ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

গরুও মানিয়ে নিয়েছে হাওরকে

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬
গরুও মানিয়ে নিয়েছে হাওরকে ছবি: আসিফ আজিজ, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

কাছাড়িয়া হাওর (সুনামগঞ্জ) থেকে: গরুর দলটির আগে-পিছে কাউকে দেখা গেলো না। কিন্তু দলটি স্কাউট সদস্যদের মতো সুশৃঙ্খলভাবে গজারিয়া নদীতে নামছে।

গরুগুলো যেখানে ছিল তার চারদিকে পানি আর পানি। জেগে থাকা এক চিলতে জমি। তাতে ঘাস খাচ্ছিলো গরুরপাল। এরপর কী করে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম সাঁতরে সড়কে উঠে এলো।

গরুগুলোর এমন আচরণ দেখে বেশ অবাক লাগলো। উত্তরবঙ্গে দেখেছিলাম, গরু নদী পার করার জন্য তিন জনের কসরত। একজন সামনে থেকে রশি টানছে, আর দুইজন পেছন থেকে পানির দিকে ঠেলছে গরুকে। রশি টানার কারণে জিহ্বা বেরিয়ে আসতে চাইছে তবুও পানিতে নামতে চায় না গরুটি। কখনও কখনও শপাত-শপাত করে বেতও মারা হচ্ছিলো। আবার ধাক্কা দিয়ে নদীতে নামিয়ে দিলেও ফিরে আসতে দেখা গেছে।

উত্তরবঙ্গের বেশিরভাগ গরু পানি দেখলে ভয়ে পালিয়ে যায়। কতগুলো তো পানিতে জন্মানো ঘাসও মুখে দেয় না। আর এই অঞ্চলের গরুর মধ্যে কতো ফারাক, জাত এক হলেও স্বভাব প্রায় পুরোটাই আলাদা। এসব গরু নিজ থেকে সাঁতরে ঘাস খেতে যাচ্ছে। আর বিকেলে সাঁতরে ফিরে আসছে ঘরে। দেশের উত্তর-পশ্চিমে গরুর যে বিষয়গুলেযা কল্পনাও করা যায় না, উত্তর-পূর্বে সেটাই বাস্তবতা।

রোববার (১৭ জুলাই) বিকেল ৪টায় সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপরে কড়চার হাওরে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। রাখাল বিরাজ মিয়া জানালেন, এইটা নিয়মিত চিত্র। সব গরুই পানি পার হয়ে খাবার খেতে যায়। আবার বিকেলে খাওয়া শেষে একাই বাড়িতে ফিরে আসে। কাউকে যেতেও হয় না।

হাওর অঞ্চলে এখন কিছু-কিছু জমিতে ধান রোপণ শুরু হয়েছে। বেশির ভাগ মাঠেই এখন ফাঁকা পড়ে রয়েছে। সে কারণে কোনো গরু ছাগলের গলার রশি দেখা গেলো না। সবই ছেড়ে দেওয়া। ইচ্ছা মতো ঘুরে ফিরে আহার করছে। কয়েক দিনের বর্ষণের ফলে হাওর ও বিলের পানি বেড়ে যাওয়ায় বেশিরভাগ ঘাসি জমি তলিয়ে গেছে। যেখানে দু’একটি জেগে আছে সেখানে গিয়ে ভিড় করছে পুরো গ্রামের গরুরপাল। কোথাও কোথাও কোমর পনিতে ঘাসের সবুজ মাথা উঁকি দিচ্ছে। সেই ঘাস খাওয়ার জন্য কতগুলো আবার বুক পর্যন্ত পানিতে সপে দিয়েছে নিজেকে।

গরুগুলোর এই আচরণ নিয়ে যখন নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিলো। তখন সহকর্মী আসিফ আজিজ জানালেন আরও চমকপ্রদ তথ্য। তিনি মহেশখালী সফরের সময় দেখেছেন, ভাটার সময় একটি গুরু শুকনো জায়গায় ঘাস খাচ্ছিলো। একটু পরে জোয়ার এলে গেওয়া গাছের কাণ্ড তলিয়ে যায়। আর সেই সুযোগে গরুটি সাঁতরে গিয়ে গেওয়ার পাতা মুচড়ে উদরপূর্তি করে। পানি না থাকলে ওই গাছটির পাতা নাগাল পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। কিন্ত জোয়ারের সুযোগে সেই কাজটি সেরে নিলো।

কোথাও কোথাও বিশাল বড় মহিষের পাল, পানিতে বুক ডুবিয়ে কচুরিপানা খাচ্ছে। এই অঞ্চলে গরু নেই এমন কৃষক খুঁজে পাওয়া কঠিন। কম করে হলে একটি গরু আছে। বেশির ভাগেই বাড়িতেই রয়েছে দশ-বারোটি করে গরু। গরুর পাল দেখাশুনার জন্য রাখাল অথবা চুক্তি করারও রেওয়াজ প্রচলিত আছে।
আপাত দৃষ্টিতে গরু পালন সহজ মনে হলেও আমন রোপণের পরে গরু পালনকারীরা পড়েন বিপাকে। তখন পুরো মাঠ বন্ধ হয়ে যায়। আবার বন্যা এলে সব তলিয়ে যায় তখন দুর্গতির অন্ত থাকে না গৃহপালিত এই পশুগুলোর।

গরুগুলোর যেমন স্বভাব আলাদা। তেমনি মানুষের জীবনচিত্রও আলাদা। বেশিরভাগ মানুষ মৌসুমের সঙ্গে তাদের পেশাও পাল্টে ফেলেন। বলা যায় পেশা পাল্টাতে তারা বাধ্য হন। অনেক এলাকার মানুষ যখন পাকা রাস্তার জন্য কাঙাল, কেউ বা আবার পাকা রাস্তার ধারে গিয়ে বাড়ি করেন। কিন্তু এ অঞ্চলে তার যেন কোনই বালাই নেই। তা না হলে নমেন্দ্র রায় বিশ্বম্ভরপুর গ্রাম ছেড়ে কাছাড়িয়া হাওরের ভেতরে শান্তিপুরে (নতুন নামকরন) গিয়ে কেন ঘর তুলবেন। দ্বীপাকৃতি এই জায়গাটি বছরের ৮ মাস থাকে পানিবন্দি। নৌকা ছাড়া কোনোই গতিই থাকে না তাদের।

স্বাস্থ্য-শিক্ষা, হাটবাজার কিছুই নেই যেখানে। গাড়ি তো দূরের কথা, বাড়ি পর্যন্ত রিকশা নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। খুব শিগগিরই যে তাদের এই অবস্থার উন্নতি হবে, সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন..

** ‘শ্রীমঙ্গল কিন্তু এক্কেবারে অন্য ধাঁচের’

*** মুভি দেখে পুলিশে যোগদান

***ভোরের স্নিগ্ধ লাউয়াছড়া-১
**লাউয়াছড়ার বুক চিরে ট্রেন ভেঙে দিয়ে যায় নির্জনতা
**হ-য-ব-র-ল বগিতে ভোগান্তির পারাবত!

বাংলাদেশ সময়: ১০৫০ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৬

এসআই/টিআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে এর সর্বশেষ