সেন্টমার্টিন ঘুরে: প্রবাল পাথরের ওপর বসে আরামে জিরোচ্ছে ছোট ছোট শামুকগুলো। পশ্চিমে প্রবাল প্রাচীর পেরিয়ে আসা ঢেউয়ের ছিঁটায় ভিজছে।
ভর দুপুরে এই চান্দি ফাটা রোদেও কী দারুণ শীতল জায়গাটা। শামুকের মতো আরও কতো যে জলজ জীব এই প্রবাল বনের অগভীর জলে জিরোতে এসেছে কে জানে!
শব্দহীন হলেও বালুর ওপর দিয়ে যে মানুষ হেঁটে আসছে তা কী করে যেনো টের পেয়ে গেলো শামুক দল। একের পর এক নিজেদের খোলসের ভেতর গুটিয়ে নিয়ে শরীর ছেড়ে দিতে শুরু করলো। খসে পড়তে থাকলো নিচের প্রবালে। পাথরের গায়ে খোলস ঠোকার শব্দ উঠলো টুক টুক টুক। সাগরের ছন্দোবদ্ধ গর্জনের সঙ্গে গাছগাছালির মর্মর ধ্বনি মিশে এখানে যে মায়াবী সুরের বলয় তৈরি হয়েছে, তাতে বাড়তি মাত্রা যোগ করলো শামুক খসে পড়ার টুক টুক সিম্ফনি।
এই সিম্ফনি মানুষের জন্য উপভোগের হলেও জলজ জীবদের জন্য বেদনাদায়কই বটে। আরামের আশ্রয় থেকে খসে পড়ে শামুকগুলো যেনো বুঝিয়ে দিলো, এখানে এসো না। এখানে আমরা থাকি। তোমরা এলেই আমাদের পালাতে হচ্ছে।
তাদের দেখাদেখি কোথায় যেনো মুখ লুকোলো শামুকের খোলস পরে গুটি গুটি পায়ে হাঁটতে থাকা কাঁকড়ারাও। ছেঁড়া দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের ওই প্রবাল স্বর্গের চাপা কান্নার রেশ দেখা গেলো সেন্টমার্টিনের মধ্যপাড়ার পূর্ব দিকের প্রবাল বনেও। সেখানে এ প্রবাল সে প্রবাল মাড়িয়ে অগভীর পানিতে সুতোর বড়শি ফেলছেন তোতা মিয়া। বড়শিতে গাঁথা ছোট ছোট লাল কাঁকড়া। লাগোয়া সৈকতেই বালিতে গর্ত খুঁড়ে তুলে আনা কাঁকড়াগুলোকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে নাইলনের সুতোর মাথায় বাঁধা বড়শিতে।
ছিপহীন সুতো ফেলে প্রবালের ফাঁকে আশ্রয়ে নেওয়া একটা ছোট কোরাল তুলে আনলেন তোতা মিয়া। সহযোগীর হাতের খলুইতে এরই মধ্যে জমে গেছে কেজি দেড়েক মাছ।
এভাবেই শত শত তোতামিয়ার হাতে নিত্যদিনই মারা পড়ছে লাল কাঁকড়া, বাচ্চা কোরালসহ হরেক প্রজাতির মাছ, ডলফিন। নিঃশেষ হচ্ছে প্রবাল-শৈবাল। অথচ এই প্রবাল কিন্তু পৃথিবীর সব সাগরে জন্মায় না। সেন্টমার্টিনের আশপাশের স্রোতের গতিধারা, আলোর মাত্রা ও পানির স্বচ্ছতা প্রবাল জন্মানোর উপযোগী। সেন্টমার্টিন তাই বাংলাদেশের স্বর্গ, একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এই উপমহাদেশে সেন্টমার্টিন ছাড়া আর মাত্র একটিই প্রবাল দ্বীপ আছে ভারতের রামেশ্বরে।
বর্তমানে সেন্টমার্টিনের চারিদিকে দেওয়ালের মতো দেখা যায় প্রবাল প্রাচীর। আর এই প্রবাল কিন্তু গঠিত হয় প্রাণীর শরীর থেকে। এককোষী এই প্রাণী প্রজাতি ভেদে বিভিন্ন আকৃতির। এরা দলবদ্ধ জীবনযাপন করে।
হাজার হাজার বছর ধরে শরীরে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমিয়ে রাখে প্রবাল। একসময় তা জমে শক্ত হয়ে যায়। বছরের পর বছর প্রবাল জমে প্রাচীরের রূপ নেয়। মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত এসব প্রাচীর সামুদ্রিক ঝড় আর জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা করে সাগরতীরের মাটিকে। সুনামি আর জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে এটা ঠিক যেনো প্রাকৃতিক দেয়াল। কার্যত এই প্রবাল হলো সাগরের চিরহরিৎ বন। প্রবালে অক্সিজেনের মাত্রা বেশী থাকায় এখানে প্রাণের প্রাচুর্য সাগরের যে কোনো পরিবেশের চেয়ে অনেক বেশী।
