চলনবিল (সিংড়া), নাটোর থেকে ফিরে: চলনবিল সিংড়া অংশের ১২ গ্রামের হাজারো মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার ডুবো সড়কেই (সাবমার্সিবল রোড) ডুবতে বসেছে দেশের স্বাদু পানির মাছের সবচেয়ে বড় উৎস চলনবিল। ‘উন্নয়নের সড়ক’ গ্রাস করছে বিলাঞ্চলের জীবন-জীবিকার প্রধান উৎস এ বিলকে।
সিংড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে উত্তর দিকে নাটোর-বগুড়া সড়ক ধরে অর্ধ কিলোমিটার এগোলেই চৌরাস্তা। এখানেই বালুয়া বাসুয়া গ্রাম। উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে ঢুকে যাওয়া পিচঢালা সড়কটির শুরুতে চলনবিল গেট। এখান থেকেই চলনবিল নাটোরের সিংড়া অংশের বুক ফেঁড়ে সিরাজগঞ্জের তাড়াশ চলে গেছে ২৮ কিলোমিটারের ডুবো সড়ক।
সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সড়ক হিসেবেই পরিচিত এটি। সিংড়া অংশে পড়েছে ১৪.৮৬০ কিমি। এর মধ্যে ৩৬০ মিটার ব্রিজ। চওড়া ২৪ ফুট। ১২ ফুট পাকা আর দু’পাশে শোল্ডার ১২ ফুট। তবে প্রথম তিন কিলোমিটার পিচের রাস্তা। এ অংশটুকু বেশি উঁচু। ডুববে না। পরের ১১ কিলোমিটার কংক্রিটের ডুবো সড়ক। প্রকল্প ব্যয় ২২ কোটি ২৩ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জানান, সিংড়া উপজেলা প্রকৌশলী হৃদয় কুমার দাস।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের সংসদীয় এলাকার মধ্যে পড়েছে এ সড়কটি। ২০১৩ সালের মাঝামাঝিতে সড়কটি উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী।
এলাকাবাসী ও পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য বিশেষজ্ঞদের কথা বলে জানা যায়, সড়কটি করে বালুয়া বাসুয়া থেকে বারুহাস পর্যন্ত শহরবাড়ি, কান্তনগর, ডেওয়াবাড়ি, তাজপুর, ইন্দ্রাসন, সাতপুকুরিয়া, মাগিরা, বড়িয়া, হিজলা ডহিয়া ও শেষ প্রান্তের তিয়াস গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের কাছে রীতিমতো ‘হিরো’ বনে গেছেন পলক। তবে সড়কের পাশজুড়ে ইউক্যালিপটাসের মতো পরিবেশ ও মাটির জন্য ক্ষতিকর গাছ লাগিয়ে, নিজের খালাতো ভাইকে রাস্তাঘেঁষে বিলের মধ্যে পার্ক তৈরি করার সুযোগ দিয়ে সেই ‘মহান’ কাজের চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছেন তিনি।
বালুয়া বাসুয়া থেকে পেট্রোলের মোড় পর্যন্ত তিন কিলোমিটার উঁচু রাস্তা পিচ ঢালাই। পরে শুরু ডুবো সড়ক। এ তিন কিলোমিটারে আবার পর্যটকদের বিল দর্শনের জন্য কিছুদূর পর পর বসানো হয়েছে ছাতা। সড়কের শুরু থেকে প্রথম এক কিলোমিটারের মতো সড়কের দু’পাশ জুড়ে গড়ে উঠেছে জনবসতি। এই বসতি দিনে দিনে বাড়ছে, গ্রাস করছে বিলকে।
এ সড়ক তৈরির আগেও এখানে চলার পথ ছিলো। তবে শুকনো মৌসুমে পায়ে হাঁটা-ভ্যান চলার পথ। সড়ক তৈরির পর দ্রুত পরিবর্তন হয়েছে সে অবস্থার। ধানের সময় ধান, চাল শুকানো কিংবা খড়ের গাঁদা তৈরির কাজও চলে সড়কে। এগোতে থাকলে কিছুক্ষণ পরেই চোখে পড়বে রাস্তালাগোয়া পুকুর, কলা বাগান। বর্ষায় ভরাবিলেও ডুববে না, এমনভাবে তৈরি বাগান সেগুলো।
এই সড়ক ধরে এগোলে হাতের ডানে-বামে পড়ছে ছোট-বড় ১২টি গ্রাম। গ্রামগুলো বিলের মাঝে বেশ আগে থেকেই। প্রতিটি দ্বীপ বনে যায় বর্ষায়। গ্রামগুলোতে বসবাস কয়েক হাজার মানুষের। তাদের প্রধান পেশা কৃষি ও মাছচাষ। পাকা সড়ক থেকে গ্রামে যাওয়ার জন্য মাটি ফেলে তৈরি করা হয়েছে কাঁচা সংযোগ সড়ক। এগুলোও হয়তো একদিন পাকা হবে। তারপর সেখানে বসবে দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
