কক্সবাজার থেকে ফিরে: দশ বছর আগেও পর্যটন নগরী কক্সবাজার জেলা খাদ্যে আমদানির ওপর নির্ভর ছিল। কিন্তু এ তথ্য এখন শুধুই পরিসংখ্যান।
নতুন নতুন ফসলের বিস্তৃতি, এক ফসলি জমি থেকে চার ফসলি জমিতে উন্নীত, লবণাক্ত জমিকে জয়সহ নানা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এ জেলার কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। এমন বিপ্লবে ভবিষ্যতে জাতীয় অর্থনীতিতে কক্সবাজারের কৃষির অংশগ্রহণেরও হাতছানি দিচ্ছে।
উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, পাহাড়ি ঢলসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে এখানকার কৃষি এগিয়ে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে এমনটাই জানালেন কক্সবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক আ ক ম শাহরিয়ার।
নিজ দফতরে কৃষির চিত্র তুলে ধরে এ কর্মকর্তা বলেন, নানা চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এ জেলার কৃষিতে এগিয়ে যাওয়ার গল্প এখন সবার জানা। ফল, ফুল চাষাবাদ ও উৎপাদনে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষির প্রযুক্তিতে এগিয়ে গেছে কয়েক ধাপ।
এ জেলায় পান ও সুপারির পাশাপাশি ভুট্টা এবং মিষ্টি আলুর চাষাবাদ ও উৎপাদনে অনেক বড় সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ডাল জাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ছে। এছাড়া লিচু, ড্রাগন, আম উৎপাদনেও বড় ভূমিকা রাখছে কক্সবাজার জেলার কৃষি।
আ ক ম শাহরিয়ার বলেন, এ জেলার কৃষিতে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল লবণাক্ত জমিতে চাষাবাদ। কিন্তু সেখানেও সফলতা পাওয়া গেছে। লবণাক্ত সহনশীল জাতের ধানের চাষাবাদ কয়েক ধাপ এগিয়ে গেছে। এছাড়া শাক সবজি, ফল উৎপাদনে অনেক দূর এগিয়েছি আমরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর, কক্সবাজার সূত্র জানায়, জেলার মোট আয়তন দুই হাজার ৪৯১ দশমিক ৮৬ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ২৪ লাখ মানুষের মধ্য কৃষক পরিবার রয়েছে দুই লাখ ১৮ হাজার ২৩০টি। মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপের শহর কক্সবাজার এখন খাদ্য উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিক টন খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকে।
তবে শঙ্কার যা রয়েছে তা হলো কৃষি জমি হ্রাস। স্কুল-কলেজ স্থাপন, রাস্তাঘাট নির্মাণ, বাড়ী-ঘর তৈরিসহ নগরায়নের কারণে গত ১০ বছরে কৃষি জমি ০.৫% কমেছে।
জেলার কৃষির আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, সকল ফসলের উফশী ও হাইব্রিড জাতের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় হেক্টর প্রতি গড় ফলন এবং মোট উৎপাদন বাড়ছে। এছাড়া সেচ সুবিধা বৃদ্ধি, বিভিন্ন প্রতিকূলতা সহিষ্ণু জাতের উদ্ভাবন। নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন। উন্নতমানের বীজের ব্যবহার বৃদ্ধি। সুষম মাত্রায় সার ব্যবহার। নন-ইউরিয়া সারের ব্যবহার বৃদ্ধি।
জমির বৈশিষ্ট্যের কারণে এ জেলায় পান, সুপারি ও নারিকেল চাষ ভালো হয়। এছাড়া পাহাড়ি এলাকা থাকায় বিভিন্ন প্রকার মিশ্র ফলের চাষ হয়। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় লবণাক্ততা সহিষ্ণু জাতের ধান আবাদ হয়।
জেলার কৃষি এগিয়ে যাওয়ার চিত্র: বিগত ১০ বছরের তুলনায় কক্সবাজারের কৃষি বিশেষ করে ধান, শাকসবজি, ফুল ও ফল চাষে অনেক এগিয়েছে। ফসলের নিবিড়তা ১৭৫% হতে ২১৫% এ উন্নীত হয়েছে।
১০ বছর আগে তিন ফসলি জমি ছিল ১২ হাজার হেক্টর, বর্তমানে তা প্রায় ২১ হাজার হেক্টরে উন্নীত হয়েছে। ওই সময়ে চার ফসলি জমি ছিল না, কিন্তু বর্তমানে দেড় হাজার হেক্টর জমিতে চার ফসলের আবাদ হয়েছে।
বর্তমানে রপ্তানিযোগ্য পণ্য পান তিন হাজার হেক্টর জমি ও সুপারি সাড়ে তিন হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ হচ্ছে।
দানাদার শস্য (আউশ, আমন, বোরো ধান ও ভুট্টা) দশ বছর আগে চাষ হতো এক লাখ ৮ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। এখন এতে প্রায় ৩২ হাজার হেক্টর জমি বেড়েছে, হেক্টর প্রতি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় দশমিক ৫০ ভাগ মেট্রিক টন।
ডাল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। উৎপাদন বেড়েছে হেক্টর প্রতি এক মেট্রিক টন। তেল জাতীয় ফসলের চাষাবাদ বেড়েছে চারগুণ। উৎপাদন বেড়েছে হেক্টর প্রতি এক গুণ। মসলা জাতীয় ফসলের আবাদ বেড়েছে চার হাজার হেক্টর জমিতে। হেক্টর প্রতি উৎপাদন বেড়েছে প্রায় একগুণ।
ফলের জমি বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। হেক্টর প্রতি উৎপাদন ১৬ থেকে ২৫ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে। শোভাবর্ধনকারী ফুলের আবাদ ছিল না, বর্তমানে ১১০ হেক্টর জমিতে এর চাষ হচ্ছে।
যেসব ফসল চাষ হচ্ছে: ধানের মধ্য রয়েছে আউশ, আমন, বোরো ধান। ডাল জাতীয় ফসল, তেল জাতীয় ফসল সরিষা, চীনাবাদাম মসলা জাতীয় ফসল মরিচ, ধনিয়া, পিয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ। শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন দুই মৌসুমেই চাষ হয়। ফলের মধ্য রয়েছে আম, বাউকুল, আপেলকুল, কলা পেঁপে, তরমুজ, খিরা, বাঙ্গী। ফুলের মধ্য রয়েছে গোলাপ, গ্লাডিওলাস, গাঁদা ফুল।
তবে এ জেলার কৃষিতে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। আকষ্মিক পাহাড়ি ঢলে ফসল নষ্ট হওয়া, রাবার ড্যাম পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, বেড়ী বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়া, চিংড়ী চাষ করতে গিয়ে লবণাক্ত পানি ফসলের জমিতে প্রবেশ করা, সময়মত স্লুইস গেট মেরামত না করা, খাল, নদী ও নালা ভরাট হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
বাংলাদেশ সময়: ১৩৩২ ঘণ্টা, মে ২, ২০১৬
একে/জেডএম