সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে: সৌন্দর্য সেখানে হাতছানি দেয় সবচেয়ে বেশী। নীল জলরাশি, ঝিনুকাকৃতির বাঁক।
ওই ঘটনার পর থেকে সেন্টমার্টিনের উত্তর বিচের পরিচিতি মৃত্যুকূপ হিসেবে। জায়গাটিকে উত্তর-পূর্ব কোণও বলে। উত্তর থেকে পশ্চিমে তাকালে ডানে হালকা প্রবালের বিচ, কিনারে দ্বীপবাসীর একমাত্র কবরস্থান। সৌন্দর্য, মৃত্যুকূপ-কবরস্থান- সব মিলিয়ে তৈরি হয়ে ভিন্নজাগতিক আবহ। একের পর এক মৃত্যুর ঘটনায় এই জায়গাটি নিয়ে গড়ে উঠছে নানা গল্প, মিথ। কেন মৃত্যুকূপ হয়ে উঠেছে দ্বীপের গোসল করার জন্য উপযুক্ত এ স্থানটি?
টেকনাফ থেকে পূর্বে মায়ানমারের কাঁটাতার আর পাহাড়ের কোলঘেঁষে নাফ নদী। পশ্চিমে টেকনাফের সুবজ পাহাড়, ম্যানগ্রোভ বন। এ নদীর মোহনা থেকে দক্ষিণে সমুদ্রের গভীরে ১২ কিলোমিটার এগোলে দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। জেটি থেকে নেমে উত্তর-পূর্ব দিকে তাকালেই চোখে পড়ে প্রবালহীন বালির বিচ। কিছুদূর এগোলে ঝিনুকের মাথার মতো বেঁকে চলে গেছে পশ্চিম দিকে। এই বাঁক ও এর আশপাশেই ঘটেছে এ যাবত সবগুলো মৃত্যুর ঘটনা। উত্তর-পূর্ব দিকে থেকে নাফনদী ও মায়ানমারের দিক থেকে আসা স্রোত মিশে মোহনা হয়ে এসে আছড়ে পড়ে এ বাঁকেই। এখানকার ঢেউগুলো সাগরের অন্য জায়গাগুলোর মতো স্বাভাবিক না। এই কোণে ঢেউগুলো আসে তিন দিক থেকে। সবগুলে এসে একখানে বাড়ি খেয়ে ফের ছুটে আসে উপকূলে। বেশ এলোমেলো ঢেউ। এখানেই রয়েছে চোরা স্রোত ও গভীর খাদ। কিনারে গভীরতা আট ফুটের মতো হলেও পরেই সেটা হয়ে গেছে একেবারে ১৫০ ফুট। আর এমন অদ্ভুত পরিবর্তনই এখানকার যতো দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। স্থানীয় ও রেসকিউ টিমের সদস্যদের বক্তব্য এমন। তাদের বর্ণনায় বৈজ্ঞানিক ভিত্তিটাও স্পষ্ট। সেন্টমার্টিন বিচ রেসকিউ টিমের দায়িত্বে থাকা মো. আমিন বাংলানিউজকে বলেন, এখানে ২০১১ সালে তিনজন, ১২ সালে চারজন ও ১৪ সালে নয়জন মারা যান।
এসব মৃত্যু দেখা দ্বীপবাসীর কেউ কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না খুঁজে বিষয়টিকে দেখছেন ভিন্নভাবে। পশ্চিম বিচের ষাটোর্ধ্ব ব্যবসায়ী আব্দুল কালাম বলেন, এই ১০ থেকে ১২ দিন আগের কথা, এক লোক ওই পয়েন্টে ভিডিও করছিলেন। এসময় ভিডিও মধ্যে কালো যুইগ্যা (তাদের কাছে বড় কালো প্রাণী বিশেষ) দেখা গেছে। তারা হয়তো মানুষরে টেনে নিয়ে যায়।
