নিঝুম দ্বীপ থেকে ফিরে: কথা ছিল সকাল ৯টার মধ্যে নিঝুম দ্বীপ সমুদ্র সৈকতে নেমে পড়ব আমরা। এর পরে গেলে ভাটার টানে সাগরের পানি ৩ কিলোমিটার দূরে চলে যাবে।
তিন স্তরে বিন্যস্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সৈকতের উপরের দিক থেকে প্রথমস্তরে শুকনো ধুলা, দ্বিতীয় স্তরে ভেজা বালু এবং তৃতীয় স্তরে নরম কাদা। জোয়ারের সময় কাদাস্তর প্লাবিত হয়ে ভেজা বালুর স্তর পর্যন্ত পানি পৌঁছায়। পর্যটকদের জন্য এই সময়টা উপভোগ্য।
আমাদেরকে যেতে হবে বন্দরটিলা বাজার থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে নামার বাজার পয়েন্ট। সুতরাং প্রাতকৃত্য সেরে সকালের নাস্তা গ্রহণ পর্ব সমাপ্ত করে ৯টার মধ্যে সমুদ্র সৈকতে পৌঁছাতে হলে সকাল ৭টার আগেই ঘুম থেকে উঠতে হবে। সে রকম পরিকল্পনাও আমাদের ছিল।
কিন্তু সকাল ৮টার মধ্যেও কাউকে জাগানো সম্ভব হল না। কারণ, রাতে ঘটেছে এক মধুর দুর্ঘটনা।
‘ম্যাশ পর্যটন ও উপকূলীয় উন্নয়ন কমপ্লেক্সে’ কর্মরত দুই কিশোরকে পটিয়ে হাড় কাঁপানো শীতের রাতে ৭০ টাকা দরে ২১০ টাকা দিয়ে ৩ হাড়ি খেঁজুর রস আনানো হয়েছিল। মধ্য রাতে প্রত্যেকেই ২/৩ গ্লাস করে মেরে দিয়েছে। তরুণ পর্যটকদের সর্বাংসহ পেটে ২/৩ গ্লাস রস অনায়াসে হজম হওয়ার কথা। কিন্তু সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়।
নিঝুম দ্বীপের সমতল ভূমির বাঁকে বাঁকে স্বর্গীয় মেহমানদারীর জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা কম বয়সী খেঁজুর গাছ থেকে সাজো রস পেড়ে আনার কথা থাকলেও মধ্য রাতে দুই কিশোর এনেছিল ঝরা রস।
সুতরাং বাদুরসহ নানা প্রজাতির রসখেকো পাখির রসনা ভেজানো ঝরা রস খেয়ে সবার পেটের অবস্থা ভীষণ খারাপ। বিশেষ করে রসের হাড়ি দেখে আনন্দে লাফাতে থাকা উৎপল দাসের অবস্থা বেশি করুণ। দুই হাত প্রসারিত করে বুক উঁচিয়ে পেট ফুলিয়ে মাঝ রাতে বেশ কয়েক গ্লাস রস খেয়ে এখন সে শয্যাশায়ী। রীতিমত লুজ মোশন!
রাতের তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও চিতৈ পিঠা, খেঁজুরের ঝোলা গুঁড় ও মুরগির ঝোল দিয়ে সকালের খাবার সেরে নিলাম আমরা। বেলা ১১টা নাগাদ পৌঁছুলাম নিঝুম দ্বীপের নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকতে।
বন্দরটিলা বাজার থেকে নামার বাজার পর্যন্ত ৯ কিলোমিটার পথ মোটরসাইকেল ভ্রমণের সময় মনে হচ্ছিল কোনো স্বপ্নপুরির ভেতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। রাস্তা কাঁপিয়ে, ধূলা উড়িয়ে, কান ফাটানো হর্ন বাজিয়ে কোনো দানবীয় যান আমাদের পাশ দিয়ে ছুটছে না।
ঢাকার মত ডাস্টবিনের সামনে অসহ্য যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে না আমাদের। মোটর বাইক ছুটছে নিয়ন্ত্রিত গতিতে। পেছনে বসিয়ে বিদেশিনী বহনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন তরুণ বাইক চালক।
নির্জন-নিরিবিলি রাস্তার দুই পাশের কেউড়া বন থেকে ভেসে আসছে নাম না জানা পাখিদের কলরব। আমরা সশব্দে ছুটে চলা বাইকের পেছনে চড়ে হরিণ দেখার জন্য বোকার মত শ্যেন দৃষ্টি পেতে আছি বনের দিকে।
মাঝে মধ্যে বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠছে। কারণ, কাণ্ডজ্ঞানহীন কিছু মানুষ কেওড়া গাছের গুড়ি রেখে নির্দয়ভাবে কাণ্ডটা কেটে নিয়ে গেছে। নষ্ট করেছে বনের অপার সৌন্দর্য।
২০ মিনিট মোটরসাইকেল ভ্রমণের পর আমরা যখন নিঝুম দ্বীপ সমুদ্র সৈকতে পৌঁছুলাম, তখন বেলা ১১টা। ভাটার টানে ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে সাগরের পানি। মাছ ধরা ট্রলার ও ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নরম কাদায় আটকে আছে।
সৈকতের শুকনো ধূলা ও ভেজা বালুর স্তর পেরিয়ে আমার সফরসঙ্গীরা নেমে পড়ল সাগর সঙ্গমে। হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ডুবিয়ে নিঝুম দ্বীপ দেখার আনন্দ উপভোগে ব্যস্ত ওরা। আর আমি ব্যস্ত উভচর মাছের সন্ধানে। যেগুলো নিঝুম দ্বীপকে আলাদা স্বকীয়তা দিয়েছে!
শেষ পর্যন্ত উভচর মাছের সন্ধান মিলল না। তবে যেটা দেখলাম, সেটা আরো বেশি উপভোগ্য!
গাছ থেকে টুপ করে খসে পড়া লাল টকটকে শিমুল ফুল নিঝুম দ্বীপের সৈকত জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। কিন্তু ফুলগুলো ধরতে গেলে টুক করে ঢুকে পড়ছে গর্তে। আদতে এগুলো শিমুল ফুল নয়, লাল কাঁকড়া!
নিঝুম দ্বীপ সমুদ্র সৈকতের নামার বাজার পয়েন্ট থেকে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে যতদূরে চোখ গেল ততদূর পর্যন্ত ফসল কাটা মাঠে খেঁজুর গাছের সমারোহ। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দিলাম ভোঁ-দৌড়। সবার থেকে আলাদা হয়ে ছুটতে থাকলাম গাছগুলোর দিকে।
দূরত্ব সম্পর্কে আগে কোনো ধারণা না থাকায় ধূ-ধূ বালুচর পেরিয়ে, রাখালের মাঠ নাড়িয়ে, গরু-মহিষ তাড়িয়ে, সঙ্গী-সাথীদের হারিয়ে যখন গন্তব্যে পৌঁছুলাম, তখন পায়ের নিচ থেকে পেছনে সরে গেছে প্রায় আড়াই কিলোমিটার পথ।
এই অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে একলা হারিয়ে যাওয়ার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে। মাঘের দুপুরে উদোম আকাশের নিচে খেজুর গাছের ডাগো ভেদ করে আসা মিষ্টি রোদে বসে সেই আনন্দ উপভোগের সুযোগ অনন্তকালের মধ্যে হয়ত একবারই ঘটে।
