খুবজীপুর, নাটোর থেকে ফিরে: নাটোর শহর থেকে দূরত্ব নেহায়েৎ কম নয়। ৪-৫ বার গাড়ি, অটোরিকশা, ভ্যান পরিবর্তন করে তবেই শিক্ষা-সংস্কৃতির সুতিগার খ্যাত খুবজীপুর।
আব্দুল হামিদের উদ্যোগে গড়া এমনই একটি প্রতিষ্ঠান চলনবিলাঞ্চলের ঐতিহ্য, ইতিহাস, সংস্কৃতিসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নিদর্শনের ধারক চলনবিল জাদুঘর। গুরুদাসপুরের খুবজীপুর অধ্যক্ষ আব্দুল হামিদ কমপ্লেক্সে ঢুকে বাঁয়ে নজরুল প্রগতি সংঘের গা ঘেঁষে যে জীর্ণ ভবনটির অবস্থান সেটিই চলনবিল জাদুঘর। আব্দুল হামিদসহ মোট প্রতিষ্ঠাতা ২৪ জন।
পাঁচ শতক জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা দোতলা জাদুঘর ভবনটির নিচতলা জাদুঘর। ওপরের তলার জীর্ণ দশা। দেয়াল উঠলে ছাদ ওঠেনি অর্থের অভাবে। তবে যেটুকু নিয়ে জাদুঘর সেটির অবস্থাও করুণ।
দুপুরে পৌঁছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের দেখা মিললেও খোলা পাওয়া গেলো জাদুঘরটি। পাশের নজরুল প্রগতি সংঘে দেখা মিললো দু’জন শিক্ষকের। তারা জানালেন, খোলার জন্য একজন লোক আছেন, কিন্তু লোকজন কম আসায় সবসময় তিনি থাকেন না।
এই কমপ্লেক্সে রয়েছে কেজি স্কুল, প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, মসজিদ, ক্লাব- সবই। মাঝের বড় মাঠ ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
দেখে বোঝা গেলো এর মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত মূল্যবান সব নিদর্শনের সংগ্রহশালা জাদুঘরটি। ১৯৭৮ সালে আব্দুল হামিদের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটিতে ১৯৮৭ সাল থেকে দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন মো. আবু বকর সিদ্দীক। তিনি নৈশপ্রহরী। মাস্টাররোল শ্রমিক। সঙ্গে রয়েছেন সহকারী আজার হোসেন।
প্রগতি সংঘের এক ব্যক্তি আবু বক্কর সিদ্দীককে খবর দিলেন জাদুঘরটি খুলে দেখানোর জন্য। তিনি এসে বারান্দার কলাপসিবল গেট খুলে অন্ধকারাচ্ছন্ন জাদুঘরে ঢোকালেন। ঢুকতেই ভ্যাপসা গুমোট গন্ধ নাকে জাপ্টে ধরলো। ধুলার আস্তরণ কম নয়। সংরক্ষণ করা নিদর্শনগুলোতে হাত দিতেই যেন ভয় পাচ্ছিলেন তিনি।
ঘুরে দেখতে না দেখতেই চোখ জ্বালা শুরু হলো। প্রথমে বুঝে উঠতে না পারলেও উপরের দিকে তাকিয়ে দেখা গেলো দুটি বড় ভেন্টিলেটর তারের জালি দিয়ে ঘেরা। সেখানে ঝুলে কালো হয়ে আছে। সেখান দিয়ে ঢুকছে ধোঁয়া।
আবু বক্কর সিদ্দীকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো ওপাশে রান্না হচ্ছে। এটা সেই ধোঁয়া। আর রান্না করছেন স্বয়ং এ জাদুঘরটি পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্বে থাকা আজার হোসেন!
শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় এখানে দর্শনার্থী কম আসে। আর সবসময় খুলে না রাখা প্রসঙ্গে আবু বক্কর বলেন, জাদুঘরটি ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। ১৯৯৪ সালে মো, হামিদ জাদুঘরটিকে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে দেন। তবে তিনি চুক্তিতে লিখে নিয়েছিলেন যে, জাদুঘরটি এখান থেকে সরানো যাবে না।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে মহাস্থান গড় জাদুঘরের অধীনে এটি পরিচালিত। এখান থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন চলে গেছে সেখানে। কোনো সরকারি অনুদানও পাওয়া যায় না। তাই ভবনটির দোতলার কাজও শেষ করা যাচ্ছে না।
তারা কত বেতন পান সেটা জানাতে লজ্জা পেলেন বলেই মনে হলো। যদিও সরকারি, তবু তারা সামান্য বেতন পান। যা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। তাই সবসময় খুলে রাখতে পারেন না বলেও জানান তিনি।
বেহাল দশার মধ্যে সরেজমিন জাদুঘরটি ঘুরে দেখে ও রেজিস্ট্রার খাতার তথ্য থেকে জানা যায়, এখানে প্রাচীন, মধ্যযুগের অনেক নিদর্শন সংরক্ষিত।
