পেঁচার দ্বীপ থেকে: নির্দিষ্ট গন্তব্যের চেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে থামলো সিএনজিচালিত অটোরিকশা। অন্য সহকর্মীদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া- গন্তব্য আগে না পরে! মানে পেছনে ফেলে এলাম না আরও সামনে।
এটিই আসল ব্যাপার। সবকিছুতেই মারমেইডের এমন নিজস্বতা তৈরি হয়েছে যে, ওরকম ‘সিল’ পড়ে যায়। ও হ্যাঁ, এই মারমেইড মানে- মারমেইড বিচ রিসোর্ট।
তবে ‘মারমেইড’ লিখলে যে সবার আগে যে এই বিচ রিসোর্টের নাম আসে তা কিন্তু নয়। দুনিয়াজুড়ে মারমেইডের প্রায় সবটুকু ‘ক্রেজ’ লেখক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসেন সৃষ্ট মারমেইডের দখলে। বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘মৎসকন্যা’। অ্যান্ডারসেনের মৎসকন্যা আক্ষরিক অথেই তাই- অর্ধেক মানবী, অর্ধেক মৎস। মানবী থাকবে ডাঙায় আর মৎস থাকবে পানিতে। কিন্তু মৎসকন্যা ডাঙাতেও থাকে, পানিতেও। ঠিক এখানেই মিল পৌরাণিক মারমেইড আর মারমেইড বিচ রিসোর্টের। তাদের ওয়েবসাইটে লেখা রয়েছে, ‘এক মিনিট দূরত্বে সমুদ্র’। এক্ষেত্রে বলা যায়, যারা এখানে থাকছেন তাদের এক পা ডাঙায়, অন্য পা পানিতে।
নামটি কী এভাবেই ভাবা? জেনারেল ম্যানেজার মাহফুজুর রহমানের কাছে প্রশ্ন, ‘এটি আমরা সঠিক জানি না। আমাদের এমডি স্যার, যিনি এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি ভালো বলতে পারবেন। এই মুহূর্তে তিনি দেশের বাইরে। তবে মারমেইড নাম যেহেতু, এরকমই কিছু ভাবনা হয়তো ভেবে থাকবেন। ম্যাডামও দিয়ে থাকতে পারেন নাম। ’
এর মধ্যে আমরা এক অন্যভুবনে ঢুকে গেছি। ঢুকতেই বা-দিকে ওয়াটার লিলির গাছ, তাতে চারটি ফুল। এরও বামে দু’টি লাল-হলুদ ফুল তবে সেগুলো ডিঙি নৌকায় আঁকা। এভাবেই সেজে উঠেছে প্রবেশদ্বার। সরুমতো পথ, একপাশে সারি সারি হলদে লণ্ঠন। যেনো কোনো অদৃশ্য অভ্যর্থনাকারী পথ দেখিয়ে পৌঁছে দিচ্ছে মায়ালোকে। ঝুলছে বাবুই পাখির বাসা, পানিতে ভাসছে লাল-সাদা ফুলের পাপড়ি। বুনোফুলের থোকাও উঁকি দিচ্ছে কাঠের ফুলদানীতে। ছনের চাল, বাঁশের বাতা, কাঠের টেবিল, হারিকেনের চিমনি, ইতিউতি উঁকি দেওয়া পদ্মফুল- কী নেই সেখানে! নতুন কেউ গেলে ধন্দে পড়ে যাবেন শতভাগ। মনে হবে, কোনো ক্ল্যাসিক চলচ্চিত্রের সেট ডিজাইন! এতো সাজানো-গোছানো, এতো নান্দনিক কীভাবে সম্ভব হলো?