সমুদ্র বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দ্বীপের তলদেশে প্রায় অর্ধশত কিলোমিটার এলাকা সামুদ্রিক প্রাণির আতুড়ঘর। প্রবাল-শৈবালের ডিপো। মাছ ও মাছের খাবার এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জীবের প্রজননের উপযুক্ত জায়গা। প্রবাল থাকলে ডিমওয়ালা মাছ সহজে জালে ধরা পড়ে না। প্রবালে খাঁজ থাকে। তাই প্রবালে ছাড়া ডিম অন্য কেউ খেতেও পারে না। রেনু পোনার জন্য প্রবাল এক নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
তাই সব মিলিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, পাঁচ প্রজাতির উভচর প্রাণি, ১২০ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়।
আরও রয়েছে পাঁচ প্রজাতির দুর্লভ কাছিম, ১৫ প্রজাতির সাপ, পাঁচ প্রজাতির টিকটিকি-গিরগিটি। স্থানীয়ভাবে পেজালা নামে পরিচিত লাল অ্যালগি সেন্টমার্টিনে প্রচুর পাওয়া যায়। এ ছাড়াও রয়েছে ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী। অমেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে রয়েছে স্পঞ্জ, শিলা কাঁকড়া, লবস্টার। মাছের মধ্যে রয়েছে পরী মাছ, প্রজাপতি মাছ, সজারু মাছ, বোল কোরাল, রাঙ্গা কই, সুঁই মাছ, লাল মাছ, উড়ুক্কু মাছ ইত্যাদি।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষের লাগামহীন লোভের খাঁড়ায় পড়ে অতুলনীয় এই দ্বীপ এখন ধ্বংসের পথে। প্রবাল জমার ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে কাজ করছে বৈশ্বিক উষ্ণায়নে উষ্ণ হয়ে ওঠা সাগরের পানি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রবাল বিলুপ্ত হচ্ছে পর্যটকবাহী জাহাজ থেকে নির্গত তেলে।
স্থানীয়রা অবলীলায় তুলে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করছে নানা আকৃতির প্রবাল। আনিন্দ্যসুন্দর এসব প্রবালের কোনটা মগজ আকৃতির, কোনটা বাসন, কোনোটাবা হরিণের শিং এর আকার নিয়েছে। আরও রয়েছে ফুল, পাহাড়ের চূড়া আর ছাতা আকৃতির বিভিন্ন প্রজাতির প্রবাল। পর্যটকরা সস্তায় এসব কিনে নিয়ে সাজিয়ে রাখছেন বাড়ির ড্রয়িং রুমে। তারওপর এক প্রজাতির সবুজ শ্যাওলা তুলে সমুদ্রপথেই পাচার হচ্ছে থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, চীনসহ বিভিন্ন দেশে। সেন্টমার্টিন লাগোয়া সাগরের তলদেশের শৈবাল আর শ্যাওলা সবজি ও স্যুপ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয় ওসব দেশে।
তাই প্রতিদিনই প্রবালের মতো মূল্যবান সম্পদ হারাচ্ছে সেন্টমার্টিন। সঙ্গে শুরু হয়েছে সাগরের প্রতিশোধ। জোয়ারের স্রোতে এরই মধ্যে জোয়ারের পানিতে ধুয়ে গেছে পশ্চিম ও উত্তর দিকের অধিকাংশ বালিয়াড়ি। ঘূর্ণিঝড় কোমেন ও জলোচ্ছ্বাসে ধ্বংস হয়ে গেছে দ্বীপের সুরক্ষা লাইন হিসেবে বিবেচিত কেয়াঝোপ ও নিষিন্দা লতা।
