নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে: হাতিয়া প্রণালী থেকে জলের সংসার ভাঙা গতিতে শাহবাজপুর প্রণালী পাড়ি দিয়ে আমাদের স্পিডবোট সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় নিঝুম দ্বীপ ঘাটে ভেঁড়ে।
ঠিক একই সময় ভ্রমণ পিয়াসী ৩০ জন যাত্রী নিয়ে কুয়াশার চাদর মুড়ি দেওয়া হাতিয়ার মুক্তারিয়া ঘাট থেকে আরেকটি ট্রলার নিঝুম দ্বীপ ঘাটে এসে নোঙর ফেলে।
প্রায় দুই ঘণ্টা পর বুকে উষ্ণতা ফিরে এলো। ঘাসিয়ার খাল থেকে বিকেল সাড়ে ৪টায় স্পিডবোট ছাড়ার পর মাঘের শীত ও ডুবে মরার ভয়ে রক্ত হিম হয়েছিল।
জগৎ প্লাবিত জলরাশিতে একখানা ছোট তরী। তার উপর আবার বন্ধু রাজু হামিদ, উৎপল দাস ও মুকুলের বেপরোয়া সেলফিবাজিতে মাঝে মধ্যে ডানে-বামে কাত হয়ে যাচ্ছিল ছোট্ট স্পিডবোট।
স্থির হয়ে বসার জন্য চালক ও চালকের সহকারী বার বার অনুরোধ জানালেও আমাদের ‘ফটো-সুন্দর’রা’ তা কানে তোলেনি। ফলে যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনার শঙ্কা নিয়েই মাঘের সন্ধ্যায় পাড়ি দিতে হলো নোয়াখালীর হাতিয়া ও ভোলার মনপুরা দ্বীপপুঞ্জকে আলাদা করে রাখা শাহবাজপুর প্রণালী।
স্পিডবোট থেকে প্রথম পা মাটিতে ফেলতেই শরীর ও মনে এক অন্য রকম শিহরণ! আমরা পৌঁছে গেছি সেই দ্বীপে, যেখানে একই সঙ্গে দেখা যায় সাগর এবং বন। যেখানে হরিণের অবাধ বিচরণ।
ঘাট থেকে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য নিঝুম দ্বীপের বন্দরটিলা বাজার। ওখানকার ‘ম্যাশ পর্যটন ও উপকুলীয় উন্নয়ন কমপ্লেক্সে’ আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদাউস।
ভ্রমণ পিয়াসী ১১ যুবকের নিঝুম দ্বীপ দেখার স্বপ্ন বাস্তবায়নে শুরু থেকেই তিনি সারথীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। যদিও তার সঙ্গে দেখা হয়নি এ সফরে। তার হয়ে সব রকম সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন তারই ব্যক্তিগত সচিব মো. মুজিবুর রহমান। গত দুই দিনে যিনি সবার প্রিয় মুজিব ভাইয়ে পরিণত হয়েছেন।
যিনি ম্যাচের কাঠি থেকে শুরু করে তাজা কোরাল মাছের উদ্যাম নৃত্য দেখার আবদার পূরণ করে যাচ্ছেন বিরামহীনভাবে। কেন জেনারেটার চলছে না, সৌর বিদ্যুতের ভোল্টেজ কম মোবাইলে চার্জ দেব কীভাবে, খেজুরের সাজো রস না খাইয়ে, ঝরা রস খাওয়ালো কে-? ইত্যকার ভুরি ভুরি অভিযোগের মালা গেঁথে তার গলায় পরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর তিনি সানন্দে সেটা গ্রহণ করছেন। দিয়ে যাচ্ছেন সমস্যার যৌক্তিক সমাধান।
নিঝুম দ্বীপ ঘাট থেকে বন্দরটিলা বাজার যাওয়ার একমাত্র বাহন মোটরসাইকেল। জন প্রতি ৬০/৭০ টাকা গুণতে হয় মোটরবাইকের পেছনে চড়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে। সময় লাগে ৫/৭ মিনিট। এ কারণে যাদের হাঁটার অভ্যাস আছে এবং হেঁটে হেঁটে নিঝুম দ্বীপের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তারা অনায়াসে হেঁটে চলে যেতে পারেন বন্দরটিলা বাজারে।
তবে এ ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপের সমুদ্র সৈকত নামার বাজার পয়েন্টে যেতে চাইলে অবশ্যই মোটরসাইকেলে উঠতে হবে। কারণ, ১৩/১৪ কিলোমিটার পথ হেঁটে পাড়ি দিতে গেলে ভ্রমণানন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে।
ঘাট থেকে নেমেই দেখি আমাদের জন্য ১১টি মোটরসাইকেল প্রস্তুত। মুজিব ভাই আগে-ভাগেই ফোন দিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি মনির মেম্বার, বাহার মেম্বার, মোবাইল সালাহউদ্দিন (নিঝুম দ্বীপে প্রথম মোবাইল ব্যবহারকারী), জেনারেটর আলাউদ্দিন (নিঝুম দ্বীপে প্রথম জেনারেটর নিয়ে এসেছিলেন)-কে দিয়ে সব ব্যবস্থা পাকা করে রেখেছিলেন।
আমরা ১১ জন মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে বসলাম। নিঝুম দ্বীপের আকাশে কুয়াশাঢাকা জোছনামাখা সন্ধ্যা। ১০ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা দিয়ে আমাদের মোটরবাইক ছুটে চলছে।
রাস্তার দু’পাশ থেকে কলা গাছের কচি ডগা ও মাচা ভরা শিমের লতা মাথা উঁচু করে আমাদের দেখছে। নি:শব্দে জানাচ্ছে অভিবাদন। পৃথিবীর যে প্রান্ত থেকেই ভ্রমণ পিয়াসী মানুষ বা পর্যটকরা আসে সবাইকে এভাবেই অভিনন্দিত করে নিঝুম দ্বীপের ঘাস-পাতা, তরু-লতা!
মাত্র ৬/৭ মিনিটের বাইক ভ্রমণের পর আমরা পৌঁছে গেলাম বন্দরটিলা বাজার সংলগ্ন ‘ম্যাশ পর্যটন ও উপকূলীয় উন্নয়ন কমপ্লেক্সে’। সাইক্লোন সেল্টারের আদলে বানানো এ কমপ্লেক্সটির বাহিরাবরণ ও ভেতরের পরিবেশ শহরে বিলাসী জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষের জন্য খুব একটা স্বস্তিদায়ক নয়।
কিন্তু দারিদ্রকে সঙ্গী করে সারা দেশে ঘুরে বেড়ানো ঢাকার চাল-চুলাহীন মেসবাসী ১১ সৌখিন পর্যটকের কাছে ‘ম্যাশ পর্যটন ও উপকূলীয় উন্নয়ন কমপ্লেক্স খুব অস্বস্তিকর নয়।
টানা দুই দিনের ভ্রমণক্লান্ত কাঁধে বয়ে বেড়ানো ব্যাগ-পেট্টা ধুপ-ধাপ করে বিছানার ওপর ছুঁড়ে মারলাম আমরা সবাই। কিন্তু এখানে দেখা দিল এক বিপত্তি।
কমপ্লেক্সের ২০২ নম্বর কক্ষের একটি ডাবল বেডে নিজের ব্যাগটা নামিয়েই দ্রুত তা কাঁধে তুলে নিল উৎপল দাস। বিরক্তি মেশানো কণ্ঠে বলল-‘‘এখানে শরিয়ত থাকবে-? তাহলে আমি থাকব না!’’ ত্রস্তপদে পাশের কক্ষে ছুটল ও।
শরিয়তের সাথে বেড শেয়ার করতে উৎপলের আপত্তি কোথায়? তাৎক্ষণিকভাবে তা জানা গেল না। এক সঙ্গে দীর্ঘ দিন ভ্রমণের অভিজ্ঞতা ওদের আছে। কারণটা ওদেরই ভাল জানা।
মুরগির মাংস, ভাজা ইলিশের ঝোল, শিম ভর্তা, আলু আর ফুল কপির নিরামিষ এবং খেজুরের ঝোলা গুঁড় মিশিয়ে মহিষের দুধের টক দই দিয়ে রাতের খাবার পর্ব শেষ হল। এবার ঘুমানোর পালা।
জোছনা রাত। চারদিকে শুনসান নীরবতা। আশপাশে নেই দানবীয় বাস-ট্রাকের শব্দ। নেই কোনো কলাহল বা নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ পেটানো চিৎকার। কেবল আশ-পাশের ঝোপ-ঝাড় ও জলাশয় থেকে ভেসে আসছে ঝিঝি পোকার ডাক ও পরিচিত-অপরিচিত পাখির কিচিরমিচির।
কিন্তু বিধি বাম! শহর থেকে দূরে নির্জন নিঝুম দ্বীপে প্রায় চারদিক উন্মুক্ত পর্যটন কমপ্লেক্সের কক্ষে শুয়ে ঝিঝি পোকার ডাক আর পাখির কিচিরমিচির মন ভরে উপভোগে ব্যঘাত ঘটাল পাশের বিছানা থেকে উৎসারিত বহু পরিচিত (বিরক্তিকর তো বটেই!) এক শব্দ!
নির্দিষ্ট একটি বিছানা থেকে উৎসারিত শব্দে বাকি তিনটি বিছানাও মৃদু কাঁপছে। গড়-গড়, ঘড়-ঘড় এ শব্দ যেন ভূ-মি কম্পের খালাত ভাই। সুতরাং সন্ধ্যা রাতে না বুঝলেও মধ্য রাতে এসে বুঝতে আর বাকি রইল না, উৎপল দাস কেন শরিয়তের সাথে বেড শেয়ার করতে রাজি নয়।
কিন্তু জীবনের ট্রাজেডি হল এই- যে নাক ডাকার ভয়ে উৎপল দাস পাশের রুমে গিয়ে উঠল, সেখানেও বিকট শব্দে নাক ডাকছে মুকুল। আর দুই কানে বালিশ চেপে কষ্টদায়ক ঘুমে নিমগ্ন আমাদের উৎপল। (চলবে....)
বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
এজেড/জেডএম
** নিঝুম দ্বীপ: মর্ত্যের বুকে এক টুকরো স্বর্গ-১
** শ্রমজীবী পরম বন্ধুরা!
** কি আশায় বাঁধি খেলা ঘর…
** ‘শ্রম কিনাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি তলে’
** ‘মগু অ্যাটা হটু তোলেন’
** ঘাসিয়ার চরে মানুষের বসত
** ‘জানালার কাছে ডেকে গেছে এক পাখির মতন সকাল’