চট্টগ্রাম থেকে ফিরে: বসন্তের সকালে ঝিলমিল রোদ। নেই খুব একটা শিশির-কুয়াশার প্রভাব।
চট্টগ্রামের লালখান বাজার পেরিয়ে অফিসার্স কলোনি মসজিদের পাশ ঘেঁষে হেঁটে যেতেই এমন দৃশ্য। সঙ্গে শ্রাব্য বাসন্তী কোকিলের কুহতান।
উপরে যতই এগোনো— ততই এবড়ো থেবড়ো লাল মাটিতে সাবধানে পা ফেলা। যেতে পথে সামনেই বাঁ পাশে চোখে ভাসে বাটালী নামটি। যা বাটালী পাহাড় বা হিল নামে বেশ প্রসিদ্ধ, বন্দরনগরীর সবচেয়ে উঁচু স্থান এটি।
চট্টগ্রামের মূল কেন্দ্রে অবস্থিত এই বাটালী উচ্চতায় প্রায় ২৮০ ফুট। তবে ভয়ের কিছু নেই, পাহাড়ে ওঠায় যাদের নূন্যতম অভিজ্ঞতা নেই তারাও অনায়াসে বাটালীতে উঠতে পারবেন এমনটাই জানা গেলো দৌড়ে যাওয়া ওই মানুষগুলোর কাছ থেকে। একটু সামনে যেতেই স্পষ্ট হলো দৌড়ানোর কারণ। শরীর চর্চা অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে জগিং বলে সে উদ্দেশেই তাদের এমন দৌড়— এতে আছেন নারী-পুরুষ উভয়ই।
জগিংয়ে আসা এমনই এক ব্যবসায়ী জি হায়দার। তার সঙ্গে বাংলানিউজের কথোপকথনে জানা গেলো বিভিন্ন তথ্য। শোনালেন, উদ্যোগের অভাবের কথা। বললেন, এই পাহাড় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো ভাবনাই নেই। সুন্দর এই পাহাড় কেবল জগিংয়ের জন্যই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে, পর্যটক টানছে না। একটু গুছিয়ে উদ্যোগ নিলে বন্দরের সবচেয়ে উঁচু এই পাহাড় হয়ে উঠতে পারে আকর্ষণীয় বিনোদনকেন্দ্র।
তার সঙ্গে কথা বলে এগিয়ে চলা, প্রথমেই বাঁক খাবে উঁচু হাঁটা পথ। নাম সে জন্যই বুঝি ‘জিলাপি’। পথের দু’পাশে জঙ্গলের মুগ্ধতা; গভীর খাদও দৃষ্টি এড়ায় না। ততক্ষণে রোদের থেকে-থেকে ঝলকানিতে সৌন্দর্য আরও বাড়ছে। যেন বড়-বড় গাছের পাতাগুলো স্নান করছে রোদের কিরণে, হচ্ছে আরও সজীব-সবুজ।
এরই মধ্যে মতিঝরনায় চলে আসা। তবে ঝরনা ছিল এক সময়; জানালেন, স্থানীয় জামান হোটেলের সত্ত্বাধিকারী তৌহীদ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, পাহাড়টি গণপূর্তের সম্পত্তি। তারাই দেখভাল করছে। কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে এই পাহাড়ি এলাকা হয়ে উঠতে পারে আরও মনোরম। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও, কারণ পাশে বস্তি গড়ে উঠেছে, শঙ্কা সেখানেই। এছাড়া পরিষ্কার রাখতে হবে পরিবেশ, পর্যাপ্ত বসার জায়গাও বানাতে হবে।
মতিঝরনা পার করে ট্যাঙ্কি পাহাড়ে সাক্ষাৎ ব্যাংক কর্মকর্তা নারায়ণ বাসকের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ভোর থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এখানে মানুষের বিচরণ। তবে সকালে জগিং এবং বিকেলে কিছু সংখ্যক মানুষের ভ্রমণে সীমাবন্ধ এই স্থানটি। যা আরও গুছিয়ে আনলে স্থানীয়রা ছাড়াও সারাদেশ থেকে মানুষ আসতে পারবেন। হতে পারে বিদেশিদেরও ভ্রমণকেন্দ্র।
জগিংয়ে এসেছিলেন শ্যামল ও আফসার। তারা এই পাহাড়ি এলাকাকে কেন্দ্র করে ‘শতায়ু অঙ্গন’ নামে একটি ক্লাব গড়ে তুলেছেন। ক্লাবের পক্ষ থেকে রোজ শুক্রবার সকালে নাস্তার আয়োজন করা হয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এমন উদ্যোগের বাইরে সরকারি উদ্যোগ সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে মত দেন তারা।
যতই উপরে ওঠা ততই মুগ্ধতা ছড়ানো পথের পরিচিতি। গাছপালায় ঘেরা বনানীতে নজর কাড়ে সজনে গাছ ও ঝুলে থাকা সজনে। আরেকটু পথ মাড়িয়ে বাটালীর চূড়া। তবে তার আগে দেখা গেলো- চূড়ায় ওঠার জন্য পাহাড় কেটে বসানো লোহার সিঁড়ির ধাপ ক্ষয়েছে। যেন একেবারেই বেহাল দশা। একটু অসাবধানে পা রাখতেই ঘটতে পারে বিপত্তি। অর্ধেকটা পাহাড় ওঠার পর দেখা যায় নিরাপত্তা প্রহরীর ঘর। তারা আনসার সদস্য। দশজনের টিম। টিমের সদস্য মো. আবু সুফিয়ান বাংলানিউজকে জানান, পাহাড়ে সাধারণ মানুষের জন্য ভ্রমণের সময় নির্ধারিত দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত, সে সময় একাধিক আনসার সদস্য টহল দেন। দিনে-রাতে বাকি সময় একজন করে থাকেন টহলে। এই দলের কমান্ডার পিসি সবুজ মিয়া।
আনসার আবু সুফিয়ান বলেন, সিঁড়ি ঠিক করার জন্য শুনেছি টেন্ডার হয়েছে, কিন্তু কাজ হচ্ছে না। মানুষের উপস্থিতি ছুটির দিনগুলোতে ভালোই হয়, তবে পরিবেশ এবং ঝুঁকি কমানো গেলে আগ্রহ আরও বাড়ানো যেত।
টাইগার পাস দিয়ে নেমে আসার আগে চূড়া ঘুরে দেখা যায়, লোহার সিঁড়ি ফুটো হয়ে গেছে। পাশের রেলিংও নড়বড়ে। অতি দ্রুত এর সংস্কার প্রয়োজন এমনই মনে হবে দেখে। তবে এও মনে হবে যেন দেখার কেউ নেই!
এদিকে বাটালীর চূড়ায় উঠে দেখা যায় পুরো বন্দরনগরীকে এক কাতারে। এমন দৃশ্য দর্শন যেন সৌভাগ্যের মনে হবে ২৮০ ফুটে উঠে! চূড়ার মধ্যখানে রয়েছে বড় এক টাওয়ার, যা নিচে দূর থেকে দেখা যায়। বাদ যাবে না বিরামহীন ঠাণ্ডা বাতাস। সে বাতাস মনকে দোলা দেওয়ার মতোই, শিহরণও জাগায় মনে। সৌন্দর্যের প্রচুর্যকে ধরে রাখতে সে শিহরণই কি যথেষ্ট নয়...।
পরবর্তী পর্বে পড়ুন:
শঙ্কা নিয়েও মাটির পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে বাস
বাংলাদেশ সময়: ০৭৪০ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৬
আইএ/এসএস/জেডএম