তিন কিলোমিটার পিচের সড়ক শেষে চতুর্থ ব্রিজের পর সামনে তাকালেই চোখে পড়বে ইটঘেরা একটি পার্ক। সড়ক থেকে একেবারে চলে গেছে বিলের অনেকটা জায়গাজুড়ে। সামনে গিয়ে দেখা গেলো সাইনবোর্ডে লেখা ‘চলনবিল পর্যটন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্র’। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পার্কটি নির্মাণ করেছেন প্রতিমন্ত্রী পলকের খালাতো ভাই কবির উদ্দিন। ৬-৭ মাস আগে এটি উদ্বোধনও করেছেন তিনি। তবে কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আরও মজার বিষয়, পার্কটি যিনি তৈরি করেছেন, তার নামে এ এলাকার নাম হয়েছে কবিরগঞ্জ। সাইনবোর্ডেও সেটি লেখা।
বিল যে গঞ্জ হতে বেশি বাকি নেই তা পার্কের আশপাশের জায়গায় তাকালেই বোঝা যাবে। বাঁশ-খুঁটি পুতে অস্থায়ী দোকানপাট বসেছে ইতোমধ্যে। স্থানীয়দের বক্তব্য, পার্কটি পুরোপুরি চালু হলে এটি গঞ্জই হয়ে যাবে।
রাস্তা ধরে সাতপুকুরিয়া গিয়ে দেখা গেলো বেশ জমে উঠেছে রাস্তালাগোয়া বাজার। গ্রাম থেকে এ ডুবোসড়কে যুক্ত হওয়া কাঁচা রাস্তাটির দু’পাশে অনেকগুলো দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। নতুন মার্কেটের জন্য বিলের জমি ভরাট করে ভিতও তৈরি করা হয়েছে।
বিলের অধিকাংশ জমি ব্যক্তি মালিকানায় থাকায় এসব করতে তাদের বাধা নেই। তবে রাস্তা না হলে বাজার, দোকান-পাট কিছুই কি হতো? সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এ সড়ক আসলে বিলের জন্য আর্শীবাদ না অভিশাপ? এ বিষয়ে কথা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মনোয়ার হোসেন তুহিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, রাস্তা অবশ্যই উন্নয়নের। কিন্তু তা প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতি করে নয়। চলনবিলের উপর দিয়ে রাস্তা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ইকো সিস্টেমকে বাধাগ্রস্ত করবে।
অধ্যাপক মনোয়ার বলেন, বিলে আমি ২৫ বছর আগে গিয়েছি গবেষণার কাজে। এভাবে রাস্তা হলে নিশ্চয় সেই স্বাভাবিক পরিবেশ থাকবে না। বিলের পাখি, মাছ, ভোঁদড়ের মতো প্রাণীর জন্য নির্দিষ্ট কিছু খাবার আছে। কেউ কেউ ঝোপঝাড় থেকে কীট-পতঙ্গ, বিভিন্ন উদ্ভিদ থেকে জীবন ধারণ করে। তাছাড়া রাস্তা মানে বিলকে বিভক্ত করা। এতে মাছের প্রজননক্রিয়া হুমকির মুখে পড়ছে।
রাস্তাকে কেন্দ্র করে যে শব্দ সেটিও বিলের জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি করবে বলেই মনে করেন এ অধ্যাপক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মো. খবির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, পানির উৎস সংরক্ষণ করা জরুরি। কিন্তু আমরা সেটা করছি না। বরং ধ্বংস করছি। আর রাস্তা বিলের স্বাভাবিক ইকো সিস্টেমকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ সময়: ০৮০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৪, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি
** ঝাড়ফুঁক-সাপ ছেড়ে ইমারতের পেটে!
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)
** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম