ঢাকা: নাটোরের ভূমিপুত্র ও সহকর্মী আবু তালহা ভাইয়ের দেওয়া পথনির্দেশনা মেনেই যাওয়া, ঠিকানা ঠিকঠাক। নাটোর সদর থেকে সিংড়া ব্রিজ, ব্রিজের নিচে আত্রাই নদী।
ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় হেড অব নিউজ মাহমুদ মেনন ভাইয়ের চোখেমুখে সকৌতুক সতর্কবাণী, বেদে পাড়া যাচ্ছো ভালো, কিন্তু সাবধান!
তার এই সতর্কবার্তার যৌক্তিকতা আছে বৈকি। আমরা যারা শহুরে-শিক্ষিত ভদ্দরলোক, তাদের মাথায় বেদে ও বেদে পাড়া নিয়ে দু’টো ভার্সন। এক, শহরের রাস্তায় রাস্তায় কৃষ্ণবর্ণ বেদে নারীরা কৌটায় সাপ নিয়ে ঘোরেন। সুযোগমতো কারও গলায় সাপ পেঁচিয়ে দিয়েই, দে, টাকা দে। সেইসঙ্গে বেদে মানে- ঝাড়ফুঁক, সিংগা লাগানো, দাঁতের পোকা ফেলা, সাপ পালন ও বিক্রি।
দুই, তারা শহর বা গ্রাম থেকে দূরে পোড়ো জমি ও নদীর ধারে অস্থায়ী তাঁবু টাঙিয়ে থাকেন। নদীতে নৌকা বাঁধা। আজ এখানে কাল ওখানে। যাকে বলে, যাযাবর জীবন।
মেনন ভাইয়ের ইশারা অবশ্য ছিলো মন্ত্র-তন্ত্র আর তুকতাকের দিকে। সাপ এমনিতেই প্রাণী হিসেবে বেশ রহস্যময় আর মোহময়ী। তাছাড়া নাগ-নাগিনীর নানা গল্প তো আমাদের মগজে ঠাসা। প্রচলিত সারকথা, বেদে নারীরা একেকজন সাক্ষাৎ নাগিনী, চোখের চাহনি তো নয় যেনো উদ্যত ছোবল! এই ফণার মোহ থেকে সাবধানে থেকো, ঠারেঠোরে এই ছিলো তার কথা।
যাইহোক, ছিলাম মান্তা পাড়াতেই। পা চলছে। এক ফাঁকে দু’তিনজনকে জিজ্ঞাসাও করা হয়ে গেছে।
ভাই, বেদে পাড়াটা কোনদিকে?
সিমেন্ট ঢালাই রাস্তা ধরে যতো এগোই, ততো অবিশ্বাস বাড়ে। নাহ, এ বেদে পাড়া হতেই পারে না! বলছে এখানে, হবে হয়তো সামনে। দূরে নদীও দেখা যায়।
এরপর আবার জিজ্ঞাসা।
হ্যাঁ, এটাই।
পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি। বোকা বনে গেলাম নাকি! রাস্তার দু’ধারে সব আলিশান বাড়ি। বাড়ি তো বাড়ি, একেবারে ঝাঁ চকচকে। অধিকাংশ বাড়ি ব্রিটিশ স্থাপত্যে বানানো। নাটোর সদর থেকে ১৫ কিমি দূরের এক গ্রামে ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকার বাড়ি যা-তা ব্যাপার নয়। তাও একটি-দু’টি হলে কথা ছিলো, একেবারে সারি সারি। চারপাশে যাদের দেখছি কারও হাতে সাপ নেই, সিংগা নেই। এতো বেদে পাড়া হতেই পারে না!
ভাই কোথায় যাবেন?
বললাম, ওই একই কথা।
তারও একই উত্তর, এটিই বেদে পাড়া। তবে শুধরে দিলেন, এটি এখন আর বেদে পাড়া বা মান্তা পাড়া নেই, পাড়সিংড়া গ্রাম।
ভ্যাবাচাকা মুখ দেখে আমাদের অস্থিরতা বুঝলেন। বুঝিয়ে বললেন তবে তার আগে জেনে নিলেন, কোথা থেকে আর কী উদ্দেশ্যে আসা। সরল আগ্রহের কথা জানিয়ে সন্তুষ্ট করা হলো তাকে।
‘আসলে বাইরের লোক ঢোকাটা গ্রামের কেউ পছন্দ করে না। বাইরে থেকে নিছক দরকার ছাড়া কেউ আসেও না তেমন। আপনারা হুট করে ঢুকলে কেউ সহজভাবে নেবে না। ঝামেলা হতে পারে। আমার সঙ্গে আসেন। এখন কিছু হবে না। আমি এই গ্রামেরই। ’
সহৃদয় বক্তার নাম হাবিবুল ইসলাম। কারিগরি ইনস্টিটিউট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার পাস। ঢাকায় দীর্ঘদিন চাকরিও করেছেন। এটিও অবাক করার বিষয়!