মাহফুজুর রহমানের উত্তর, এসবই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী আনিসুল হক চৌধুরী সোহাগের ভাবনা। দিন-রাত পরিশ্রম করে মারমেইডকে এই অবস্থানে এনেছেন তিনি। ট্যুরিজম নিয়ে তার যে প্যাশন, তা আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না! বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে আইডিয়া নিয়ে দেশীয় প্রেক্ষাপটে সেগুলো কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকৃষ্ট করে চলেছেন তিনি।
কথা প্রসঙ্গে কথা এগোয়। জানান, আপাতত ১৪টি রুমের মধ্যে ৮টি বাংলো (প্রতি রাত ১১ হাজার টাকা), ৪টি ভিলা (১৪,৯৪০ টাকা) ও ২টি ফ্যামিলি কটেজ (১২ হাজার টাকা)। রয়েছে কাপল (১২,৫০০ থেকে ২৯,৯০০) ও হানিমুন প্যাকেজ। সারাবছরই ট্যারিফ একই থাকে। এছাড়া রেস্তোরাঁ ৪টি। তাতে জিভে জল আনা সব দেশি-বিদেশি খাবার। ৯৫ জন কলাকুশলীসহ রয়েছেন ২৭ জন নিরাপত্তাকর্মী। কাজ থেমে নেই, লক্ষ্য- আগামী ছয় মাসের মধ্যে ৪০টি রুম গড়ে তোলা। একইসঙ্গে নির্মাণকাজ চলছে কনফারেন্স হলের।
এতোসবের মহাসমারোহ নিয়ে মারমেইডের ভৌগলিক অবস্থান কক্সবাজার শহর থেকে ১৪ কিমি দূরে। ট্যাক্সিতে গেলে ২০ মিনিট বা অটোরিকশায় গেলে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। এখানকার প্যাঁচার দ্বীপে সম্পূর্ণ কোলাহল ও নাগরিক কায়ক্লেশমুক্ত নির্জন পরিবেশে গড়ে উঠেছে পরিবেশবান্ধব এ বিচ রিসোর্ট। রেযুখাল নদীর তীরে দ্বীপটির অবস্থান। প্যাঁচার দ্বীপের নামকরণ নিয়েও মজার আখ্যান, একসময় নাকি অগুনতি প্যাঁচার বসবাস ছিলো এ অঞ্চলে- সেখান থেকেই এ নাম।
শহর থেকে একটু দূর হয়ে গেলো না?
‘সবাই তো এটাই চায়। নিরিবিলি, নিরাপত্তা আর প্রাইভেসি। তাছাড়া এরকম পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট তো শহরের বাইরে ছাড়া হবেও না। বিদেশিরাসহ দেশের একটি শ্রেণির মানুষ শুধু রিল্যাক্স করতে এখানে আসেন। তারা আগে বেড়াতে যাওয়ার জন্য থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়াকে বেছে নিতেন। এখন মারমেইডের কারণে কক্সবাজার আসছেন। থাইল্যান্ডের সবকিছু তারা যদি এখানে পেয়ে যান তাহলে আর সেখানে কেন যাবেন! মারমেইডেরও সেই একই চেষ্টা। আমাকে অনেক ফরেনার বলেছেন, কক্সবাজারে যে এতো সুন্দর সি বিচ আছে তা মারমেইডে না এলে জানতেই পারতাম না। এই যে তাদের আসা শুরু হয়েছে, এখন এটা ধরে রাখাই বড় দায়িত্ব। কক্সবাজারকে ১২ মাস নানাভাবে ব্যস্ত রাখতে চাই আমরা।
সূর্য ডোবা ডোবা মুহূর্তে এখানে আগমন। ততক্ষণে ঘোর সন্ধ্যে। ভেতরটা ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে পরিবেশবান্ধব রিসোর্টের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন, ইকো ট্যুরিজমের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রাকৃতিক কোনোকিছুকে নষ্ট না করে উপভোগ্য কিছু তৈরি করা। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে সবকিছু বানানো হয়েছে।
