদিকে লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার অপেক্ষায় সূর্য। এর পরের গল্প বেশ রোমাঞ্চকর।
ঘাসিয়ার খাল থেকে নিঝুম দ্বীপের দূরত্ব কত জিজ্ঞেস করতেই দুই তিন রকম তথ্য পাওয়া গেল। স্পিড বোটের চালক বললেন ৭০ থেকে ৮০ কিলোমিটার। তার সহকারী বললেন এক শ’ কিলোমিটারের কম হবে না। আমাদের গাইড বললেন ৮০/৯০ কিলোমিটার হবে!
দূরত্ব যাই হোক, কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সন্ধ্যায় ১৫ জন লোক নিয়ে ছোট্ট একটি স্পিডবোট ৭০ কিলোমিটার গতিতে যখন ছুটতে শুরু করল তখন ভয়ে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। নোনা গন্ধমাখা বাতাসের ঝাপটায় মাথার চুলগুলো উড়ে যেতে চায় বার বার। মেঘনার মোহনায় হাতিয়া প্রণালীকে মনে হয় বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল।
কিছুদূর পর পর হাতের ডানে-বামে মাছের পিঠের মত সবুজের সমারোহ। ওটা কি জিজ্ঞেস করতেই দ্বীপ-উপদ্বীপগুলোকে অধ্যয়নের অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলা মুজিব ভাই’র উত্তর, ওটা মৌলভীর চর, ওটা কমলার চল, ওটা নতুন সুখচর ইত্যাদি ইত্যাদি।
চিতার গতিতে ছুটে চলা স্পিডবোট এরই মধ্যে এক ঘণ্টা ২৮ মিনিট সময় হজম করেছে। আমাদের গাইড শামিম ভাইয়ের হঠাৎ চিৎকার, উই যে..........হরিণ! উই যে........!
তাহলে কি আমরা নিঝুম দ্বীপে চলে এসেছি-? সকাল থেকে আমাদের সঙ্গে থাকা হানিফ মেম্বার (স্থানীয় উইনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য) বললেন, হ্যাঁ চলে এসেছি, কিন্তু ঘাট অনেক দূরে। এটা নিঝুম দ্বীপের পশ্চিম পাশ।
কিছুক্ষণ আগেই সন্ধ্যা নেমেছে। বঙ্গোপসাগরের বুক ফুঁড়ে জেগে ওঠা নিঝুম দ্বীপকে মনে হচ্ছে আরব্য রজনীর ঝুলন্ত উদ্যান। চারদিকে বিশাল জলরাশি। আকাশে আধখানা চাঁদ। পূর্ব দিকে ছুটে চলছে আমাদের স্পিডবোট। আর হাতের ডান পাশ ঘেষে পশ্চিমে সরে যাচ্ছে মর্তের বুকে নেমে আসা এক টুকরো স্বর্গ নিঝুম দ্বীপ! (চলবে...)
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৪, ২০১৬
এজেড/জেডএম