‘হ্যাঁ, এখানে পড়ালেখা কেউ বিশেষ করে না। মেয়েদের ১২ বা ১৩ বছরে বিয়ে হয়ে যায়। ছেলেরাও ১৭ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে বিয়ে করে ফেলে। তবে এখন পড়ালেখার হার আগের তুলনায় বাড়ছে। তাও খুব বেশি নয়। ’
আমাদের ঘুরিয়ে দেখানোর আগে একটু সময় চেয়ে নিলেন। হাবিবুল যেতেই তাকে ঘিরে ছোটখাটো জটলা। হাতে অনেকগুলো প্রেসক্রিপশন নিয়ে একটি দোকানে বসে গেলেন। বুঝতে কষ্ট হয় না, ওষুধ খাওয়ার নিয়মনীতি বুঝিয়ে দিচ্ছেন। গ্রামের অতি অল্পকয়েকজন শিক্ষিতের মধ্যে একজন, এটুকু দায়িত্ব তো তার কাঁধে বর্তায়।
ততোক্ষণে বুঝে গেছি, এখানে ঠিক হাতে কলম-প্যাড টাইপ সাংবাদিকতা চলবে না! নিছক দর্শনার্থীদের চোখ থেকে যতোটুকু দেখা যায় আর কী।
পাড়সিংড়া গ্রামের ভেতর দিয়ে সিমেন্ট ঢালাই রাস্তা শেষ হয়েছে আত্রাই নদীতে। বলা যায়, ঠিক নদীর পাড়জুড়ে গড়ে উঠেছে তাদের স্থায়ী বসতি। রাস্তার দু’ধারে ছোটখাটো চা-বিস্কুট আর মুদিখানার দোকান। দু’-একটি হোটেলও চোখে পড়লো। ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই নিজেরা-নিজেরা। যেহেতু নিজেরাই সব, তাই দোকান আর বাড়ির উঠানের পরিবেশের মধ্যে কোনো পার্থক্য পাওয়া গেলো না। যে যার খুশি খাচ্ছে, ঘুরছে, গল্প করছে। বাড়ি থেকে হাঁস এনে দোকানে বসে ছিলতেও দেখা গেলো।
হাঁস নিয়ে আলাদা করে দু’-চার লাইন লেখা যায়। পরে হাবিবুল ভাইয়ের কাছ থেকে জেনেছি, এ সম্প্রদায়ে হাঁস খুব জনপ্রিয়। সাপ্তাহিক হাটের দিনে হাঁস কেনার ধুম পড়ে যায়। এ কথার সত্যতাও মিললো, পরবর্তীতে গ্রাম ঘুরে খুব কম বাড়ি পাওয়া গেলো, যেখানে হাঁসকেন্দ্রিক ব্যস্ততা ছিলো না!
পায়ে আলতা-নুপুর, হাতে চুড়ি, গলায়-কানে যে যার পছন্দমতো সাজ দিয়ে ঘুরছে গ্রামের মেয়েরা। দেখলে মনে হবে, সেজেগুজে কোথাও যাচ্ছে। আসলে ঠিক তা নয়, বেদে নারীরা সেজে থাকতেই পছন্দ করে। রোজকার জীবনেও তারা বেশ পরিপাটি। এটিই তাদের সংস্কৃতি। দৃষ্টির ছোবলের বিষয়টি পাওয়া গেলো না। এগুলো হতে পারে অপপ্রচার। বাচ্চারাও যে যার মতো খেলছে-ঘুরছে।
‘যাযাবর’ ইঞ্জিনিয়ার ফিরে আসতেই শুরু হলো গ্রাম ঘোরা। প্রশ্নটি মনে উঁকি দিচ্ছিলো আগেই। হাঁটতে হাঁটতেই বেদে সম্প্রদায়ের এ অভূতপূর্ব পরিবর্তনের কথা তুললাম।
বেশ ধৈর্য নিয়ে বোঝালেন, এখন বেদেদের মধ্যে দু’টো ভাগ। একদল সাপুড়ে, যাদের সাপ নিয়েই কারবার। আর এই যে পাড়াটি দেখছেন, এখানকার অধিকাংশই বাজারে দোকান দিয়ে ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেখান থেকেই এই স্থায়ী বাড়িঘর। পুরুষদের বড় একটি অংশ ভারতের বিভিন্ন নামী আয়ুর্বেদিক ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করেন। সেখান থেকে ওষুধ এনে স্থানীয় বাজারে বিক্রির সঙ্গেও অনেকে জড়িত।
কিন্তু যাযাবর বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্থায়ী বাড়িঘর? ‘এখানে অধিকাংশই পাকা বাড়ি। এখনও কয়েকটি তাঁবু টাঙানো বাড়ি আছে। বাড়ির কাজ হচ্ছে তাই ওভাবে আছে। কাজ শেষ হলেই দালানবাড়িতে উঠে যাবে। দু’-একটি যা কাঁচাবাড়ি রয়েছে সেগুলোও দালান হওয়ার পথে। এরপরও অনেকেই এখনও নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অচেনা কোনো জায়গায় গিয়ে তাবু টাঙিয়ে ওষুধ বিক্রি করে। আমিও যাই মাঝেমধ্যে। ’
আপনিও!