এর মধ্যে রয়েছে, ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে বাদশাহ আলমগীরের নিজ হাতে লেখা কোরআন শরিফ, পুরনো তুলট ৫শ’ বছর আগের হাতে লেখা কোরআন, সোহরাব-রুস্তমের পুরনো পুঁথি, গাছের ছাল, পাতায় লেখা গ্রন্থ, আসল প্রাচীন গাজীর পুঁথি, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ডায়েরি, পোড়া মাটির শিব লিঙ্গের অংশ বিশেষ, কালো পাথরের বিষ্ণু মূর্তির মাথা, পোড়া মাটির ফলকচিত্র, মূর্তি, পিতলের তৈরি লক্ষ্মী, কৃষ্ণ, বুদ্ধদেব, সরস্বতীর মূর্তি।
চলনবিল থেকে পাওয়া মনসার ঘটগুলো আকর্ষণ করার মতো। রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা গুলি, পুরনো পঞ্জিকা, কাচের বোতল, সামুদ্রিক শামুক, মাছের কাঁটা, হরিণের মাথা, হাতির দাঁত, খড়ম, হুক্কা, লাঙলের ফাল, বিভিন্ন প্রাচীন ডাক টিকিট, ৮০ দেশের মুদ্রা, চিঠি, দেশি-বিদেশি নোট, মিশরের পিরামিডের পাথর প্রভৃতি।
এখানে সংরক্ষিত রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম হাতে লেখা সংবিধানের মূল কপি। যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, এইচএম কামারুজ্জামান, মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদের স্বাক্ষর। এছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথনাথ বিশীর বিভিন্ন পত্র ও পেপার কাটিং রয়েছে এখানে।
এতো দুর্লভ দ্রব্যাদি ও পাণ্ডুলিপি থাকার পরও ধুঁকছে চলনবিল জাদুঘর। দেয়ালে আটকানো ঝুল-ময়লার ঝাপসা কাচের মতোই অবস্থা ভিতরে সংরক্ষিত জিনিসগুলোর।
এ বিষয়ে কথা হয় কলেজ শিক্ষক আব্দুল মতিন, আব্দুল মান্নান মুকুলের সঙ্গে। তারা নজরুল প্রগতি সংঘের অনেক পুরনো সদস্য। তারা বলেন, সরকার যদি অনুদান না দেয় তাহলে তো কিছু করার নেই। আর এখান থেকে সরানোর অনেক চেস্টা করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, সেটা না করতে পারাটাও অবহেলার কারণ হতে পারে।
জাদুঘরের জন্য যে উপযুক্ত পরিবেশ দরকার সেটা নেই এখানে। সংরক্ষণের জন্য শুধু ন্যাপথলিন ছাড়া আর কিছু মেলে না। সুতরাং, জাদুঘরটি ভবিষ্যৎ যে খুব সুখকর নয়, সেটা বলাই যায়। চলনবিলাঞ্চলের ঐতিহ্য ও দেশে বিদেশের বিভিন্ন মূল্যবান নিদর্শন টিকিয়ে রাখতে সরকারি নজরদারি আরও বেশি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ সময়: ০৭০৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৬
এসএস/এএ/এটি
** রস জ্বালিয়ে গুড় (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৬)
**ওষুধি গাছে ‘সুস্থ’ গ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৫)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৪)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ৩)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ২)
** চলনবিলের পথে-প্রান্তরে (পর্ব ১)
** আমহাটীর চামড়ায় সারাদেশে বাজে ঢাক-ঢোল
** ডুবো সড়কে ডুবছে চলনবিল
** ঝাড়ফুঁক-সাপ ছেড়ে ইমারতের পেটে!
** বিলের মাছ নেই চলনবিলের বাজারে (ভিডিওসহ)
** চলনবিলে হাঁস পুষে লাখপতি (ভিডিওসহ)
** হালতি বিলে দাগ কেটে ক্রিকেট, ধুমছে খেলা (ভিডিওসহ)
** ভাসমান স্কুলে হাতেখড়ি, দ্বীপস্কুলে পড়াশোনা
** দত্তপাড়ার মিষ্টি পান ঠোঁট রাঙাচ্ছে সৌদিতে
** একফসলি জমিতেই ভাত-কাপড়
** লাল ইটের দ্বীপগ্রাম (ভিডিওসহ)
** চলনবিলের শুটকিতে নারীর হাতের জাদু
** ‘পাকিস্তানিরাও সালাম দিতে বাধ্য হতো’
** মহিষের পিঠে নাটোর!
** চাঁপাইয়ের কালাই রুটিতে বুঁদ নাটোর
** উষ্ণতম লালপুরে শীতে কাবু পশু-পাখিও!
** পানি নেই মিনি কক্সবাজারে!
** টিনের চালে বৃষ্টি নুপুর (অডিওসহ)
** চলনবিলের রোদচকচকে মাছ শিকার (ভিডিওসহ)
** ঘরে সিরিয়াল, বাজারে তুমুল আড্ডা
** বৃষ্টিতে কনকনে শীত, প্যান্ট-লুঙ্গি একসঙ্গে!
** ভরদুপুরে কাকভোর!
** ডুবো রাস্তায় চৌচির হালতি
** হঠাৎ বৃষ্টিতে শীতের দাপট
** ঝুড়ি পাতলেই টেংরা-পুঁটি (ভিডিওসহ)
** শহীদ সাগরে আজও রক্তের চোরা স্রোত
** ‘অলৌকিক’ কুয়া, বট ও নারিকেল গাছের গল্প
** মানবতার ভাববিশ্বে পরিভ্রমণ
** সুধীরের সন্দেশ-ছানার জিলাপির টানে
** নতুন বইয়ে নতুন উদ্যম