ছোট ছোট মৎস্য শিকারীদের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে, ছবি তুলে, গল্প করে আর খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত মমিন আলীর সঙ্গে মিষ্টি আলাপ শেষে নামার বাজার পয়েন্টের দিকে রওনা হলাম। এবার আর দৌড়ানোর শক্তি নেই।
তারপরও কিছু পথ দৌড়ে, কিছু পথ হেঁটে সফর সঙ্গীদের কাছে পৌঁছুলাম। ততক্ষণে তারা সাগর তীরে কাঁটাওয়ালা শিমুল গাছে উঠে সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কেউ কেউ পাড়ে উঠে গেছে। কেউ পৌঁছে গেছে নামার বাজারে। কেউ বা ফরেস্ট অফিসে চিকিৎসাধীন হরিণ শাবকের ছবি তুলতে ব্যস্ত।
এরই মধ্যে আমাদের গাইড শামিম ভাই হন্ত-দন্ত হয়ে হাজির। যদি হরিণ দেখতে চান দ্রুত চলেন। ফরেস্ট অফিসের পুকুরে পানি খেতে এসেছে হরিণ। দেরি করলে মিস করবেন।
শুরু হল আবার দৌড়। চিড়িখানায় জোর করে আটকে রাখা হরিণ ছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবিত চঞ্চল হরিণ কখনো দেখা হয়নি। সুতরাং শরীরে জোর না থাকলেও মনের জোরে আবার দৌড়াতে শুরু করলাম।
কিন্তু ফরেস্ট অফিসের পুকুরে পৌঁছানোর আগেই গভীর অরণ্যে ফিরে গেছে হরিণের ঝাঁক। সফর সঙ্গীদের মধ্যে যারা আগে এসেছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ ধাবমান হরিণের পশ্চাদপদ দেখতে পেরেছে।
হরিণ না দেখার অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে দুপুর বেলায় মোটর বাইকে চড়ে নামার বাজার থেকে বন্দরটিলা বাজারে রওনা দিলাম। যেখানে দুপুরের খাবার হিসেবে আমাদের জন্য তাজা কোরাল মাছ, হাঁসের মাংস, শিম ভর্তা আর আলু-কপির সবজি পাক করে রাখা হয়েছে।
দুপুরের খাবার শেষে সিডিএসপি বাজার ঘাট থেকে ট্রলার নিয়ে নদী পথে আবার ছুটলাম হরিণ দেখার মিশনে। বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নিঝুম দ্বীপের গভীর অরেণ্যে চলল হরিণ দেখার মিশন।
পাঁচ জন গাইডের সঙ্গে পাঁচ ভাগে বিভক্ত হয়ে দেড় ঘণ্টাব্যাপী চষে বেড়ালাম নিঝুম দ্বীপের কেওড়া, গর্জন আর বাইনের বন। কারো কারো চোখে পড়ল হরিণের ঝাঁক। কেউ কেউ দেখল একটি বা দু’টি। আর যাদের কপাল খারাপ, হরিণ না দেখেই তাদের ফিরতে হলো নিঝুম দ্বীপ থেকে।
পরের দিন সকালে নিঝুম দ্বীপকে বিদায় জানিয়ে হাতিয়ার তমরুদ্দিন ঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দুপুরে সেখান থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে উঠলাম লঞ্চে। আমাদের লঞ্চ এগুতে থাকল ঢাকার দিকে। দূর থেকে দূরে, আরো দূরে সরে যেতে থাকল নিঝুম দ্বীপ। কয়েক ঘণ্টা আগের দেখা নিঝুম দ্বীপ অনায়াসে ঢুকে পড়ল স্মৃতির পাতায়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৮, ২০১৬
এজেড/জেডএম
** নিঝুম দ্বীপ: মর্ত্যের বুকে এক টুকরো স্বর্গ-২
** নিঝুম দ্বীপ: মর্ত্যের বুকে এক টুকরো স্বর্গ-১
** শ্রমজীবী পরম বন্ধুরা!
** কি আশায় বাঁধি খেলা ঘর…
** ‘শ্রম কিনাঙ্ক কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি তলে’
** ‘মগু অ্যাটা হটু তোলেন’
** ঘাসিয়ার চরে মানুষের বসত
** ‘জানালার কাছে ডেকে গেছে এক পাখির মতন সকাল’