মানুষের উৎপাতে আগের মতো আর ডিম দিতে আসছে না কচ্ছপ। পাখি আর স্তণ্যপায়ী প্রাণীগুলো তো খাদ্য সংকটে হারাতেই বসেছে।
কেয়া গাছ কেটে চুলায় জ্বাল চড়াচ্ছে স্থানীয়রা। চরাঞ্চলে ব্যাপক হাঁটাহাঁটিতে পিষে যাচ্ছে কচি কচি নিসিন্দা ও গাঙ্গ লতা। ১৯৭২ সালে যেখানে মাত্র ১১২টি পরিবার ছিলো সেখানে এখন সেন্টমার্টিনের পরিবার সংখ্যা দেড় হাজার। সঙ্গে ফি বছর পড়ছে চার লাখ থেকে পাঁচ লাখ পর্যটকের বাড়তি চাপ। বাড়তি পর্যটকের চাপে তাই তৈরি হচ্ছে অগণিত হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। এসব আবাসিকের ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দূষিত হচ্ছে সেন্টমার্টিন লাগোয়া সাগরে পানি, মরে যাচ্ছে প্রবাল।
সরেজমিনে দেখা গেলো, পুরো দ্বীপ প্লাস্টিকের বোতল আর পলিথিনে সয়লাব। যেখানে-সেখানে ফেলা হচ্ছে খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ, ময়লা-আবর্জনা।
পলিথিন, বিয়ারের কৌটা, কোমলপানীয় ও প্লাস্টিকের পানির বোতলসহ নানা ধরনের জিনিস ফেলে আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত করা হয়েছে সেন্টমার্টিনকে। রাতের বারবিকিউ পার্টি, উচ্চস্বরে গান আর জেনারেটরের শব্দ ভয় পাইয়ে দিচ্ছে দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া প্রাণিকূলকে। যদিও উপকূলীয় ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য রক্ষায় পরিবেশ অধিদফতর ১৯৯৫ সালে কক্সবাজারের টেকনাফ সমুদ্র সৈকত ও সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুসারে, সংকটাপন্ন ওই এলাকায় প্রবাল, শৈবাল, শামুক, ঝিনুক সংগ্রহ ও বিক্রি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে। আরও নিষিদ্ধ করা হয়েছে মাছ, কচ্ছপ ও অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর যেকোনো কাজ, পাথুরে ও প্রবাল শিলা আহরণ, যেকোনো নির্মাণ কাজে পাথুরে ও প্রবাল শিলার ব্যবহার।
এ আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ দু্ই লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে শাস্তির বিধান থাকলেও কার্যত কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই দ্বীপটির সাগর গর্ভে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দিন দিনই বাড়ছে।
কেননা চামচাকৃতির একটি প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে সেঁটে রয়েছে সেন্টমার্টিন। সমুদ্রের গভীর তলদেশ দিয়ে প্রাকৃতিকভাবেই গঠিত এই সংযোগ বাঁটটি প্রবালের জীবাশ্ম দিয়েই তৈরি। কাজেই অধিক ওজন বহনের ক্ষমতা নেই তার। তাই বাড়তি মানুষ আর স্থাপনার চাপে যে কোনো সময় ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে সেন্টমার্টিনের। আর সেটি ভেঙ্গে গেলে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৩.৬ মিটার উঁচু সেন্টমার্টিন তলিয়ে যাবে সাগর গর্ভে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে এখন তাই কান পাতলেই যোনো শোনা যায় প্রবালের আর্তনাদ। রাত-দিন এখন পায়ের নিচে প্রবাল কাঁদে সেন্টমার্টিনে।
বাংলাদেশ সময়: ১৮০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০১৫
জেডএম/এসএনএস