‘হ্যাঁ, আমিও। বহুদিন চাকরি করেছি। দুঃখের বিষয় কী জানেন, বেদে বলে আমাদের এখনও সহজভাবে দেখা হয় না। কেমন ঘৃণার চোখে দেখে। চাকরি করতে গিয়েও এসবের মুখোমুখি হয়েছি। ’
নিজে থেকেই একটি বিষয় যোগ করলেন, আমাদের পাড়সিংড়া গ্রাম কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদভুক্ত। আমরা ভোট দেই। নির্বাচিত মেম্বারও আছেন। এরপরও আমাদের সম্প্রদায় প্রধান আছেন। উনিই আমাদের ভালো-মন্দ, বিচার-আচার দেখাশোনা করেন। পাড়ার সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তি প্রধান হন।
এসে যায় ধর্মের বিষয়টিও। পাড়ায় মসজিদ দেখা গেলো। নিয়ম করে আজান-নামাজ সবই হচ্ছে। বাইরে থেকে আমরা জানি, বেদেরা সনাতন ধর্মালম্বী হন, তাদের প্রধান দেবী মনসা।
‘না না, আমরা মুসলিমই। ’
আপনারা কী ধর্মান্তরিত? মানে আপনাদের পূর্ব-পূরুষরা কী সনাতন ধর্মালম্বী ছিলেন?
‘না, আমাদের বাপ-দাদারাও মুসলমান ছিলেন। ’
শুনেছি, মুসলমান হলেও আপনারা এখনও মনসা পূজা করেন?
‘না, এখানে কেউ মনসা পূজা করে না। ’
বুঝলাম, বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না। তাইবলে অন্যকথা থেমে থাকলো না। সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী বিয়ে করেছেন সতেরোতেই, এখন বয়স ছত্রিশ। মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন আগেই, জামাই বর্তমানে কোনো এক ওষুধ কোম্পানিতে কাজ নিয়ে ভারতে। একমাত্র ছেলেটির বয়স আট বা নয়।
ছেলে লেখাপড়া করছে কিন্তু নিজের লেখাপড়া নিয়ে আক্ষেপ শোনা গেলো, লেখাপড়া করেছি বলেই গরিব থেকে গেলাম। নাতো অন্যরা এটা-ওটা করে আজ বড়লোক। এখানে প্রায় সবাই লাখপতি। এজন্য পাড়ার দোকানগুলোতে জিনিসপত্রের দাম অন্য বাজারের তুলনায় বেশি। এখানে সবাই সচ্ছল। সবার হাতে টাকা তাই দাম বেশি দিয়ে হলেও ভালো জিনিসটি সবাই পেতে চান।
এই ‘এটা-ওটা’ নিয়ে আবার স্থানীয়দের অন্য মত, তাদের স্থায়ী বাড়িঘরের পিছনে রয়েছে সাপের বিষের ব্যবসা। প্রত্যেকেই নৌকায় সাপ পোষেন। এছাড়া নিজেদের তাবিজ-কবজ, ঝাড়ফুঁক বা নিজেদের তৈরি বিশেষ সব ওষুধের ব্যবসা রয়েছে। অনেকে তাদের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও আনেন।
আগেই বলেছি, ঘুরেছি দর্শনার্থী হিসেবে। তাই সত্য-মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করা দায়িত্বের মধ্যে ছিলো না। কাজেই উত্তুরে হাওয়ার অপরাহ্নটি তাদের পাড়ায় কাটানো কিছু মুহূর্ত হিসেবেই থাক।
জানা মতে, বেদেদের এরকম স্থায়ী নিবাস দেশের অন্যকোথাও নেই। অন্য অঞ্চলগুলোতে এখনও যাযাবররূপে বসবাস করতেই দেখা যায়। তবে কী শতাব্দীপ্রাচীন প্রথা ও সংস্কৃতি থেকে সরে গৃহস্থজীবনে ফিরছে?
বাংলাদেশ সময়: ০৮৪০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৩, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি/জেডএম
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)
** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম