পদ্মরাগ লোকাল ট্রেন থেকে: বামনডাঙ্গা যেতে হবে। বাউদিয়ার দোকানেই (পড়ুন ‘যান বাহে খায়্যা আসেন বাউদিয়ার দোকানের জিলাপি’) খবর পেলাম বামনডাঙ্গায় যেতে হলে ট্রেনই ভালো।
বাউদিয়ার দোকান থেকে একশ’ গজ গেলেই গাইবান্ধা রেলস্টেশন। স্টেশনের পাশেই মেথরপট্টি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে পৌঁছলাম স্টেশনের প্লাটফর্মে। (মেথরপট্টির এই গল্প ছাপা হবে আরেকদিন) স্টেশন মাস্টার বীরেন চন্দ্র সরকার জানালেন, লোকাল ট্রেন পদ্মরাগের আসার সময় হয়েছে। সান্তাহার থেকে আসা ট্রেনটি বামনডাঙ্গা হয়ে যাবে লালমনিরহাট।
দুই প্লাটফর্মের গাইবান্ধা স্টেশনটি সুন্দর ছিমছাম। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নও। ট্রেনের অপেক্ষায় রয়েছে নানা বয়সের প্রচুর যাত্রী। স্টেশন মাস্টার জানালেন, এই স্টেশনটি লাভজনক। যে কয়টি ট্রেন চলে তাতে যাত্রীদের ভিড় প্রচুর। বিনা টিকিটের যাত্রী নেই বললেই চলে। পরে ট্রেনেও সে কথার সত্যতা পেয়েছিলাম।
কথা বলতে বলতেই এসে গেল ট্রেন। বামনডাঙ্গা পর্যন্ত টিকিট মাথাপিছু ১৫ টাকা। মুজিবুর ভাই দুটো টিকিট কিনে আনলেন। ভিড় থাকলেও কপাল ভালো থাকায় ট্রেনে উঠেই সিট পেলাম দু’জনেই।
সিটে বসতে না বসতেই হুইসেল দিয়ে চাকা গড়ালো ট্রেনের। সামনের স্টেশন কূপতলা। কামরার এ মাথা থেকে ওমাথা একবার চোখ ঘুরিয়ে নিলাম। নানান বয়স, নানান শ্রেণি আর চেহারার নানান মানুষে ভরা পুরো কামরাটি।
এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোতে যেমন বাসের মত ‘তিন বাই তিন’ সিট থাকে, পদ্মরাগের সিটগুলো তেমন নয়।
ট্রেনটির সিট অনেকটা লম্বা বেঞ্চির মত। দুই পাশের জানালা ঘেষে দুটো লম্বা বেঞ্চ, মাঝখানে একটি। অনেকটা ম্যাক্সি বা টেম্পুর মতই।
টিটি এসে টিকিট চাইলো। আলাপ হলো টিটি শরীফুল হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, ট্রেনটির টিকিটের ইজারা নিয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তিনি সহ অন্যান্য টিটিরা ওই প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী। এই ট্রেনে টিকিট কাটছেন বছর খানেক। বেতন ৪ হাজার ৭শ’ টাকা বেসিক, সাথে দৈনিক ভাতা আছে।
বিএ পাস করে বেকার ছিলেন দীর্ঘদিন। এর পর ঢোকেন এই টিটির চাকরিতে। জানালেন ভালো একটা চাকরি পেলে ছেড়ে দেবেন কাজ।
এক মুখ সাদা দাড়ি নিয়ে মুখোমুখি বসে আছেন এক চাচা। ‘চাচা কোনটে যাবেন?’, উত্তর দিলেন, ‘ বাবা চৌধুরানী যামো, তোমরা কি সামবাদিক?’। হ্যাঁ সূচক সায় দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ‘আবাদ কেমন?’ উত্তর দিলেন, ‘খুব ভালো বাহে’।
ট্রেন চলছিলো লাইন ধরে হালকা চালে। দুই পাশে অবারিত সবুজ ধানের ক্ষেত। কাচ ও রডবিহীন জানালা দিয়ে বাতাস আসছিলো হু হু করে।
পার হলো ছোট্ট স্টেশন কুপতলা। পাশে বসা যাত্রী আব্দুল লতিফ। বছর পঁচিশেকের এই যুবক চাকরি করেন গ্রামীণ ব্যাংকে। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে গ্রামীণ ব্যাংকের একটি সমস্যার কথা জানালেন। তার দাবি একটা নিউজ যেন করি। ফোন নাম্বার দিলাম।
ঘুরে ঘুরে বাদাম বিক্রি করছে এক বাদামওয়ালা। ডেকে ৫ টাকার বাদাম কিনলাম। দাউদের মলম বিক্রি করছেন এক হকার। তার ওপেন চ্যালেঞ্জ, যদি ওষুধে তিন দিনের মধ্যে দাউদের চুলকানি ভালো না হয়, তবে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন, সাথে নিজে খাবেন ৫০টা জুতার বাড়ি।
চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কাউকেই বিশেষ আগ্রহী দেখলাম না।
পার হলো নলডাঙ্গা স্টেশন। এখানে ট্রেনটি থামে দুই তিন মিনিটের জন্য। বেশ কিছু যাত্রী উঠলেন, অনেকেই নামলেন। কামরার যাত্রী সংখ্যা মোটামুটি একই।
কামরায় উঠলেন এক ক্ষীরার হকার। ট্রেনে ঘুরে ঘুরে ক্ষীরা (এক ধরনের শসা) বিক্রি করেন হকার সাইফুল। ২০ বছর ধরে এই পদ্মরাগ সহ এই রুটের অন্যান্য লোকাল ট্রেনে হকারি করেন তিনি। বছরের একেক সময় একেকটা বেচেন। এখন শসার সময় তাই শসা বিক্রি করছেন।
সাইফুলের বাড়ি বাদিয়াখালীতে। সারাদিনে খরচ বাদে শ‘ তিনেক টাকা লাভ থাকে। একটাই ছেলে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।
জিজ্ঞেস করলাম ‘কোনো স্বপ্ন আছে কি না?’ উত্তর না দিয়ে একগাল হাসলেন, ‘ না বাহে কোনো স্বপ্ন নাই, কোনোমতে খায়া পড়ি বাঁচি থাকলেই হলো’। ছেলে এই পেশায় আসবে কি না জিজ্ঞেস করায় বললেন, ‘ যদি ক্ষীরায় বেচপার নিয়া আসমো, তালে ব্যাটাক আইএ পড়াতিছি ক্যা?’
এসে পড়েছে বামনডাঙ্গা স্টেশন। তাড়াহুড়ো করে নেমে পড়লাম। মাঝে ট্রেনে কেটে গেছে ৪৫ মিনিট। তবে পুরোটা সময় একটুও একঘেয়ে লাগেনি। গ্রামবাংলার সহজ সরল মানুষগুলোর সঙ্গে গল্প করতে করতে কখন যে সময়টুকু পেরিয়ে গেল তা টের পাইনি একটুও।
এই সংক্ষিপ্ত যাত্রায় সংবাদ করার মত কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মানুষগুলোর সাহচার্য ও সরল কথোপকথন মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো বহুক্ষণ।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৬
আরআই