উত্তর বিচের দোকানি আব্দুল হামিদ বলেন, সে বছর ছাত্র মরেছিলো ছয়জন। আমরা নিজ চোখে দেখেছি। ওউ জায়গার ঢেউগুলো বড় বড়। আবার স্রোতে ঘোল (ঘূর্ণি স্রোত) পড়ে। ওই স্রোতে পড়লে আর কেউ উঠতে পারে না। ২০১৪ সালের পহেলা বৈশাখ দুপুর ২টার দিকে গোসলে নেমে আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার বিভাগের ছয় ছাত্র মারা যান। এর মধ্যে দু’জনের মরদেহ পাওয়া যায়নি। এছাড়া মারা যান আরও তিনজন। প্রশাসনের অবহেলা, বিচে কোনো সতর্কবার্তা না থাকা, রেসকিউ টিম না থাকা, জোয়ার-ভাটার তথ্য না থাকা এ মৃত্যুর কারণ বলে মনে করেন দ্বীপবাসী। সেসময় সারা দেশ তোলপাড় হয় এ ঘটনায়।
মর্মান্তিক এ মৃত্যুর পর দু’দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিনজন রেসকিউ সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে তাদের প্রশিক্ষিত করা হয় ট্রেনিং দিয়ে। এছাড়া সতর্কতামূলক বিলবোর্ড, করণীয়, সতর্কবার্তা যুক্ত করা হয় এ বিচে। এ পদক্ষেপের পর ২০১৫-১৬ সালে এ বিচে কোনো পর্যটক মারা যাননি বলেই দাবি সেন্টমার্টিন বিচ রেসকিউ টিমের প্রধান মো. আমিনের। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, টোটাল সেন্টমার্টিনে আমরা এখন মাস্টাররোলের কর্মচারী হিসেবে ছয়জন কাজ করছি। এরমধ্যে তিনজন এ উত্তর বিচে, দু’জন পূর্ব বিচে ও একজন ছেঁড়া দ্বীপে।
এ বছর তিন দফায় সাতজন নারী-পুরুষকে তারা বাঁচিয়েছেন বলে জানান। এদের প্রত্যেকেই ভেসে চলে যাচ্ছিলো।
তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে দেইনি। পর্যকদের নামার আগেই আমরা সাবধান করি। অনেক সময় নামতে দেই না। কর্নারে স্রোত অনেক বেশি। গভীর খাদ রয়েছে। নৌবাহিনী এটা পরীক্ষা করে দেখেছে। জায়গাটা আসলেই খুব ভয়ংকর। আমিনের দাবি, বিভিন্ন জায়গায় আরও সচেতনতামূলক বিলবোর্ড লাগানো প্রয়োজন। সেন্টমার্টিনে কোনো তথ্যকেন্দ্র নেই। যদি একটা তথ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা যায় তাহলে পর্যটকরা আরও ভালোভাবে ঘুরতে পারবে, নিয়ম মেনে চলতে পারবে। এতে কোনো দুর্ঘটনা হবে না।
দ্বীপের এই অংশের ঢেউগুলোও বড় বড়। পাড়ের ভাঙন দেখে সেটা স্পষ্ট বোঝা গেলো। পুরো দ্বীপ ঘুরে এমন ভাঙন আর দেখা যায়নি। অন্যদিকে এ পাশের পানি তুলনামূলক বেশি নীল। যে কারণে সৌন্দর্যও বেশি। তাছাড়া সাঁতার ও গোসল করার আর কোনো উপযুক্ত বিচ সেন্টমার্টিনে নেই। পানির গভীরতার জন্য এটা হয় বলে অনুমেয়।
প্রাকৃতিকভাবেই সৌন্দর্য আর মৃত্যু যেনো পাশাপাশি অবস্থান করছে উত্তর-পূর্ব কোণের এ বিচে। উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে এগোলেই একটু উঁচু জায়গায় দ্বীপবাসীর একমাত্র কবরস্থান। মৃত্যু যেনো এখানে প্রতীকী রূপ হয়ে ধরা দিয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩০৩ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৬
এএ/জেডএম/এসএনএস