বলে চলেন মাহফুজুর, ঘরগুলোকে এমনভাবে তৈরি করা যেনো গাছের উচ্চতা ছাড়িয়ে না যায়। চারপাশের নৈসর্গিক দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সব জায়গার মাটি ও কাঠের রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। অযত্নে বেড়ে ওঠা বুনো লতা-পাতা-ফুলও আমাদের সৌন্দর্যের বড় অংশ। রুমগুলোর দরজা-জানলা ইচ্ছে করেই বড় করে রাখা যেনো অতিথিরা বৃষ্টি-বাতাস পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন। রাতের অপরূপতা পুরোপুরি উপভোগ করতে চোখ ধাঁধানো নিয়ন আলোর পরিবর্তে খয়েরি ঠোঙার ভেতর মোমের আলো ব্যবহার করা হয়েছে।
খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি খুব জোর দিয়ে বললেন, এখানে খাবার-দাবার, ফলমূল, মাছ-মাংস- সব তাজা। দিনের বাজার দিনেই করা হয়। কোনোকিছু রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা হয় না। বোট থেকে সরাসরি আমরা মাছ কিনে আনি। কারণ, বোট ঘাটে যাওয়ার পর মাছে ফরমালিন মেশানো হয়। এর আগেই আমরা তাজা মাছ কিনে আনি। এছাড়া আমাদের দু’জন কর্মী রয়েছেন যাদের কাজ হলো, রোজ স্থানীয় গ্রামগুলোর বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাজা ফলমূল, শাক-সবজি নিয়ে আসা। সকালে তারা বের হয়ে যান, যার বাড়িতে যা পান- ন্যায্য দামে নিয়ে আসেন। এর ফলে স্থানীয়রা অর্থনৈতিকভাবেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। আমরাই তাদের বড় ক্রেতা। এ অঞ্চলে আগে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না, আমরাই উদ্যোগ নিয়ে রূপরেখা বদলে দিয়েছি।
অবকাশযাপন ও চিত্ত বিনোদনের জন্য রয়েছে- জেট স্কি রাইডিং, কায়াক রাইডিং, বিচ বাইকিং, সার্ফিং প্রশিক্ষণ, পেইন্টিং ক্লাস, লাইভ বারবি কিউ, বিচে ক্যান্ডেল লাইট ডিনার, হিল ট্র্যাকিং, ডিপ সি ট্রিপ, ব্যক্তিগত ফটোশ্যুটসহ আরও অনেককিছু। মোটকথা, প্রকৃতিপিপাসুদের সুকুমার ইচ্ছের কোনোকিছুই তারা অপূর্ণ রাখবেন না। বিশেষভাবে ব্যবস্থা নেবে মারমেইড কর্তৃপক্ষ।
জেনে নিলাম স্বাস্থ্যসেবার দিকটিও, মারমেইডের সামনেই সার্বক্ষণিক একজন এমবিবিএস ডাক্তার। হঠাৎ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
‘আপনাকে একটি জিনিস লিখে দেই, অতিথিদের কোনো কম্প্লেইন এতো দ্রুত কেউ আমলে নেয় বলে জানা নেই। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ব্যবস্থা নেই’, যোগ করেন মাহফুজুর।
এতো এতো আয়োজন, এতো দায়িত্ব- তখন তা পালনে সমস্যা থাকে বৈকি। তা জানালেনও আক্ষেপের সুরে, একটি কথাই বলবো- স্বাধীনভাবে কাজ করতে চাই। আমরাও তো পরিবেশের বিষয়টি বুঝি। সেভাবে ইকোফ্রেন্ডলি করেই সব হচ্ছে। নিজেদের রেজিস্টার্ড জমি হওয়া সত্ত্বেও নানা দিক থেকে বাধা আসে।
তারপরও কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, যাবেন। কারণ, তাদের কাছে ট্যুরিজম হচ্ছে, ‘নোবেল পেশা’। তার ভাষায় সারমর্ম টানলে, ‘এটি শুধু ব্যবসা নয়, সেবাও। কাজেই হৃদয় দিয়ে হসপিটালিটিতে আসতে হবে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১১৪৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৬, ২০১৬/আপডেট: ১৪৪২ ঘণ্টা
এসএনএস/এমজেএফ/
** তৈরি হচ্ছে ‘বিচ ডাটাবেজ’